প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে ভেনেজুয়েলায়। তার জেরে দেশটির বিরোধী দলের নেতা এদমুন্দো গঞ্জালেস নিরাপত্তার স্বার্থে দেশে ছেড়ে স্পেনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্পেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তার স্ত্রীর সঙ্গে গত রবিবার স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের তোরেজন দে আরদোজ সামরিক ঘাঁটিতে পৌঁছেন।
গঞ্জালেস ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন।
এরপর গত সপ্তাহে বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অংশ হিসাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় গঞ্জালেসের বিরুদ্ধে। আর এজন্যই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি।
কী ঘটেছে ভেনেজুয়েলায়
দেশটির জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, নিকোলাস মাদুরো ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে তার গুরু ও পূর্বসূরি উগো চাভেসের মৃত্যুর পর প্রথম ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি তার তৃতীয় জয়। গত ২৫ বছর ধরে ইউনাইটেড সোস্যালিস্ট পার্টি দেশটির ক্ষমতায় আছে।
তবে বিরোধী দলের দাবি, ২৮ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল জালিয়াতি করা হয়েছে। তাদের স্বেচ্ছাসেবকরা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন থেকে ইস্যু করা ৭৩ শতাংশ টালি শিট সংগ্রহ করেন। তাদের দাবি, এই শিটগুলো থেকেই প্রমাণিত হয়, গঞ্জালেস আসলে বিজয়ী। তাদের দাবি, মাদুরো মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।
প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের পৃথক ফল প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছে বিরোধীরা।
বিরোধী বিক্ষোভকারী ও নেতাদের উপর নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ আছে মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে। এই নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বিরোধীদের অনেকে বিদেশি দূতাবাসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, এই বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত কমপক্ষে ২৪ জন নিহত এবং প্রায় ২৪০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার নিরাপত্তা বাহিনী কারাকাসে অবস্থিত আর্জেন্টিনার দূতাবাসকে ঘিরে রেখেছে। কারণ সেখানে ছয়জন বিরোধীদলীয় নেতা আশ্রয় চাচ্ছে।
গঞ্জালেস গত এক মাস ধরে লুকিয়ে ছিলেন। কারাকাসে প্রথমে নেদারল্যান্ডস দূতাবাস এবং পরে স্পেনের দূতাবাসে আশ্রয় চেয়েছিলেন তিনি।
কে এই গঞ্জালেস
এদমুন্দো গঞ্জালেস উরুতিয়া হলেন ৭৫ বছর বয়সী একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ। বিরোধীদের সম্মিলিত প্লাটফর্ম থেকে মাদুরোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তাকে মনোনীত করা হয়। বিরোধীদলীয় প্রধান প্রার্থী মারিয়া করিনা ম্যাকাদোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত করা হলে এই ঘটনা ঘটে। তিনি কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত নন।
গঞ্জালেস ১৯৯১ সালে ভেনেজুয়েলার আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার আগে এল সালভাদর, যুক্তরাষ্ট্র ও বেলজিয়ামে কূটনৈতিক পদে কর্মরত ছিলেন।
কেন স্পেনে আশ্রয়
বিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার দায়ে আদালত গঞ্জালেসকে দোষী সাব্যস্ত করে। এরপর তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্পেনে চলে যান।
ম্যাকাদো রবিবার সোশাল মিডিয়া এক্সে এক পোস্টে বলেন, “গঞ্জালেসের জীবন বিপন্ন ছিল। তাকে প্রতিনিয়ত হুমকি, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, চাপ প্রয়োগ ও ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা হচ্ছিল। এসব প্রমাণ করে, শাসকরা তাকে চুপ করাতে আত্মসম্মানহীন ও সীমাহীনভাবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।”
রবিবার বিরোধী দলের প্রকাশিত একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে গঞ্জালেস নিজেই বলেন, “কারাকাস ত্যাগ করার সময় আমাকে চাপ দেওয়া হয়েছিল। আমার উপর জোর করা ছাড়াও হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।”
নির্বাসন থেকেই কি নেতৃত্ব
এখনকার জন্য তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিতে থাকবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ম্যাকাদো রবিবার তার এক্স পোস্টে লেখেন, “এদমুন্দো আমাদের প্রবাসীদের সঙ্গে বাইরে থেকে সংগ্রাম করবেন। আর আমি আপনাদের সঙ্গে এখান থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাব।”
ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক বিশ্লেষক কার্লোস পিনা আল জাজিরাকে বলেন, “বিদেশে থাকা সত্ত্বেও গঞ্জালেস বিরোধী দলের প্রচারে একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবেন। ফলে আমার বিশ্বাস সংগ্রাম চলবে।”
কী করবে বিরোধীরা
পিনার মতে, গঞ্জালেসের নির্বাসনের ফলে বিরোধী দলের নির্বাচনোত্তর সংগ্রামে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার চলে যাওয়া বিরোধী দলের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ সরলভাবে বললে, তাদের মূল নেতা জাহাজ ছেড়ে পালাচ্ছেন।
পিনা আরও বলেন, “ম্যাকাদোর ভেনেজুয়েলায় থাকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ দেশটির জনগণের মধ্যে ম্যাকাদো ও গঞ্জালেসের যথেষ্ট সমর্থন থাকলেও বিরোধী দল যদি তাদের আন্দোলন চালিয়ে না যায়, তবে এই সমর্থন বজায় থাকবে কি না তা নিশ্চিত নয়।
“বিরোধী দলকে অবশ্যই তাদের কৌশল নতুন করে গড়তে হবে, জনগণকে সক্রিয় রাখতে হবে, রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে এবং সরকারকে নির্বাচনী ফল প্রকাশের জন্য চাপ দিতে হবে।”
কী বলছে মাদুরো সরকার
মাদুরো সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত রাখতে তারা গঞ্জালেসকে দেশত্যাগ করতে দিয়েছে। তার দেশত্যাগের পেছনের কারণ সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল তারেক উইলিয়াম সাব রবিবারে দাবি করেন, গঞ্জালেসের দেশত্যাগ ম্যাকাদোর দলের চাপের ফসল।
তিনি সিএনএনকে বলেছেন, বিরোধী জোটের চাপে গঞ্জালেসকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়েছে। সেই ‘চরমপন্থী’ বিরোধী শিবিরে এখন বিভক্তি দেখা যাচ্ছে।
মাদুরো কি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন
যুক্তরাজ্যে ভেনিজুয়েলার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ভ্যানেসা নিউম্যান আল জাজিরাকে জানান, দক্ষিণ আমেরিকায় মাদুরোর সমর্থন হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
তার মতে, “স্পেনের প্রেসিডেন্ট গঞ্জালেসকে একটি বিমানে চড়িয়ে তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। এটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে স্পেনের বর্তমান সরকার বামপন্থী।”
নিউম্যান আরও বলেন, মাদুরো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। এর আগে আর্জেন্টিনার সরকার নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর মাদুরো ভেনেজুয়েলা থেকে আর্জেন্টিনার কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছিলেন।
তার মতে, “আপনি যদি সত্যিই নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাহলে বিরোধী দলকে যে কারাগারে পাঠায় এবং নির্বাচনের ফল প্রকাশ করে না, এমন স্বৈরশাসকের পাশে দাঁড়ানো কোনোভাবেই ভালো দেখা যায় না। আমার মনে হয় এটি এই অঞ্চলের বামপন্থীদের মধ্যে ফাটল ধরার কারণ হতে পারে।”
নিউম্যানের বক্তব্যের রেশ ধরে পিনা বলেন, “আমি মনে করি এই মুহূর্তে লাতিন আমেরিকার বামপন্থীদের একক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে কথা বলা খুবই কঠিন।”
চিলি, ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার বামপন্থী সরকারগুলো নির্বাচনের ফল প্রকাশের জন্য মাদুরোকে আহ্বান জানিয়েছে। তবে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর বিরোধী কিউবা ও নিকারাগুয়া মাদুরোর পাশে দাঁড়িয়েছে।
নির্বাচনের পর কিউবা, হন্ডুরাস ও বলিভিয়ার কর্মকর্তারা সোশাল মিডিয়ায় মাদুরোকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিউবার রাষ্ট্রপতি মিগেল দিয়াজ-ক্যানেল এক্স পোস্টে লিখেছেন, “মানুষ কথা বলেছিল এবং বিপ্লব জিতেছে।”
গত ২৬ আগস্ট নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল অর্তেগা মাদুরোকে সমর্থন জানিয়ে ‘স্যান্দানিস্তা যোদ্ধাদের’ পাঠানোর প্রস্তাব দেন। তিনি জানান, যদি মাদুরো সশস্ত্র ‘বিপ্লববিরোধী’ বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন, তাহলে তিনি এই যোদ্ধাদের পাঠাতে প্রস্তুত রয়েছেন।
ভেনিজুয়েলা চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকেও সমর্থন পেয়েছে। মস্কো ও বেইজিং উভয়ই মাদুরোর নির্বাচনে জয়লাভে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
গঞ্জালেসের দেশত্যাগে প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মাদুরোর নির্বাচনী জয়কে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তারা বিশ্বাস করে, গঞ্জালেসই প্রকৃত বিজয়ী।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি প্রধান জোসেপ বোরেল এক বিবৃতিতে বলেন, “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনও রাজনৈতিক নেতাকে অন্য দেশে আশ্রয় চাওয়ার জন্য বাধ্য করা উচিৎ নয়।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এক্স পোস্টে গঞ্জালেসকে গণতন্ত্রের শেষ আশা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “মাদুরো এবং তার প্রতিনিধিদের জোরপূর্বক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে দেওয়া যাবে না।”
স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল আলবারেস স্প্যানিশ মিডিয়াকে জানান, তিনি গঞ্জালেসকে বলেছেন, ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলের নেতা দেশে আসছেন, এতে তিনি খুশি।
তিনি বলেন, “আমি আমাদের সরকারের সব ভেনেজুয়েলার নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনরাবৃত্তি করেছি।”