বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ কর্মসূচির শুরুর দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও রাজপথে নামার পর বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক সংঘাত হয়েছে।
এই সংঘাতে অর্ধ শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে থানায় হামলা চালিয়ে ১৩ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শনিবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির জন্য সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি তুলে রবিবার থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়।
একই দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রবিবার রাজপথে আওয়ামী লীগ নেতাদের জমায়েত এবং সোমবার শোক মিছিলের কর্মসূচি দেন।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে আওয়ামী লীগ চায় না বলে তিনি দাবি করলেও রবিবার সকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের জমায়াতে অনেককে সশস্ত্র অবস্থায় দেখা যায়। আবার আন্দোলনকারীরাও লাঠিসোঁটা নিয়েই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়।
এরপর ঢাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় দিনভর সংঘাত চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে সরকার, সেনাবাহিনীও নামে মাঠে।
রংপুর : নগরীতে সংঘর্ষে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরসহ চারজন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। এর মধ্যেই আগুন দেওয়া হয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে।
বেলা সাড়ে ১২টায় দলীয় কার্যালয় থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হলে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। আধাঘণ্টা ধরে সংঘর্ষের পর পিছু হটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এরপরই আওয়ামী কার্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
সিলেট : সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের ব্যক্তিগত কার্যালয় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় রবিবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে। দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লাউয়াই এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
এ সময় কার্যালয়ের সামনে থাকা তিনটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি আসবাবেও আগুন লাগানো হয়। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গেেলও কাউকে ধরতে পারেনি।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য হাবিবুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার ব্যক্তিগত কার্যালয়টি বন্ধ ছিল। বন্ধ এ কার্যালয়ে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে।”
খুলনা : খুলনা শহরে প্রধানমন্ত্রীর চাচাত ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাহউদ্দীন জুয়েলের বাড়িতে হামলা হয় বলে সময় টিভি জানিয়েছে।
হেলাল উদ্দিন বাগেরহাট-১ ও সালাহউদ্দীন জুয়েল খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য। খুলনা মহানগরীর শেরে বাংলা রোড়ে তাদের বাড়ি।
দুপুর ১২টার দিকে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেখান েথকে আন্দোলনকারীদের মিছিল হেলাল-জুয়েলের বাড়িতে গিয়ে ইট ছোড়ে। এর পাল্টায় বাড়ির ভেতর থেকে গুলিবর্ষণ হলে আন্দোলনকারীরা ঢুকে আগুন লাগিয়ে দেয়।
সময় টিভির খবরে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারী গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে ব্যাপক ভাংচুর চালায় এবং ভবনের প্রতিটি তলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে হামলার সময় শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েলের কেউ বাড়িতে ছিেলন না।
কিশোরগঞ্জ : সকালে পুরান থানা এলাকায় আন্দোলনকারীরা জড়ো হয়ে মিছিল নিয়ে এগোয়। গৌরাঙ্গ বাজারে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে পৌঁছলে দুই পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে, এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটে। এরপর আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ অফিসে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। অফিসের সামনে থাকা কয়েকটি মোটরসাইকেলেও আগুন দেওয়া হয়।
পরে আন্দোলনকারীরা খরমপট্টি এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের সহ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসভবন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
টিটু আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচাত ভাই।
আগুনে ওই বাড়িতে দুজনের মৃত্যু হয় বলে চিকিৎসককে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
কক্সবাজার : সংঘর্ষের মধ্যে ছাত্রলীগের কর্মীর কক্সবাজার শহীদ সরণীতে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে আগুন দেয়।
দিনভর শান্ত থাকলেও সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ বিমানবন্দর সড়কে আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম মোজ্জাম্মেল হকের বাড়িতে ভাংচুর চালায়।
এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার পর শহরের শহিদ সরণীর প্রবেশ মোড়ে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি শুরু হয়। এর পর্যায়ে ছাত্রলীগের ধাওয়ায় শহিদ সরণী হয়ে পিছু হঠেছে আন্দোলনকারীরা। এসময় কক্সবাজার জেলা বিএনপি কার্যালয় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ছাত্রলীগ।
কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ অফিসসহ বহু স্থাপনায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। ভাংচুর হয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফের বাড়ি।
সকাল সাড়ে ১০টার পর শহরের মজমপুর বাস ডিপো মসজিদের সামনে জড়ো হতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরাও সেখানে ছিল। ১১টায় শুরু হয় মিছিল। সেই মিছিলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারে কম ছিল বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা।
চৌড়হাস মোড়ে মহাসড়কে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর মিছিলকারীরা পিছু হটে রাইফেল ক্লাবের পাশে ছাত্রলীগ কার্যালয় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর সাদ্দাম বাজার মোড়ে এসে তারা কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মাঞ্জারুল ইসলাম চঞ্চলের ব্যক্তিগত অফিস এবং সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আবু তৈয়ব বাদশার ব্যক্তিগত অফিসে হামলা চালায়।
এরপর মিছিলকারীরা একে একে মজমপুর গেটে জেলা ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়ে আগুন দেয়, ভাঙচুর চালায় পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর মুরালে। পরে বঙ্গবন্ধু সুপার মার্কেটে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে ব্যাপক ভাংচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে শহরের পিটিআই সড়কে হানিফের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। ওই বাড়ির কর্মী আবদুল হান্নান বলেন, হঠাৎ করে ১৫০ থেকে ২৫০ মানুষ এসে তিনতলা বাড়ি লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকে। তিনি দৌড়ে তিনতলার ছাদে চলে যান। হামলাকারীরা ঢুকে বাড়ির গ্লাস, নিচতলার জানালা-দরজা ভাংচুর করে। বাড়ির পেছনের দিকে রান্না করে ব্যাপক ভাংচুর করে। গ্যারেজে থাকা একটি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, “সারাদিন আন্দোলনকারীদের হামলা প্রতিহত করতে পুলিশ ব্যাপক কাজ করেছে। শেষের দিকে সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করে সংসদ সদস্যের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। খবর পাওয়া মাত্রই সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়।”
ঝিনাইদহ: ঝিনাইদহে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। শিক্ষার্থীরা সকালে শহরের মুজিব চত্বর থেকে এবং বিএনপি হাটের রাস্তা থেকে মিছিল বের করে। তারা পায়রা চত্বরে এসে এক সঙ্গে মিলিত হয়। সেই মিছিল থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, থানা, পুলিশ বক্স, পোস্ট অফিস, পৌরসভায় ভাংচুর চলে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপুর বাড়িতেও হামলা হয়।
বগুড়া : দুপচাঁচিয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা হয়। সেখানে একটি পুলিশ বক্সও ভাংচুর হয়। আক্রান্ত হয় উপজেলা ভূমি অফিসসহ একাধিক সরকারি স্থাপনা।
নোয়াখালী : নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে সকাল থেকে সংঘর্ষের পর সোনালী ব্যাংক, এলজিইডি অফিসসহ সরকারি বিভিন্ন অফিস ও দোকানপাটে ইট ছোড়া হয়। দুপুরে মাইজদী বাজারে নোয়াখালী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিথুন ভট্টের বাড়িতে হামলা ও ভাংচুর হয়। মিথুন ভট্ট জানান, হামলাকারীরা তার বাড়িতে চারটি ঘর ভাংচুর করে এবং চারটি মোটরসাইকেল আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। আতঙ্কে তার স্ত্রী সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।