Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

‘সবাই পরীক্ষা দিয়েছে, কেবল আমার ছেলের জায়গাটাই ফাঁকা’

ahnaf 4
[publishpress_authors_box]

হয়তো খালিই পড়ে থাকতো জায়গাটা, তা ঠিক মানতে পারছিলেন না শিক্ষক আর বন্ধুরা। তাই ফাঁকা আসনটিতে রেখেছিলেন একটি ফুলের তোড়া। তার ওপরে লিখেছিলেন শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের নাম।

রবিবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে বিএএফ শাহীন কলেজে একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার হলের দৃশ্য এটি। এখানে বসেই পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল আহনাফের।

কিন্তু ছাত্রজনতার আন্দোলনের সময় গত ৪ আগস্ট ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে নিহত হন আহনাফ। একটি গুলি তার বুকের ডান দিক দিয়ে ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়।

বিএএফ শাহীন কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে পড়তেন আহনাফ। রবিবার দুপুরের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া পরীক্ষার হলের ছবিটি কলেজের এক শিক্ষক তুলেছেন বলে জানান আহনাফের বাবা নাসির উদ্দিন।

তিনি বলেন, “ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হলে সবসময় আন্দোলনের পক্ষে কথা বলতো সে। ৪ তারিখ দুপুরে বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর ১০ নম্বরে চলে যায় আহনাফ। এরপর তার খোঁজ মেলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে।”

গণমাধ্যমের খবরে নাসির উদ্দিন জানতে পারেন সেদিন প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা শতাধিক। “সবার কাছে আহনাফ ওই ১০০ জনের একজন। কিন্তু আমাদের কাছে তো কলিজার টুকরা।”

জীবনে বড় কিছু হতে চেয়েছিলেন আহনাফ, চেয়েছিলেন এমন কিছু হতে যেন সবাই তার নাম জানে। নাসির উদ্দিন বলেন, “এখন অনেক মানুষ আহনাফের নাম জানে, তার বাবা-মা হিসেবেই আমাদের চিনে। কিন্তু আমরাতো এভাবে পরিচিত হতে চাইনি। এমন গর্ব আমি চাইনি, পৃথিবীর কোনও বাবা-মা চায় না।”

গিটার বাজাতে খুব পছন্দ করতেন আহনাফ, ভালোবাসতেন গান করতেও। নিজে নিজে সুর করারও চেষ্টা করতেন। প্রিয় গিটারে কাউকে হাতও দিতে দিতেন না। আর এখন পড়ে থাকা গিটার ছুঁয়ে ছেলেকে অনুভব করেন সন্তানহারা এই দম্পতি।

সেদিনও দুপুরে ছেলেকে নিজ হাতেই খাইয়ে দিয়েছিলেন মা জারতাজ পারভীন সাফাক। বারবার নিষেধ করছিলেন বাইরে যেতে। কিন্তু প্রতিবারই মাকে আস্বস্ত করে আহনাফ বলেছে, কিচ্ছু হবে না, চিন্তা করো না।

জারতাজ পারভীন সাফাক বলেন, “সেদিন তিনটার দিকে রেডি হচ্ছে। আমার নিষেধ শুনে শুধু হাসলো, কিছু বললো না।

“একসময় ট্রাউজার আর ফুটবল ক্লাবের জার্সি পরে বললো, নিচে কিছু বন্ধু এসেছে, দেখা করতে যাবে। এমনকি আমি সঙ্গেও যেতে চাইলাম।”

‘চিন্তা করো না, চলে আসব’ বারবার ছেলের বলা এমন বাক্যও দুশ্চিন্তা কমাতে পারেনি মায়ের। প্রায় ৩০ মিনিট পরে উদ্বিগ্ন মা জানতে পারেন ছেলে ৬০ ফিটের ওখানে। এরপর শেষ কথা হয় পৌনে পাঁচটার দিকে। তখনই মা বুঝতে পারেন ছেলে যাচ্ছে মিরপুর ১০ এর দিকে।

বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে ছেলের নাম্বারে আবার ফোন করলেও ছেলেকে আর পাননি এই মা। এরপর পুরো এলাকায় খুঁজে বেড়ান ছেলেকে। রাতের দিকে একজন ফোন করে বলে ইসলামিয়া হাসপাতালে যেতে। সেখানে গিয়েও হতাশ হন তারা।

তারপর কুর্মিটোলা আর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে খোঁজেন। অবশেষে সোহরাওয়ার্দীতে পান ছেলের নিথর দেহ।

“আজ ওর পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। সবাই পরীক্ষা দিল, আমার ছেলের জায়গাটাই ফাঁকা ছিল। আমার ছেলেটা ক্লাসে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ফুল হয়ে।”কান্নাভেজা কণ্ঠে এটুকুই বলতে পারেন আহনাফের মা।

১৩ অক্টোবর আহনাফের জন্মদিন, একই দিনে জন্মেছিলেন তার মা। নাসির উদ্দিন বলেন, “মা-ছেলে একটা কেক কাটতো। মায়ের সঙ্গে সবসময় লেপ্টে থাকত। এখন তার মাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না।

“একই অবস্থা তার ছোট ভাইয়েরও। সেও মানতে পারছে না। বড় ভাইয়ের বড় বড় টিশার্ট, প্যান্ট পরে থাকছে। খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ।”

ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া পরীক্ষার হলের ছবিটি তুলেছেন বিএএফ শাহীন কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের প্রভাষক বোরহান উদ্দিন।

কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকায় এমনিতেই সবাই সবাইকে চিনে জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আর আহনাফ গান করতো, খেলাধুলা করতো, কলেজের সবকিছুতে তার অংশগ্রহণ ছিল। তাই  শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার কাছে সে ছিল খুবই পরিচিত মুখ।”

একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা এর আগে তিনটি পরীক্ষা দিয়েছে। গণআন্দোলনের ‍মুখে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট। তারপর এটিই ছিল প্রথম পরীক্ষা। কিন্তু সেই আন্দোলন কেড়ে নিয়েছে আহনাফকে।

তাই প্রথম দিনে শিক্ষক ও বন্ধুরা তাকে স্মরণ করতে চেয়েছেন বলে জানান বোরহান উদ্দিন। তিনি বলেন, “ওর সিটটা ফাঁকা রাখতে চাচ্ছিলাম না, তাই ফুল রেখেছি। পরীক্ষা শুরুর আগে ওর কথা ভেবে সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষক কেঁদেছে।”

আসলে ও এমন একটা ছেলে যে, ওর জন্য আপনাকে কাঁদতেই হবে- বলেন এই শিক্ষক।

আহনাফের পরীক্ষার হলের ছবিটি ছুঁয়ে গেছে অনেকের হৃদয়। এ ছবি দেখে শূন্যতা অনুভব করেছেন অনেকে। সেই শূন্যতা টের পাওয়া যায় সাংবাদিক সামছুর রহমানের লেখায়। ফেইসবুকে আহনাফের কলেজের ছবিটি শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আহনাফ। ৪ আগস্ট রাজধানীর ১০ নম্বরে গুলিতে নিহত হয় আহনাফ। কলেজের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় আহনাফের সিটে রাখা ফুল। ছবিটা দেখে অদ্ভুত শূন্যতা লাগল।

তারা কি ফিরিবে এই সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে..

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত