মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ইসরায়েল ও তুরস্ক। এই পরিবর্তনের তরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের প্রভাব আরও বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে পারে।
সিরিয়ায় বর্তমান নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ সমানভাবে ভয় এবং আশা দুটোই জাগিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের চমকপ্রদ পতনের পর সবার দৃষ্টি এখন দামেস্কে গঠিত হওয়া নতুন ব্যবস্থাপনার দিকে— এবং প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকার ওপর।
বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যেই এই ঘটনায় কারা কারা ভূ-রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী ও পরাজিত তাও ঘোষণা করে দিয়েছেন। আসাদের দীর্ঘদিনের সমর্থক ইরান ও রাশিয়া এখন তাদের ক্ষতি সামাল দিচ্ছে। অন্যদিকে, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিভিন্নভাবে সমর্থন দেওয়া তুরস্ক এবং আরব রাজতন্ত্রগুলো বাড়তি প্রভাবশালী অবস্থানে উঠে এসেছে।
রাশিয়া ও ইরানের পশ্চাদপসরণে ইসরায়েলও নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে বলে অনুভব করছে। ইসরায়েল সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা ও ঘাঁটিগুলোতে নির্মম বোমাবর্ষণ চালিয়েছে এবং গোলান মালভূমি থেকে সিরিয়ার ভূখণ্ডে স্থলসেনা মোতায়েন করেছে।
আসাদকে উৎখাত করা ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী যখন দেশটির রাজনৈতিক রূপান্তরের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তখন পশ্চিমা সরকারগুলো দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার পর আবারও সিরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে।
১২ বছর পর প্রথমবারের মতো গত মঙ্গলবার ফ্রান্সের পতাকা দামেস্কের ফরাসি দূতাবাসে উড়ানো হয়েছে। এরপর শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি কুটনৈতিক প্রতিনিধি দলও সিরিয়ায় হাজির হয়েছে, যা এক দশকের বেশি সময় পর দামেস্কে প্রথম আমেরিকান কূটনৈতিক সফর।
অনেক কিছুই এখনও অনিশ্চিত। বৃহস্পতিবার দামেস্কের কেন্দ্রস্থলে শত শত মানুষ বিক্ষোভ করেছে। তারা ইসলামপন্থী সংশ্লিষ্ট নতুন কর্তৃপক্ষের প্রতি একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কুর্দিরা তুরস্ক-সমর্থিত মিলিশিয়াদের সঙ্গে সম্ভাব্য লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আসাদের সংখ্যালঘু আলাবী শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
আসাদের পতন কিছু বিষয় পরিষ্কার করেছে। ইসরায়েল লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করায় আসাদের পতন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। হিজবুল্লাহ ইরান সমর্থিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আসাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল লেবাননে হিজবুল্লাহর উপর হামলা শুরু করার তিন মাসের মধ্যেই আসাদের পতন ঘটেছে। এতে বহু বছর ধরে আসাদকে রক্ষা করার পর ইরান এবং রাশিয়াও শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমতায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বা হয়ত তা করতে ইচ্ছুকও ছিল না। আসাদের ক্ষমতাচ্যুতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
ব্রিটেনের চ্যাথাম হাউস থিঙ্ক ট্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক লিনা খতিব লিখেছেন, “১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনে যেভাবে ইউরোপে কমিউনিজমের পতন ঘটেছিল, সেভাবে আসাদের পতনে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিম-বিরোধী এবং ইসরায়েল-বিরোধী প্রতিরোধের আদর্শের অবসান ঘটেছে।”
“অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আসাদ পরিবার মধ্যপ্রাচ্যে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ছিল, যেখানে একাধিক রাষ্ট্র নিজেদের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও জায়োনিজমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী বলে উপস্থাপন করেছিল।”
লিনা খতিব বলেন, এখন মনে হচ্ছে ইসরায়েল ‘মধ্যপ্রাচ্যের এজেন্ডা নির্ধারক’ হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল তার দুই ঘনিষ্ঠ শত্রু হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে পরাজিত করেছে। তবে এই সাফল্য অর্জনে তাদের হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করতে হয়েছে। এতে তাদের বিরুদ্ধে গাজা উপত্যকায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ উঠেছে।
ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে তাদের আঞ্চলিক শত্রু ইরান দুর্বল এবং অপমানিত হয়েছে। আগামী মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই অঞ্চলে ইসরায়েলের এজেন্ডা আরও এগিয়ে নিতে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবেন।
ইসরায়েলের সাবেক শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমোস ইয়াডলিন এবং আবনার গোলভ ফরেইন অ্যাফেয়ার্সে এক লেখায় ‘মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কৌশল তুলে ধরেছেন। তারা সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় আরব রাজতন্ত্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার আহ্বান জানান। তবে ইসরায়েলের এই প্রচেষ্টা সফল করতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছু ছাড় দেওয়ার প্রয়োজন হবে।
কিন্তু এই চেষ্টা নেতানিয়াহুর ডানপন্থী জোটের কিছু সদস্যের বিরোধিতার মুখে পড়তে পারে। এরা পশ্চিম তীর ও গাজার কিছু অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করা এবং গাজায় সামরিক শাসন জারি কিংবা এমন অভ্যন্তরীণ নীতির স্বপ্ন দেখেন যা দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করবে।
ইয়াডলিন ও গোলভ লিখেছেন, “গত তিন মাসে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নতুন আকার দেওয়ার ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। তবে সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। নেতানিয়াহুর জোটের উগ্র সদস্যদের চাহিদাগুলো এই অগ্রগতিকে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।”
কিন্তু আরেকটি আঞ্চলিক শক্তিও এখন তাদের সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। আসাদ সরকারের পতন ইরানের ‘শিয়া বলয়’ ভেঙে দিয়েছে। এই বলয়টি তেহরান থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী শিয়া গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করেছিল।
দ্য গার্ডিয়ানে হাসান লিখেছেন, আসাদের পতন এবং হিজবুল্লাহর দুর্বল অবস্থান ইরানের “শিয়া অর্ধচন্দ্রাকার বলয়’ ভেঙ্গে দিছে। এর ফলে তুরস্কের ‘পূর্ণিমা’ বলয়ের উত্থান ঘটছে, যা আফ্রিকার শৃঙ্গ অঞ্চল থেকে লেভান্ট এবং আফগানিস্তান পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুনভাবে সাজাচ্ছে।
তুরস্কের মিত্রগোষ্ঠীগুলো এখন দামেস্কে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে এবং সিরিয়ার উত্তর-পূর্বে আরও নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দীর্ঘদিন ধরেই আসাদের অপসারণ দাবি করে আসছিলেন। তার সেই দাবি এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শক্তিশালি আঞ্চলিক রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তিনি আরও বড় ভূমিকা পালন করেছেন। সম্প্রতি তিনি ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তির মধ্যস্থতা করেছেন এবং আজারবাইজানের সঙ্গে তুরস্কের মিত্রতা আরও জোরদার করেছেন। আজারবাইজান ইরানের পাশে অবস্থানরত একটি শক্তিশালি তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্র।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ার বিদ্রোহকে ‘তুরস্কের শত্রুতামূলক দখল’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তবে আঙ্কারা ট্রাম্পের এই অভিযোগমূলক বয়ান প্রত্যাখ্যান করেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা এটিকে দখল বলব না, কেননা তা সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করবে।”
তিনি বলেন, আসাদের পতন “সিরিয়ার জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন” এবং মধ্যপ্রাচ্যের জন্য “আধিপত্যের সংস্কৃতি” থেকে বের হয়ে আসা জরুরি।
হাকান ফিদান আল জাজিরাকে বলেছেন, “তুরস্কের আধিপত্য নয়, ইরানের আধিপত্য নয়, আরবদের আধিপত্যও নয়; বরং সহযোগিতাই প্রধান নীতি হওয়া উচিৎ।”
ইসলামীপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তুরস্কের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব এবং মুসলিম ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে সহায়তা করা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর জন্য এবং ইসরায়েলের জন্যও উদ্বেগের কারণ। গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তুরস্ক এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। ফলে দামেস্কের রাজনৈতিক সংঘাত দ্রুতই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাত্রা পেতে পারে।
ফিনান্সিয়াল টাইমসের কলামিস্ট গিডিয়ন র্যাচম্যান লিখেছেন, “এরদোয়ান ও নেতানিয়াহুর পরস্পরবিরোধী উচ্চাকাঙ্ক্ষা সহজেই সিরিয়ায় সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। ফলে এটি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোরও সেখানে স্বার্থ জড়িত।”
তবে ইরান দুর্বল হয়ে পড়লেও প্রতিদ্বন্দ্বীদের সতর্কতার সঙ্গেই তাদের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের পল সালেম বলেছেন, “ইসরায়েল যদি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়, তবে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইরান তখন উপসাগরীয় অঞ্চলে তেল পরিবহন ও উৎপাদন স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। এতে একটি বৈশ্বিক জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “ইরান তার হারানো প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনর্গঠনের জন্য দ্রুত পরমাণু অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যুদ্ধের ঝুঁকিও তৈরি হবে।”
তাই অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত কূটনৈতিক উপায়ে ইরানের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া। এর মধ্য দিয়ে তাদের দ্রুত পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা থামানো সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও বুধবার নিউইয়র্কে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের আলোচনায় তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি না যে ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরি অনিবার্য।” তিনি আরও বলেন, “আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।”
সিরিয়ায় বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরান সতর্কতার সঙ্গে নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে পারে। তারা নিরাপত্তা শূন্যতা ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে সম্ভাব্য অস্থিরতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।
সিরিয়ার সাংবাদিক ইব্রাহিম হামিদি বলেছেন, “আমরা সবাই জানি, আসাদের পতনে ইরান বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে এটাও জানি, ইরান ধৈর্যশীল।”
তিনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে ইরান কয়েক ধাপ পিছিয়ে গিয়ে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবে তা ভাবছে।”
লেখক: ওয়াশিংটন পোস্টের বিদেশ ডেস্কের একজন কলামিস্ট। সেখানে তিনি টুডে’স ওয়ার্ল্ডভিউ নিউজলেটার এবং কলাম লেখেন। ২০২১ সালে তিনি ‘আর্থার রস মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছিলেন, যা আমেরিকান একাডেমি অফ ডিপ্লোম্যাসির দেওয়া একটি পুরস্কার। এর আগে তিনি টাইম ম্যাগাজিনে সিনিয়র এডিটর এবং করসপন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন, প্রথমে হংকং এবং পরে নিউ ইয়র্ক থেকে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে কলামটি অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক।