মহাত্মা গান্ধী সমাজে অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। তিনি ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করার পরামর্শ দিয়েছেন। গান্ধীজীর মত মানলে, কেউ যদি ডান গালে চড় মারে তাহলে বাম গাল পেতে দিবে। এর ফলে এক সময় তার ক্রোধ কমে আসবে। সে আর মারমুখী হবে না। পক্ষান্তরে কেউ যদি মারের বদলে মার দিতে চায়, তাহলে মারামারি চলতেই থাকবে। উভয়ের মধ্যে হিংসা সঞ্চারিত হবে। এই হিংসা প্রতিশোধস্পৃহা বাড়িয়ে দেবে। মারামারি-খুনোখুনির মাধ্যমে এর পরিণতি নির্ধারণ হবে। তবে তাতেও মারামারি-খুনোখুনি শেষ হবে না। যে মার খাবে, পরাজিত হবে, সে আবার শক্তিসঞ্চয় করে প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এটা চলতেই থাকবে।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে গান্ধীজী খুব একটা পছন্দ করেননি। কারণ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিপ্লব করতে হয়। বিপ্লবে রক্তপাতের প্রয়োজন হয়। শ্রেণিশত্রু ‘খতম’ করে মেহনতি মানুষের শাসন কায়েম করতে হয়। এখানেই গান্ধীজীর প্রবল আপত্তি। তিনি বিপ্লব, রক্তপাত, খুন, খতম— এসব ভীষণ অপছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। হিংসা কেবলই হিংসার জন্ম দেয়। পুঁজিপতি বা বড়লোক বা শোষকদের প্রতি হিংসাপ্রবণ হয়ে মেহনতি মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা কখনও সফল হতে পারে না। কারণ বড়লোকরাও মানুষ। তাদের খতম করার অভিপ্রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে স্থায়ী হিংসার বীজ বপন করা হয়। বড়লোকের আত্মীয়-স্বজন বংশধররা প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে থাকে। সুযোগ পেলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবে সমাজে হানাহানি-মারামারি ক্রনিক চলতেই থাকে। এর বদলে গান্ধীজী চেয়েছেন অহিংস নীতি প্রতিষ্ঠা করতে। অহিংসা এবং পারস্পরিক ভালোবাসার মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক সাম্যের সমাজ গড়তে!
গান্ধীজী ভারতবর্ষসহ দুনিয়াজুড়ে পূজনীয় হলেও তাঁর মত তেমন কেউ গ্রহণ করেননি। সারাজীবন অহিংসার বাণী প্রচার করলেও তিনি নিজে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। অর্থাৎ হিংসার বলি হয়েছেন! দুনিয়ার মানুষগুলো বড়ই বিচিত্র। কে যে কার বাণী গ্রহণ করবেন, আর কী আচরণ করবেন তা আগেভাগে ঠাহর করা যায় না। তবে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ গান্ধীজীর মতের বিপরীতটাকেই পছন্দ করেছেন বেশি। অহিংসা নয়, হিংসাকেই বেছে নিয়েছেন জীবনের আদর্শ হিসেবে। প্রেম-ভালোবাসা নয়, হিংসা, হানাহানি-মারামারি, গালাগাল প্রতিশোধ— এগুলোই হচ্ছে এখন মানবজাতির একমাত্র সাধনা।
একজন যদি একটা গালি দেয়, অপরজন কমপক্ষে তিনটে গালি দিয়ে তার প্রতিশোধ নিতে চায়। কাউকে আপনি থাপ্পড় দিলে সে কয়েক ঘা থাপ্পড় কিল-ঘুষিসহ ফিরিয়ে দেওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করে। আমরা সবাই যেন গোলের খেলায় মেতেছি! গোল হলে যেকোনো মূল্যে তা পরিশোধ করতে হবে। এক গোল খেলে পাঁচ গোল দিয়ে প্রতিশোধ নিতে হবে।
আমরা সব সময় অন্যকে গালি দিই। সমালোচনা করি। কিন্তু আমরা কি খুব ভালো? চলতে চলতে সহসা কেউ আমাদের পা খুব বিচ্ছিরিভাবে মাড়িয়ে দিলে, আমরা কি ফিরে এসে ওই লোকটার পা-টাও ওই রকমই জঘন্যভাবে মাড়িয়ে দিতে চাই না? আমরা কি বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে ঝগড়ায় গসিপে গল্পে লাখ লাখ বার বলি না, ‘ওকে উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার’।
আওয়ামী লীগরা বিএনপিওয়ালাদের, বিএনপিওয়ালারা আওয়ামী লীগারদের, বামপন্থীওয়ালার জামায়াতিদের, জামায়াতিরা আওয়ামী-বামপন্থীওয়ালাদের কি এই থিয়োরিতেই মোকাবিলা করে না? আমার অপছন্দের কেউ যখন চরম বর্বরতার শিকার হন, তখন কি আমাদের মধ্যে ‘বেশ হয়েছে, দ্যাখ কেমন লাগে’ বোধ জেগে উঠে না?
আমরা অনেক ভেবেচিন্তেই প্রবাদ বানিয়েছি— ‘ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়’, ‘মারের বদলা মার!’
হ্যাঁ, বড় বড় মানুষেরা অন্য রকম কথা বলে গেছেন। বড় বড় মানুষরা অবশ্য জন্মেছেনই কোটেশন সাপ্লাই দেওয়ার জন্য! যখনই তাঁরা বুঝে যান, ক্যালেন্ডারে তাঁদের ছবি সাঁটা হবে, তখনই তাঁদের ভেতর থেকে কিছু আজগুবি, অধুনালুপ্ত যাত্রাদলের বিবেকের মুখ নিঃসৃত বাণীর মতো ক্লিশেক্লিষ্ট বাক্য তরতর করে বেরিয়ে আসে।
গান্ধীজী বলে গেছেন: ‘একটা চোখের বদলে আর একটা চোখ’— এই নীতিতে চললে পৃথিবীতে সবাই অন্ধ হয়ে যাবে। আর মহামান্য যিশুখ্রিস্ট তো অন্যের পাপ ঘাড়ে নিয়ে নিজে ক্রুশে চড়ে বসেছিলেন। বোকার হদ্দ না হলে কেউ এমন আহাম্মুকি করে!
গুগলে সার্চ দিলে সেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, এমনকি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের গুচ্ছের ফুল-তোলা গ্রিটিংস কার্ড মার্কা ভুরি ভুরি বাণী পাওয়া যাবে। যার মূল কথা হলো, যে অন্যায় করেছে, তাকেও বুঝতে চেষ্টা করো। বোঝাতে চেষ্টা করো। তার প্রতি অন্যায় কোরো না। আর এই লোকগুলোর ছবি ঘরে টাঙিয়ে বা মূর্তি উন্মোচন করে যারা রাজনীতির মঞ্চ আলো করে বসে আছেন, তারা কী বিশ্বাস করছে?
মুখে ‘গণতন্ত্র’, ‘আইনের শাসন’, ‘নিয়মতান্ত্রিকতা’র কথা বললেও বাস্তবে কে কার নাকের হাড্ডি ভেঙে দিতে পারে, হাসপাতাল-চিতা কিংবা কবরে পাঠাতে পারে তারই কসরত চালানো হচ্ছে। এক পক্ষ বলছে, ওরা আমাদের দলের এতগুলো লোককে খুন করেছে, আর আমরা বসে বসে আঙ্গুল চুষব? আমরা সুযোগ পেলে ওদের ডবল লোককে খুন করব। কেউ কেউ তো টক-শোতে গিয়ে অবধি বলছে, সব অ্যাকশনের সমান ও উল্টো রি-অ্যাকশন থাকে। আমাদের কর্মীদের কে ঠেকাবে? ওরা তো আর মহাপুরুষ নয়।
‘মহাপুরুষ’ কথাটা ব্যঙ্গ করতে ব্যবহার হয়! আমাদের দেশে নিরেট মূর্খ যে, পৃথিবীর কোনও বিষয়ে কোনও জ্ঞান না থাকলেও নিউটনের তৃতীয় সূত্র বোঝে! নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা সাংঘাতিক কাজে লাগে নিজের পাঁঠামি সাপোর্ট করতে। সাধারণ মানুষও সমাজের ঝোঁক বুঝে গেছে। তারাও এখন ‘ন্যায়’ বা ‘জাস্টিস’ বলতে বোঝে থাপ্পড়ের বদলে বেধড়ক পিটুনিকেই।
আমরা বর্তমানে শিক্ষা নিতে নয়, অন্যকে শিক্ষা, বিশেষ করে উচিত শিক্ষা দিতে মুখিয়ে থাকছি। দৈনন্দিন প্রতিটি মুহূর্তে বেশিরভাগ মানুষ অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে দাঁত কিড়মিড় করছে। এক মেয়ের ‘মন’ পায়নি বলে এক ‘বীরপুরুষ’ পুরো বাড়িশুদ্ধ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে আমাদের দেশেই! একজনকে জানি, যে মানুষটা রূঢ় দোকানির সঙ্গে সমান দুর্ব্যবহার করতে পারেনি, সে-ও মনে মনে ছ’মাস গুমরোচ্ছে, কেন মোক্ষম খিস্তি আউরে ব্যাটার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিতে পারল না? এমনকি আড্ডায় কাউকে নিয়ে ইয়ার্কি হলে, সে ওত পেতে থাকছে, কখন দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে পারবে। সবাই এখন প্রতিশোধ আর পাল্টা জবাবে বিশ্বাসী।
মারের বদলে মার, খুনের বদলা খুন— এগুলো খুব সর্বনাশা আদর্শ। আমরা এমন আদর্শের চর্চা চাই না। আমরা বরং গালির বদলে গালি, একটা খারাপ কথার বদলে দশটা নোংরা কথা—এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই!
তবে সমস্যা হয়েছে কবি কুসুমকুমারী দাশের সেই কবিতা। ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় কবি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে? কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে…!’ এই কবিতাকে অনেকে এখন জীবনাদর্শ হিসেবে মানছেন। হুমকি নয়, রীতিমত খুন করে নিজেকে ‘কাজের কাজি’ প্রমাণ করছেন। আমরা আসলে এখন এমন সর্বনেশে কবিতা চাই না। আমরা ‘কথা’তেই বড় হতে চাই, কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। ‘কাজে’ বড় হতে গেলে আমরা যদি খুনি এবং হিংস্র হয়ে যাই, তাহলে যে এ দেশটা যে লাশের দেশে পরিণত হবে!
নিশ্চয়ই আমরা কেউই তা চাই না!
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: chiros234@gmail.com