Beta
বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪

শিশু হাসপাতালে আতঙ্কের দুপুর

শিশু হাসপাতাল
[publishpress_authors_box]

শিশুদের সব জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য সারা দেশ থেকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ছুটে আসে অনেকে। তাই শিশু রোগী এবং তাদের স্বজনদের ভিড় লেগেই থাকে এখানে।

আগারগাঁওয়ের এই হাসপাতালের প্রতিদিনের চিত্র এমনই। তবে শুক্রবার দুপুরটা ছিল অন্যরকম। আগুন আতঙ্কে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। স্যালাইন লাগানো অবস্থায় সন্তান কোলে নিয়েও হাসপতাল ভবন থেকে বেরিয়ে আসেন কেউ কেউ। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও আতঙ্ক কাটতে চলে যায় অনেক সময়।

ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং শিশু রোগীদের স্বজনরা বলছেন, দুপুর দেড়টার দিকে আগুনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে আতঙ্ক ছড়ায় পুরো হাসপাতালেই। স্বজনরা তখন রোগীদের নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। এক পর্যায়ে আশ্রয় নেয় খোলা জায়গায়, রাস্তায় আর গাড়ি পার্কিংয়ে।

দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আগুন লাগার পর ২টা ৪০ মিনিটে নিভিয়ে ফেলে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু বিকাল ৪টার দিকেও প্রচণ্ড অস্তস্তিকর গরমের মধ্যে খোলা আকাশের নিচেই বসে থাকতে দেখা যায় আতঙ্কিত অনেক রোগী ও স্বজনদের।

বিকালে হাসপাতালের গাড়ি পার্কিংয়ে দুই মাসের মেয়ে ফাতেমাকে নিয়ে বসেছিলেন মো. ইউসুফ। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার বাসিন্দা ইউসুফ নিউমোনিয়া আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে ঈদের দুই দিন আগে শিশু হাসপাতালে আসেন।

ইউসুফ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হাসপাতালের বি ব্লকের নিচতলার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ২১ নম্বর বিছানায় ভর্তি ফাতেমা। আজ দুপুর দেড়টার দিকে হাসপাতালের বাইরে পানি কিনতে গিয়েছিলাম আমি। এমন সময় হাসপাতালে আগুন লাগার খবর পাই। খবর শুনে আতঙ্কে হাসপাতালের দিকে দৌড় দিই।

“কিন্তু ওয়ার্ডে যাওয়ার আগেই পথে দেখি আমার স্ত্রী মাহী মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে আসছে। সেসময় থেকে এখনও বাইরেই আছি। আগুন আরও আগে নিভলেও পুরো ভবনেই ধোঁয়ার গন্ধ, আর ভ্যাপসা গরম। তার উপর এখনও ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। তাই বিকেল ৪টা বেজে গেলেও ওয়ার্ডে ফিরতে পারিনি।”

ইউসুফের পাশেই অসুস্থ মেয়েকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন জুনাইস আক্তার। তিনি জানান, তার দুই বছরের মেয়ে জুনাইসা আক্তারের হার্টে সমস্যা। মেয়েকে নিয়ে তিন দিন ধরে শিশু হাসপাতালে আছেন তিনি।

জুনাইস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঘটনার সময় আমি হাসপাতালের মসজিদে নামাজ পড়ছিলাম। খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি যে ভবনে আমার মেয়ে ভর্তি সেটাতেই আগুন লেগেছে। আমার মেয়ে ভর্তি ছিল চার তলার ১৪ ওয়ার্ডের চার নম্বর বেডে। আর আগুন লাগছে ভবনের পাঁচ তলায়।

“আগুন লাগার পর আমার ভাই মেয়েকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে। তখন থেকে এই খোলা জায়গায় বসে আছি। সাড়ে ৩টার দিকে ওয়ার্ডে ফিরে যেতে বলা হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। তাই যেতে পারছি না।”

তার মতো ওই ভবনের বিভিন্ন বিভাগে থাকা রোগীদের নিয়ে স্বজনরা দীর্ঘ সময় খোলা আকাশের নিচেই ছিলেন বলে জানান জুনাইস আক্তার।

বেলা সাড়ে ৩টার দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে একজনকে পায়চারি করতে দেখা যায়, যার চোখেমুখে ছিল দুশ্চিন্তার ছাপ।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, তার নাম আনোয়ার হোসেন, গ্রামের বাড়ি পাবনার চাটমোহরে।

অসুস্থ সন্তানকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা বাবার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

আনোয়ার জানান, ১৮ দিন ধরে তিন বছরের মেয়ে জান্নাত হৃদরোগ বিভাগের আইসিইউতেই ভর্তি। শুক্রবার দুপুরে সেখানেই আগুন লেগেছে।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আগুন লাগার পর আমার মেয়েকে আইসিইউ থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। এরপর তাকে নাকি জরুরি বিভাগে নিয়ে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখন পর্যন্ত কোনও খবর দেওয়া হয়নি। তাই চিন্তায় আছি। তবে আগুন তাড়াতাড়ি নিভছে দেখে চিন্তা একটু কমছে।”  

বিকাল ৪টার দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে একটি গাছের নিচে আরও অনেকের সঙ্গে স্যালাইনের এক প্রান্ত ধরে বসে ছিলেন আঞ্জুয়ারা বেগম। স্যালাইনের আরেক প্রান্ত তার নয় বছরের ছেলে শায়নের হাতে লাগানো।

আঞ্জুয়ারা জানান, তাদের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর থানার বিলসার গ্রামে। তিন দিন ধরে ছেলেকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে তিনি।

আঞ্জুয়ারা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দুপুরে ছেলের শরীরে স্যালাইন দেওয়া শুরু হয়েছে। একটু পরই সবাই আগুন আগুন বলে দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়া শুরু করে। এ সময় ভয় পেয়ে আমিও ছেলেকে নিয়ে স্যালাইনসহই বের হয়ে আসি। এরপর ২ ঘণ্টা ধরে এখানেই বসে আছি।” 

বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে আসলে রোগীদের নিয়ে ওয়ার্ডে ফেরা শুরু করেন স্বজনরা।

যে যেভাবে পেরেছেন আগুন থেকে বাঁচতে বাইরে এসেছেন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

আগুন লেগেছে এসি থেকে?

ঘটনার সময় হৃদরোগ বিভাগের আইসিইউর ফটকেই ছিলেন বলে জানান হাসপাতালের ক্লিনার মানসুরা আক্তার। তার তথ্যমতে, ঘটনার সময় আইসিইউতে সাতটি শিশু ভর্তি ছিল।

সকাল সন্ধ্যাকে মানসুরা আক্তার বলেন, “দুপুরে আমি আইসিইউর গেটের বাইরেই কাজ করতেছিলাম। ওই সময় আইসিইউর এসিতে প্রথমে আগুন লাগে। এসি থেকে আগুন অন্য জায়গায় যাওয়ার আগেই নার্সরা আইসিইউ থেকে সব বাচ্চাকে বের করে ফেলে। তাই আল্লাহর রহমতে কারও কোনও ক্ষতি হয়নি।”

ফায়ার সার্ভিসেরও প্রাথমিক ধারণা, এসি থেকেই আগুন লেগেছে। আগুন নেভানো শেষে মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ধারণা করছি আইসিইউর ভেতরে এসি ছিল। সেটা থেকে হয়তো আগুন লেগেছে। তদন্তের পর সঠিক কারণ জানা যাবে।”

৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি

আইসিইউতে লাগা আগুনের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম।

পুড়ে যাওয়া আইসিইউ পরিদর্শন শেষে বিকালে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কার্ডিয়াক আইসিইউ বিভাগের প্রধানকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটিকে তিন দিনে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

পুরো আইসিইউ পুড়ে ছাই, ভবনজুড়ে পোড়া গন্ধ

বিকেল ৪টার দিকে পুরো ভবনটিতেই পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। তখন হৃদরোগ বিভাগের আইসিইউতে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে এসির সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউর সব বেড, যন্ত্রপাতি ও ওষুধ পুড়ে গেছে। ছাদ, মেঝে থেকে শুরু করে সবখানেই আগুনের চিহ্ন। কক্ষের অক্সিজেন সংযোগেও আগুন ধরেছিল। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা সময় লেগেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

শিশুরা কিছু বুঝতে পারছে না। কিন্তু অভিভাবকদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। ছবি ; সকাল সন্ধ্যা

মঙ্গলবারও আগুন লেগেছিল হাসপাতালে

গত মঙ্গলবারও হাসপাতালটির আরেকটি ওয়ার্ডে আগুন লেগেছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোগীর স্বজন ক্ষোভের সুরে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মঙ্গলবারও হাসপাতালে আগুন লাগছিল। এরপরও সাবধান হয়নি কেউ। আজ আবারও আগুন লাগল।”

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কয়েকদিন আগে পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে আগুনের একটা ঘটনা ছিল। বিষয়টি বড় কিছু না। খাবার গরম করার সময় চুলায় রোগীর স্বজনের কাপড়ে আগুন লেগেছিল, যা নার্সসহ স্টাফদের চেষ্টায় সঙ্গে সঙ্গে নেভানো হয়।

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে হাসপাতালের প্রস্তুতির ঘাটতি আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালে দুই শতাধিক এসি রয়েছে। শীত শেষে গরম আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি এসি সার্ভিসিং করা হয়।

হাসপাতালের পরিচালক বলেন, “সেদিনের আগুনের পরেই আমাদের নার্সরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেছে। আজকের আগুনে ধোঁয়া বেশি হওয়ার কারণে সেখানে কেউ যেতে পারেনি, যার কারণে আমাদের ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করতে পারিনি। ফায়ার সার্ভিসকে জানাতে হয়েছে। দ্রুত ফায়ার সার্ভিস চলে আসায় কোনও হতাহত হয়নি। সবাই নিরাপদে আছে।”

পুড়ে যাওয়া হাসপাতালের ঘর। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

আগুনে কোনও রোগীরই ক্ষতি হয়নি : প্রতিমন্ত্রী

আইসিইউতে যেসব ভর্তি শিশু ছিল আগুনে তাদের কোনও ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী রোকেয়া সুলতানা। বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এ কথা জানান তিনি।

প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, আগুনে হাসপাতালে ভর্তি কোনও রোগীরই কোনও ক্ষতি হয়নি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হৃদরোগ বিভাগের আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া শিশুদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এজন্য দশটি অক্সিজেন সিলিন্ডারও সংগ্রহ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত