শুধু রপ্তানির হিসাবে নয়, আর্থিক খাতের আরও তথ্যেও বড় গরমিল আছে বলে দাবি করছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি আয়ের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল বের হয়েছে, যা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বড় গরমিল আছে আর্থিক খাতের নানা তথ্যেও।”
খেলাপি ঋণের তথ্যেও গরমিল আছে দাবি করে তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ ১১ শতাংশ বলা হলেও তা আসলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।”
“এই খাতের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ না করে কার্পেটের নিচে রেখে দিলে একসময় গন্ধ বের হবেই। এভাবে সমস্যা জিইয়ে রাখলে কোনও সমাধান আসবে না,” বলেন তিনি।
শনিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ।
তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
কিন্তু প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি বলে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের এই হিসাবের বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ। এছাড়া রাইট অফ (অবলোপন) এবং পুনঃতফসিল করা ঋণ যোগ করলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশ হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ।
আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল রাইট অফ, পুনঃ তফসিল করা ঋণ ও আদালতের আটকে থাকা ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখাতে হবে।
‘টাকা ছাপিয়ে অচল ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হচ্ছে’
টাকা ছাপিয়ে ‘অচল ব্যাংক’ টিকিয়ে রাখা হচ্ছে মন্তব্য করে আহসান মনসুর বলেন, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে রক্ষার নামে টাকা ছাপানো অব্যাহত রাখা হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। একই সঙ্গে সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। তাই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার বৃহত্তর স্বার্থে এখন টাকা ছাপানো বন্ধ করতেই হবে।
তিনি বলেন, “ইসলামী ব্যাংক ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে বেশি মুনাফা দেখাচ্ছে। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। সরকারও কর পাচ্ছে। বাস্তবে ব্যাংকের কোনও আয়ই হয়নি। আমানতের অর্থ লুটে খাওয়া হচ্ছে। এর মানে ‘ঘরের থালাবাটি বেচে কোর্মা-পোলাও খাওয়া হচ্ছে’।”
আর্থিক খাতে সংস্কার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে আহসান মনসুর বলেন, “নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল, আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। কিন্তু ছয় মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি।
“আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে, সেটা ভালো। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সংস্কার দরকার।”
এভাবে আর কতদিন ব্যাংক চলবে- এই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “আমানত শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না। আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী। সরকারের সহযোগিতায় তারা পুষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।
“চাকরির ভয় পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকলে আর্থিক খাত ঠিক হবে না। আর্থিক খাতে ভঙ্গুরতার পরিণতি জনগণকে ভোগ করতে হয়। যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরি করেন, তাদের কিছু হয় না। এ জন্য আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। না হলে খাতটি আরও খারাপ হয়ে পড়বে।”
ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি তুলে আহসান মনসুর বলেন, “ব্যাংক খাতে আজ যে এই অবস্থা হলো, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।সেটা করতে হবে সরকারকেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়।”
সংস্কার না হলে ব্যাংক খাতের দুর্দশা কাটবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আর্থিক দুরবস্থার কারণে বাংলাদেশ দিন দিন ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। এমনকি ধীরে ধীরে দেশের ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। ভারত থেকে হতাশ হয়ে আসতে হয়েছে, চীনও সাড়া দেয়নি।
“অন্যদিকে পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না সরকার। ফলে এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই, ডলারও নেই। এ জন্য জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার, অনেক বিদেশি কোম্পানি তাদের দেশে অর্থ নিতে পারছে না।”
অর্থনীতির উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “অন্য দেশ থেকে ধার করে এখন রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে বেশি দিন রিজার্ভ বাড়ানো যাবে না। রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও অর্থ পাচার বন্ধের মতো টেকসই পদ্ধতি ব্যবহার করে রিজার্ভ বাড়াতে হবে।”
প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা বন্ধের পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, “কারণ ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হয়ে গেছে। এসব প্রণোদনা খাচ্ছে দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে যুক্ত স্বার্থান্বেষী মহল।”
অনুষ্ঠানে ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থার ওপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি ওবায়দুল্লাহ রনি এবং প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সানাউল্লাহ সাকিব।
তাতে বলা হয়, ডলার সংকট ও ব্যাংক খাতে দুরবস্থার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। সরকারের সব অর্জন যেন এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের দুরবস্থা ম্লান করে দিচ্ছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কঠোর নীতির পরিবর্তে একের পর এক নীতিসহায়তার নামে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারীদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কাজে ব্যর্থ হয়েছে। আর যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই এখন অস্বস্তিতে আছে।
ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।