এই কথা ‘১৯৮৬ সালের’। ঢাকার পথে রওনা করতে বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে বসেছিলেন মনজুরুল হক। কেউ একজন গমগম করা গলায় বলে উঠলেন, “বসতে পারি?”
সকাল সন্ধ্যার কাছে লেখক মনজুরুল হক বললেন, “বসতে পারি কথাটা সাধারণত আমাদের এখানে কেউ এভাবে বলে না। সরাসরি বসে পড়ে।
“উনি যখন ভরাট কণ্ঠে বললেন, আমি তাকালাম। দেখলাম লম্বা মতো একটা মানুষ। নিশ্চয়ই বসতে পারেন, বলে আমি সরে গেলাম। ”
আহমেদ রাজিব রুবেলের সঙ্গে এমন ‘অকস্মাৎ’ পরিচয় হয়েছিল মনজুরুল হকের।
“তখন তো তিনি টিভি নাটকে আসেননি। মঞ্চেও নিয়মিত না। তারও সম্ভবত পায়ের নিচে মাটি নেই। আর আমিও জীবিকার সন্ধানে ঢাকা আসছিলাম। যশোরে হয়তো কোনো কাজে গিয়ে ফিরছিলেন ঢাকা।
“আমাকে বললেন, এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। কাজ শেষ। ঢাকা যাবো; কখন যে যাই!”
মনজুরুল হক নিজেই তখন প্রস্তাব রাখেন, “চলুন তাহলে এক সঙ্গে যাই।”
ফেরি পারাপার মিলিয়ে আট-দশ ঘন্টার রাতের যাত্রাপথ ছিল। এই সময়ে দুজনের অনেক কথা হলো।
“বাসের ওঠার পরে জিগেষ করলেন, আপনি কী পারেন? আমি বললাম, অভিনয়-টভিনয় একটু করেছিলাম। সাংস্কৃতিক লাইনের লোক। এ ধরনের লোকের তো বোধহয় চাকরি হওয়ার সুযোগ নেই। কেরানিগিরি করব।”
“শুনে আহমেদ রুবেল বললেন, আপনি কি এই লাইনে কিছু করতে চান? তাহলে আমি আপনাকে হেল্প করতে পারব।”
তখনই মনজুরুল হক জানলেন আহমেদ রুবেল মঞ্চের মানুষ।
ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে সকাল সাতটার দিকে নামলেন তারা দুজন। সেসময় মোবাইল ফোনের চল নেই; তাই আবার দেখা হওয়ার খানিক অনিশ্চয়তা নিয়েই বিদায় পর্ব সারলেন দুজনে।
কিন্তু এর কয়েক বছর পরে ‘আহমেদ রুবেলের নাটক আছে জেনেই’ শিল্পকলা একাডেমিতে দেখতে গেলেন মনজুরুল হক।
“এটা হয়ত ৯০ কি ৯১ সালের কথা। নাটক শেষে বার হওয়ার পর আমি তাকে দেখে ডাক দেই। ঘুরে আমাকে চিনতে পেরেই জড়িয়ে ধরেন। দুজন বসে চা খেলাম। অনেক কথা হলো।”
তারপর আবার অনেকদিন পর দুজনের দেখা বিটিভির এক অনুষ্ঠানে; দুজনেই আমন্ত্রিত ছিলেন।
২০২০ সাল কি ২০২১ সালে বইমেলাতে চতুর্থবারের মতো দেখা হলো আহমেদ রুবেল আর মনজুরুল হকের।
এই লেখক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার একটা বই বেরিয়েছিল স্তালিনকে নিয়ে।বইটা তাকে গিফট করলাম। এরপর দর্শন ও বোঝাবুঝির জায়গা থেকে আমাদের মধ্যে নতুন একটা সম্পর্ক হলো সেদিন।
“উনি বললেন, তাহলে আপনি তো কেরানিগিরি করে খাবেন সেই জায়গাতে আর নেই। আমি বললাম, সে জায়গাতেই আছি।লেখালেখি একটা প্যাশন ছিল, সেটা চালিয়ে যাচ্ছি।”
এই দুজনের ওটাই ছিল শেষ দেখা।
অভিনয় জগত নিয়ে খুব আগ্রহ না থাকলেও আহমেদ রুবেলের মঞ্চ নাটক দেখেছেন বলে জানালেন মনজুরুল হক।
“প্রেত নাটকের কথাও মনে আছে। আমার মতে তাকে আমি গরীবের নাসিরুদ্দিন শাহ- ওই জায়গাটায় রাখতে পারি। কারণ ক্যামেরার দিকে তাকালে ক্যামেরার পেছনের লোকটিকে দেখে ফেলা এই অন্তর্দৃষ্টিটা তার মধ্যে দেখেছিলাম।”
হুমায়ুন ফরিদীর ভক্ত ছিলেন আহমেদ রুবেল
নোঙর ট্রাস্টের সভাপতি সুমন শামস মোহিত হয়েছিলেন আহমেদ রুবেলের কণ্ঠে।
প্রয়াত এই অভিনয়শিল্পী ‘পরিবারের একজন বড় ভাইয়ের মতো’ ছিলেন জানিয়ে সুমন শামস সকাল সন্ধ্যাকে বললেন, “তার যে কণ্ঠ, তার যে আবৃত্তি! আমি তো অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম তার আবৃত্তি শুনে, কণ্ঠ শুনে। তার হাসিটা মুখে লেগে আছে।”
এই অভিনেতার সঙ্গে সুমন শামসের পরিচয় হয়েছিল ‘২০০২ সাল কি ২০০৩ সালের দিকে’।
“ঢাকা থিয়েটারে নাট্যকার সেলিম আল দীনের মুনতাসির ফ্যান্টাসি বলে একটা নাটক হতো। আমি একুশে টিভির বাউলিয়ানা নামে একটা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই একই সেটে তাদের রেকর্ডিং ছিল। সবাই বলছিল, রুবেল আসবে রুবেল আসবে; ভয়েস দেবে। আমিও অপেক্ষা করছি যে কী হয়।”
প্রথম দেখায় কেমন লাগলো আহমেদ রাজিব রুবেলকে?
“আমার মনে হলো অদ্ভুত একটা মানুষ! এরকম মানুষ আমি কম দেখেছি। তিনি ফ্লোরে এলেন। তাকে সংলাপ বুঝিয়ে দেওয়া হলো। তিনি যখন ভয়েস দিচ্ছিলেন আমি আরও বেশি অভিভূত হয়ে গেলাম। ‘বল কেন ডেকেছিস আমায়’ – এমন ভাবে তিনি বললেন আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। উনার সঙ্গে পরিচয় হলো। উনি জড়িয়ে ধরলেন। এই যে জড়িয়ে ধরা … ওই সম্পর্কটা তার সঙ্গে আমার শেষ দিন পর্যন্ত ছিল।”
নির্মাতা নার্গিস আক্তারের পৌষ মাসের পিরিত সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৬ সালে। এতে অভিনয় করেছিলেন আহমেদ রুবেল। সঙ্গে আরও ছিলেন পপি, টনি ডায়েস।
সিনেমার শুটিং চলাকালে যশোরের খাজুরা এলাকায় ছিল পুরো টিম।
“ওখানে প্রচুর খেজুর গাছ। সিনেমায় রুবেল ভাই হলেন একজন গাছি। আমরা এক মাস এক সঙ্গে ছিল। আমার কাজ ছিল পুরো ফিল্মের অডিও নেওয়া। রুবেল ভাইয়ের ভয়েসের যে প্রোজেকশন তাতে একবারেই ওকে হয়ে যেত। বাকি কারও বেলায় তা হতো না।”
এরপর সুমন শামসের নির্দেশনাতেও কাজ করেছিলেন আহমেদ রুবেল।
“ইমপ্রেস চ্যানেল আই থেকে আমাকে সাইখ সিরাজ ভাই ডাকলেন ছবি বানাতে। আমি আনিসুল হকের ‘ফিরে এসো, সুন্দরীতমা’ গল্পটা থেকে টেলিফিল্মের কাজ শুরু করলাম রুবেল ভাইকে নিয়ে। রুবেল ভাই চমৎকার ভাবে স্ক্রিপ্ট মার্ক করত। পুরো গল্পটা পড়ে তিনি ভাগ করতেন কোথায় কী কীভাবে করবেন।”
এই অভিনেতার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সুমন শামস বলেন, “অনেকের অভিযোগ ছিল রুবেল ভাইকে নিলে তিনি ফ্লোরে সময় মতো আসেন না।
“আমার একটা দৃশ্যের জন্য বললাম, রুবেল ভাই সাতটায় সূর্যটা ওঠার সময় দৃশ্যটা ধারণ করতে চাই। উনি বললেন সাতটা সময় চলে আসবো। আমি সাতটার আগে স্পটে ছিলাম। গিয়ে দেখি আমার আগেই রুবেল ভাই স্পটে হাজির ছিলেন।”
সুমন শামসের চোখে ব্যক্তি আহমেদ রুবেল কেমন ছিল?
“গাজীপুরে আমাকে তার বাসা নিয়ে গিয়েছিলেন, ছায়াবীথিতে। তার বাবা একজন প্রফেসর। বাসায় রুমে ঢুকে আমি আরও আশ্চর্য। চারদিকে দেওয়ালে বইয়ের লাইব্রেরি। পুরো ঘরটাই লাইব্রেরি।”
“তার ভেতরে অনেক কষ্ট জমা ছিল। কষ্ট দিয়েছেও অনেকে। যদিও তিনি তা প্রকাশ করতেন না। আমি তাকে স্পিরিচুয়াল মানুষ মনে করি।”
আফসোস জানিয়ে সুমন শামস বললেন, “এতো বেশি প্রতিভা এতো বেশি পাওয়ারফুল অভিনেতা ছিলেন রুবেল ভাই। এই মানুষটাকে আমরা ব্যবহার করতে পারিনি।”
কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী মারা গিয়েছিলেন এক যুগ আগে; এই ফেব্রুয়ারি মাসেই। আহমেদ রুবেল ‘ভীষণ ভক্ত’ ছিলেন এই অভিনেতার, বললেন সুমন শামস।
“তিনি হুমায়ুন ফরিদীকে ধারণ করেছিলেন। এখনকার প্রজন্মের যারা আছে, তারা যদি আহমেদ রুবেলকে ধারণ করে তাহলে কিছু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।”
হলুদ জামা গায়ে কবুতর হাতে রুবেল যখন পর্দায়
৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর স্টার সিনেপ্লেক্সে ছিল নুরুল আলম আতিক পরিচালিত পেয়ারার সুবাস সিনেমার প্রদর্শনী। আহমেদ রুবেল ওই সিনেমায় অভিনয় করেছেন। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সন্ধ্যায় পৌঁছে গাড়ি থেকে নামার একটু পর পড়ে যান তিনি। তারপর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা জানায়, তিনি মারা গেছেন।
পরিচালক নুরুল আলম আতিক ওই সময় হাসপাতালেই ছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে প্রদর্শনী স্থগিত না করে স্ক্রিনে দেখানো হয় পেয়ারার সুবাস।
আহমেদ রুবেলের হঠাৎ প্রয়াণের পর চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী বন্ধ না করে চালানোর মতো বড় শ্রদ্ধা আর কী হতে পারে! এই উপলব্ধির কথা সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন চিত্রসমালোচক ও সাংবাদিক বিধান রিবেরু।
তিনি বলেন, “গতকাল যদি শো বন্ধ হতো তাহলে আমি মনে করতাম যে আট-দশটা মানুষ যেভাবে চিন্তা করে পরিচালকও সেভাবে চিন্তা করেছেন। নুরুল আলম আতিক একজন শিল্পীর মতই চিন্তা করেছেন এবং যথাযথ সম্মান দিয়েছেন আহমেদ রুবেলকে।
“আমরা আহমেদ রুবেলকে তো আমরা পর্দার মাধ্যমেই চিনি। কাজেই পর্দার মাধ্যমেই তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমি স্যালুট করি আতিককে। আমার মনে হয় একজন পরিচালকের এর থেকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব আর হতে পারে না।”
তবে ওই পরিস্থতিতে প্রদর্শনী দেখানোর মতো সিদ্ধান্ত নেওয়াও খুব সহজ ছিল না কারও জন্য।
প্রদর্শনীর দিন সেখানে ছিলেন জানিয়ে বিধান রিবেরু বলেন, “দুটো প্রযোজনা সংস্থা আলফা-আই এবং চরকির কর্ণধাররা সেখানে ছিলেন। যিনি মারা গেছেন তিনি এই ছবিরই শিল্পী। তাই ছবিটার প্রদর্শনী হবে কি হবে না নিয়ে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল।
“নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাই যোগাযোগ করেন আতিক ভাইয়ের সাথে। আতিক ভাই বলেন, প্রদর্শনী হবে। আতিক ভাই তখন হাসপাতালে; ততক্ষণে আহমেদ রুবেল মারা গেছেন।”
“শিল্পসাহিত্য চর্চা যারা করেন তাদের কাজের ধারা, প্রাণপাত করে কাজ করা, আত্মোৎসর্গ করে কাজ করার যে মানসিকতা থাকে শিল্পের প্রতি … তা আর আট-দশটা মানুষ বুঝতে পারবে না।”
খানিক আগে মারা যাওয়া অভিনেতা আহমেদ রুবেলকে সেই সন্ধ্যায় পর্দায় দেখার সময় চারিদিকে ‘হাহাকারের গুঞ্জন’ উঠেছিল।
“এটা এক ধরনের পরাবাস্তব ব্যাপার। এই মানুষটার এখানে থাকার কথা ছিল। এতো অনিশ্চিত জীবন; একমাত্র কাজই নিশ্চিতভাবে জীবনদান করে। মৃত্যুর পরেও উনাকে কাজে দেখছি, আমি মনে করি উনার জীবনটা স্বার্থক।”
“মারা যাওয়ার এক ঘণ্টা পরে তাকে স্ক্রিনে দেখছি; খারাপ লাগা তো ছিলই আবার ভেবেছি শিল্পীর এভাবে বেঁচে থাকা ভীষণ রকম গৌরবের। আমি সত্যি সত্যি সেই গৌরব অনুভব করতে পেরেছি। সবাই তো তাকে নিয়ে কথা বলছে। এটা তো বিশাল ব্যাপার। এই ভালোবাসা পাওয়া তো সবার হয় না।”
সেদিন প্রদর্শনী একাধারে অভ্যাগতদের প্রতিও পরিচালকের সম্মান প্রদর্শন ছিল বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক মানস চৌধুরী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখানে কয়েকশ লোক ছিল। উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে ফ্রেমওয়ার্কটা সহজ ছিল না কোনোভাবেই।
“এই কালচারাল প্রডাক্টটা যদি ছায়াছবি না হয়ে বই হতো তাহলে কারও কোনো সংশয় হতো না। যে কোনো একজন লেখকের বই ছাপাখানা থেকে এলো, এবং লেখক তখন নেই। আমাদের কারও কখনও মনে হতো না আমরা বইগুলো পোটলা করে রেখে দেই।”
“আয়োজকদের এক পক্ষ গুরুত্ব দিয়েছেন অভ্যাগতদের। তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এতো রকমের বিভ্রান্তি আর বিমূঢ়তার মধ্যেও একটা রাস্তা বার করেছেন। এটা জেসচার টুওয়ার্ডস অডিয়েন্স। এই পরিস্থিতি আসলে পরিকল্পনা করে আগানোর মতো কাজ না।”
স্ক্রিনে পেয়ারার সুবাসের আহমেদ রুবেলকে কেমন দেখলেন?
প্রশংসা করে মানস চৌধুরী বলেন, “রুবেল স্ক্রিনে আসেন ইন্টারভেলের পর। হলদে রঙের জামা পরে। হাতে কবুতর থাকে … উনার এনট্র্যান্স খুবই সিনেমাটিক ছিল। উনার কণ্ঠস্বর এতো সুন্দর, উনার চেহারা এতো তীক্ষ্ণ …!”
সহজসরল রুবেল আংকেল
আহমেদ রুবেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে ‘খুব শকড’ হয়েছিলেন বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন অভিনেত্রী লাবণ্য চৌধুরী।
“আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। আমার হাত কাঁপছিল খুব। ফেইসবুকে একের পর এক পোস্ট দেখতে থাকি। তখনও আমার খুব অবাস্তব লাগছিল। তার সঙ্গে কিছুদিন আগেও শুট করেছি আগুনের পাখি সিনেমায়।আমাদের দুইটা লটে শুট ছিল। আমরা সবাই খুব মজা করেছি।”
প্রসূন রহমান পরিচালিত প্রিয় সত্যজিৎ সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে ‘রুবেল আংকেলের’ সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল লাবণ্য চৌধুরীর।
এখন এসব মনে করে ‘কষ্ট লাগছে’ জানিয়ে এই তরুণ অভিনেত্রী বলেন, “উনি খুবই গুণী একজন মানুষ। আমাদের সবাইকেই খুব হেল্প করেন। এভাবে দাঁড়াও, এভাবে বলবে, স্ক্রিনে ভালো লাগবে। রাতে আমরা বসে সবাই গল্প করতাম। আমার জন্য স্মৃতিময়।”
আহমেদ রুবেলের বাড়িতে পায়েস খাওয়ার কথাও এখন মনে পড়ছে জানিয়ে লাবণ্য চৌধুরী বলেন, “একদিন প্রথম লটের শুটিং শেষ হয়। আমরা আংকেলকে ড্রপ করার জন্য উনার বাসায় যাই। তখন আমি আর আমার সঙ্গে একজন ছিলেন …আমাদের ওয়াশরুমে যেতে হতো।
“উনি নিজেই বলেন আপনারা আমার বাসায় আসুন। উনি বারবার বলেন ভালো ভাবে হাতমুখে ধুয়ে নেন। যেহেতু আপনাদের আরও জার্নি বাকি আছে। উনার বাসায় পায়েস খেলাম। উনার বাবার সঙ্গে পরিচয় হলো। এতো বড় একজন আর্টিস্ট কিন্তু এতো সহজসরল লেগেছিল উনাকে।”
আড্ডার মধ্যমণি আহমেদ রুবেল
চিত্রনির্মাতা রেজা ঘটকের সঙ্গে ‘বড় ভাই-ছোট ভাই’ সম্পর্ক ছিল আহমেদ রুবেলের। সেই ‘রুবেল ভাইকে’ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে শেষ বিদায় জানাতে হলো তাকে।
তরুণ বয়স থেকে আহমেদ রুবেলের সঙ্গে পরিচয়ের কথা মনে করে রেজা ঘটক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে উনি অমায়িক ছিলেন। শুটিং নিয়ে গল্প শোনাতেন আমাদের। আমাদের খুব আদর করতেন। রুবেল ভাই এলেই আড্ডার মধ্যমণি হতেন।”
সুমন শামসের মতো রেজা ঘটকের কাছেও মনে হয়, “উনি যে মেধা, যে সামর্থ্য রাখতেন তা পুরোপুরি দেখানোর সুযোগ হয়নি।
“আবার উনি অনেক বাছবিচার করতেন। আর যেটা পছন্দ করতেন ওই চরিত্রে নিজেকে ঢেলে দিতেন। আর্টিস্ট বলতে যা বোঝায় রুবেল ভাই তাই ছিলেন।”
এখনও ঘোর কাটেনি
আহমেদ রুবেল যখন টেলিভিশনে নিয়মিত কাজ শুরু করেন, তখন ‘আমারও কাজ শুরু’; সকাল সন্ধ্যাকে এ কথা জানালেন নির্মাতা নুরুল আলম আতিক।
“কাজের ধরন আর চিন্তার কারণে আমাদের বন্ধুত্ব হলো। রুবেল ভাই আমার কাছে নির্ভরতার জায়গা।”
নুরুল আলম আতিক পরিচালিত লাল মোরগের ঝুঁটি ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছিল। আর এ বছর মুক্তি পেল পেয়ারার সুবাস। যদিও এই দুটি সিনেমার শুটিং প্রায় একই বছরে শুরু হয়েছিল। পেয়ারার সুবাস এখন মুক্তি পেলেও এর শুটিংয়ের কাজ বরং আগেই শেষ হয়েছিল। সেই অর্থে লাল মোরগের ঝুঁটির শুটিং ছিল আহমেদ রুবেলের সঙ্গে আতিকের শেষ কাজ।
প্রয়াত অভিনয়শিল্পী আহমেদ রুবেলকে একেকটি চরিত্রের জন্য নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করতে দেখেছেন নির্মাতা নুরুল আলম আতিক?
“আমার সঙ্গে ছাড়াও তো উনি অসংখ্য পরিচালকের কাজ করেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে চরিত্র বুঝে নিয়ে পরে উনি নিজের মত প্রস্তুতি নিতেন। উনার অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বর কিংবা চরিত্র হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া … একে তো উনার দরাজ কণ্ঠ, বিশেষ শারীরিক অবয়ব, পৌরুষদীপ্ত চেহারা …।”
“লাল মোরগের ঝুঁটিতে বাবা চরিত্রে কাজ করেছিলেন। আর পেয়ারার সুবাসে প্রেমিকের চরিত্র। প্রেমিকার জন্য বলিদান দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি হাজির হন।”
“উনি অদ্ভুত নরম মনের মানুষ ছিলেন। শিশুর মত কৌতুহলী মন ছিল। আর্টিস্ট হওয়ার জন্য এটা জরুরিও। নিজের মধ্যে অন্য চরিত্রকে ধারণে লৌকিক আর অলৌকিকের মাঝামাঝি একটা জায়গায় অবস্থান করা।”
পেয়ারার সুবাস সিনেমার প্রদর্শনীর সন্ধায় মারা যান একাধারে মঞ্চ, টেলিভিশন আর চলচ্চিত্রে দাপটে অভিনয় করা আহমেদ রুবেল। পরে তাকেই উৎসর্গ করা হয় এই সিনেমা।
এই সিনেমার পরিচালক নুরুল আলম আতিক বলেন, “উৎসর্গ করা … এটা খুবই তাৎক্ষণিক। আমার এখনও এই ঘোর কাটেনি।
“অনেক অভিমান হতো তার। কিন্তু কোনো অভিযোগ করতেন না। আমার জন্য তো বড় ক্ষতি; বন্ধু হারানো। আবার কাজের দিক থেকেও। ”
আহমেদ রুবেলের চলে যাওয়া মানে সিনেমা জগতের বড় ক্ষতি।
একজন বলিষ্ঠ অভিনেতার গত হওয়ার শোকে কাতর এই পরিচালক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উনাকে নিয়ে কিছু রটনা আছে; রুবেল ভাই অনেক ডিফিকাল্ট …শুটিংয়ে আসবেন তো! অথচ আমার শুটিংয়ে কোনোদিন অনুপস্থিত থেকেছেন এমন তো এতো বছরে দেখিনি।
“আসলে সিনেমা চরিত্রায়নের জায়গাটা সীমিত হয়ে গেলো। ইন্ডাস্ট্রির জন্য বড় লস। একজন রুবেল তো আর হুট করে চলে আসেন না। কিন্তু উনি থাকতে এটা আমরা টের পাইনি। এখন আফসোস করে কী লাভ!”