Beta
শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

রাতারাতি বদলাচ্ছে সাইনবোর্ড, চাঁদাবাজিও ফিরছে

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার তেজগাঁওয়ে দলটির একটি কার্যালয় দখলে নিয়েছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার তেজগাঁওয়ে দলটির একটি কার্যালয় দখলে নিয়েছে বিএনপি।
[publishpress_authors_box]

ঢাকার তেজগাঁওয়ের ফনিক্স গলিতে ফুটপাতে টুল পেতে বসে ভাতের দোকান চালান মতি মিয়া। পাশেই আওয়ামী লীগের একটি কার্যালয়। দলটি ক্ষমতায় থাকায় গত ১৫ বছর ধরে এর নেতাদের চাঁদা দিয়ে আসতে হয়েছিল তাকে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হওয়ার পর মতি মিয়া ভাবছিলেন, এবার বুঝি চাঁদাবাজদের হাত থেকে মুক্তি পেলেন তিনি। কিন্তু এক দিনেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তার।

মতি মিয়া বলেন, “হাসিনা পালাইয়া যাওনের পর ভাবছিলাম একটু শান্তিতে থাকতে পারুম। কিন্তু বিএনপি নেতারা এহনই যা শুরু করছে, তাতে মনে হইতাছে আগের মতোই দিন কাটান লাগবো। আওয়ামী লীগ যাইতে না যাইতেই বিএনপি নেতারা চান্দার লাইগ্যা আয়া পড়ছে।”

দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই বিভিন্ন স্থানে দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বাজার দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৭ আগস্ট দুজন নিহত হয়েছে। রাজশাহীতে সড়ক পরিবহন অফিস দখল নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষ জড়িয়েছে সশস্ত্র সংঘর্ষে।

আওয়ামী লীগের পতন ঘটলেও এবার বিএনপি ক্ষমতায় আসেনি। ক্ষমতায় বসেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার।

তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়া মাত্রই বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে বারণ করে সতর্ক করা হলেও তাতে কান দিচ্ছে না কেউ। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কার্যালয়গুলো দখল করে নিজেদের সাইনবোর্ড তুলে দিয়েছে।

এসব দেখে মতি মিয়া বললেন, “আওয়ামী গো এমন পরিণতি দেইখাও শিক্ষা হইলো না বিএনপির।”

গত ৫ আগস্ট বিকালে তেজগাঁওয়ের আওয়ামী লীগের কার্যালয়টি ভেঙে দেওয়ার পর মতি মিয়ার ভাতের দোকানটিও ভেঙে দেওয়া হয়।

পরদিন সেখানে আবার দোকানটি চালু করতে গিয়েছিলেন তিনি। তখনই বিএনপি নেতা-কর্মী পরিচয়ে একদল চাঁদা চায় বলে জানান তিনি।

কারা চাঁদা চেয়েছে- জানতে চাইলে মতি মিয়া বলেন, “২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা আশরাফ ও যুবদলের শাহাজাহান মিস্ত্রিসহ আরও কয়েকজন চান্দা চাইছে আমার কাছে।”

আশরাফ ও শাহাজাহানের বিস্তারিত পরিচয় ও মোবাইল ফোন নম্বর চাইলে মতি মিয়া বলেন, “আমার কাছে তাগো নাম্বার নাই। তয় আপনে বিজি প্রেস স্কুলের মোড়ে গেলে তাগো অফিস পাইবেন।”

তার কথা ধরে বিজি প্রেস উচ্চ স্কুল মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতের ওপর নির্মাণ করা একটি স্থাপনার ওপর ঢাকা মহানগর উত্তরের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৪ নম্বর ইউনিট বিএনপির একটি ব্যানার লাগানো। কার্যালয়ের ফটক খোলা থাকলেও ভেতরে কাউকে পাওয়া যায়নি।

ওই কার্যালয়ের পাশের এক দোকানি নিজের পরিচয় না জানিয়ে বলেন, “৫ আগস্ট পর্যন্ত এইডা আওয়ামী লীগের অফিস ছিল। তাগো ক্ষমতা চইলা যাওনের পরের দিনই বিএনপির ব্যানার টানাইয়া দখল নেয় কয়েকজন। এর আগে কখনোই ওই লোকগুলোরে এলাকায় দেখি নাই।”

তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো এলাকায় ফুটপাতের ওপর দীর্ঘদিন ধরে রিকশার গ্যারেজ চালান সবুজ আলী। আগে প্রতিটি রিকশার জন্য প্রতিদিন ৩০ টাকা করে চাঁদা দিতে হতো আওয়ামী লীগ নেতাদের। এখন তারা না থাকলেও চাঁদাবাজির হাত থেকে বাঁচতে পারছেন না সবুজ আলী।

তিনি বলেন, “যাগো কোনও সময় এলাকায় দেখি নাই, তারাই এখন বিএনপির বড় নেতা হয়া গেছে। আইয়া কইতাছে এখন নাকি তাদের চাঁদা দিতে হইব, না হইলে গ্যারেজ উঠায়া দিব। এখন বিএনপির এত নেতা বের হইতেছে, এতদিন তারা কই আছিল? হাসিনারে সরাইছে ছাত্ররা, তাইলে বিএনপিরে চাঁদা দিমু ক্যান?”

ঢাকার আরও এলাকাতেও এভাবে দখল ও চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ঢাকার মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগের এই কার্যালয়টি দখলে নিয়েছে শ্রমিক দল।

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে সড়কের পাশেই অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল ছাত্রলীগের একটি কার্যালয়। সেখানে বসেই আশপাশের ফুটপাতের দোকান ও অটোরিকশার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা হতো।

৫ আগস্টের পর ছাত্ররীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলে সেই অফিসের দখল নেয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা। এখন সেখানে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ওই কার্যালয়ের পাশের এক দোকানি নাম প্রকাশ না করা অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “বিএনপি নেতাকর্মীদের অবস্থা দেইখ্যা মনে হইতেছে তারা গত ১৫ বছর ধরে উপোস ছিল। দল এখনও ক্ষমতায় আসেনি, তারপরও তারা এখন যেভাবে খাই খাই করতেছে, তাতে মনে হইতেছে, আগের মতোই দিন কাটাইতে হইবো।

“শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই মিছিল, মোটরসাইকেল র‌্যালি বের করে করে শো-ডাউন দিতাছে বিএনপির লোকজন। বিএনপির আন্দোলনের সময় তারা কই আছিল? এখন যতজন শো-ডাউন দিতেছে আন্দোলনের সময় এতজন বের হলে শেখ হাসিনারে সরাইতে ছাত্রগো পথে নামা লাগতো না।”

“দেশ স্বাধীন করলো ছাত্ররা। তারা এখনও রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতেছে, ট্রাফিকের কাজ করতেছে। আর বিএনপি নেতারা চাঁদা তোলার জন্য এলাকা ভাগাভাগি শুরু করছে,” বলেন ওই দোকানি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছাত্রলীগের একটি কার্যালয় দুই ভাগ করে দখল করেছে বিএনপির দুটি সহযোগী সংগঠন।

মোহাম্মদপুরে শিয়া মসজিদ মোড়ে ছিল আদাবর থানা ছাত্রলীগের কার্যালয়। গত ৩ আগস্ট সংগর্ষের সময় এটি পুড়িয়ে দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগের সেই কার্যালয় এখন ভাগাভাগি করে দখল করেছে স্থানীয় যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল।

শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়টির শাটার বন্ধ। শাটারের এক অংশে লেখা যুবদল, আরেক অংশে লেখা স্বেচ্ছাসেবক দল। কথা বলার জন্য বিএনপির সহযোগী সংগঠন দুটির কোনও নেতাকে অবশ্য সেখানে পাওয়া যায়নি।

ওই কার্যালয়ের পাশের এক চা দোকানি বলেন, “৬ আগস্ট কয়েকজন এসে অফিসটির শাটার রং করে। পরে সেখানে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নাম লিখে তালা লাগিয়ে চলে যায়। এরপর আর কাউরে আসতে দেখিনি। মনে হয় পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওয়ার অপেক্ষায় আছে।”

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুদিন পর গত ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে সমাবেশ থেকে বিএনপি নেতারা দলের নামে অপকর্মকারীদের রুখে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কঠোর বার্তাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও তা থামছে না।

বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দলের কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, “দখলদারিত্বে যদি বিএনপির কেউ জড়িত থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এলাকায় এলাকায় মাইকিং করেও এ বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে সবাইকে।”

“দখল চাঁদাবাজি প্রতিরোধে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিএনপি থেকে একাধিক হটলাইন নম্বর দেওয়া হয়েছে জনগণের উদ্দেশে। কেউ এই ধরনের ঘটনা দেখলে বিএনপিকে জানানোর অনুরোধ রইলো,” বলেন তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত