ইসরায়েলে প্রায় ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। মঙ্গলবার রাতের ওই হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যসহ যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ এই হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে একটি বড় যুদ্ধের আশঙ্কা তুঙ্গে উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলাকে শুধু আরেকটি সাময়িক উত্তেজনা বৃদ্ধির ঘটনা হিসাবে খারিজ করা যাবে না।
ইরানের দিক থেকে এই হামলা ছিল তাদের ঘনিষ্ঠ তিনজন ব্যক্তির মৃত্যুর একটি ‘আইনি, যৌক্তিক এবং বৈধ প্রতিক্রিয়া’।
প্রথমত, ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যু।
দ্বিতীয়ত, ইরানের ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল আব্বাস নীলফোরৌশান, যিনি বৈরুতের একটি বাঙ্কারে ইসরায়েলি হামলায় নাসরাল্লাহর সঙ্গে নিহত হন।
তৃতীয়ত, হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা ইসমাইল হানিয়াহ, যিনি জুলাইয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি অতিথিশালায় গুপ্তহত্যার শিকার হন।
মঙ্গলবারের হামলার পর ইরান এই হুমকিও দিয়েছে যে, ইসরায়েল যদি পাল্টা হামলা চালানোর সাহস করে তাহলে দেশটি ইসরায়েলের জন্য আরও বিপর্যয়কর প্রতিক্রিয়া জানাবে।
ইসরায়েল ইতোমধ্যে মঙ্গলবারের হামলার জবাব দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পরপরই ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, “ইরানকে এই হামলার পরিণতি ভোগ করতে হবে।
“আমাদের পরিকল্পনা আছে এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমরা নিজেদের পছন্দ মতো সময় ও স্থান বেছে নেব।”
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে
ইসরায়েল কী ধরনের প্রতিক্রিয়া বেছে নেবে তা দুভাবে ভেবে দেখা যায়।
প্রথমত, ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ায় ইরানের হামলার মাত্রা প্রতিফলিত হতে পারে। ইরানের হামলায় ইসরায়েলে প্রায় কোনও হতাহতের ঘটনাই ঘটেনি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলও তার আচরণ সংযত রাখতে পারে।
অথবা, ইসরায়েলিরা ইরানের লক্ষ্যবস্তুগুলোতে ব্যাপক হামলা চালাতে পারে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুরও মারমুখি কথাবার্তায় তেমন ইঙ্গিতই মেলে।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে তিনি সতর্ক করেন এই বলে যে, “মধ্যপ্রাচ্যের এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে ইসরায়েল পৌঁছাতে পারবে না। এমন কোনও স্থান নেই যেখানে আমরা আমাদের জনগণকে রক্ষা করতে যাব না।”
বুধবার তেল আবিবে এক নিরাপত্তা বৈঠকে যাওয়ার সময়ও নেতানিয়াহু পাল্টা আঘাত হানার প্রতিশ্রুতি দেন। ইরানের এই হামলাকে ‘একটি বড় ভুল’ বলে আখ্যায়িত করে ইরানকে এর জন্য ‘মাশুল দিতে হবে’ বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এখন একটি সম্ভাবনা হল যে, ইসরায়েল ইরানের উপর বিমান হামলা চালাতে পারে। সম্ভবত দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য ব্যবহৃত অবস্থান ও স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালাবে ইসরায়েল।
এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি মিশন। তবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই এই পরিকল্পনা করে আসছে।
এর আগে গত এপ্রিলে সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কমান্ডার নিহত হলে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় তিনশ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইরান।
তবে সেবার হামলার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই ইরান সতর্কতা জারি করেছিল। ফলে ইসরায়েল সেই হামলা প্রতিহত করার যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। সবগুলো ক্ষেপণাস্ত্রই ইসরায়েল ও তার মিত্ররা আকাশেই ধ্বংস করেছিল।
কিন্তু মঙ্গলবারের হামলার আগে ইসরায়েল তেমন কোনও প্রস্তুতি নিতে পারেনি। মঙ্গলবার রাতে ইরান ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর কিছুক্ষণ আগে মাত্র যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য এই হামলার বিষয়ে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছিল।
ফলে এই হামলা প্রতিহত করার প্রস্তুতির জন্য ইসরায়েল খুব কম সময় পায়। এ ছাড়া ইরান এবার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ অত্যাধুনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ছুড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইসরায়েল বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগেই তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাহায্যে ধ্বংস করা হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হেনেছে।
গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে লেবাননে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর অবস্থানগুলোতে ভয়াবহ বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। চলমান এই হামলায় গত শুক্রবার হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হন।
এরপর গত সোমবার মাঝরাতে বিমান হামলার পাশাপাশি হিজবুল্লাহর নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলার উদ্দেশ্যে ইসরায়েলি স্থলবাহিনীও দক্ষিণ লেবাননে প্রবেশ করে। হিজবুল্লাহও ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
ইসরায়েলের হামলায় লেবাননে হিজবুল্লাহর আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডারসহ প্রায় ২ হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় ১০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১০ লক্ষাধিক মানুষ।
লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরুর ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মঙ্গলবার দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তকে ফোন করে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ে সমর্থন দেন।
লয়েড অস্টিন ইরানকে সতর্ক করে বলেন, “ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিলে ইরানকে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হবে।”
ইসরায়েল গত রবিবার ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতিদের ওপরও বিমান হামলা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে যোগ দিলে ইরান তার ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনের মিত্রদের নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, গত বছরের অক্টোবরে ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু হওয়া সংঘাত এখন লেবানন ও ইয়েমেন হয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিচ্ছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, স্কাই নিউজ