ঢাকার আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চারতলা। ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে আছে এক তরুণ। বিছানা ঘিরে বসে আছেন পরিবারের তিন নারী সদস্য।
কাছে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানতে চাই, কথা বলা যাবে কিনা।
পরিচয় শুনে শুরুতে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলেও ধীরে ধীরে তারা বলেন কষ্টের কথা। জানা গেল, আহত তরুণের নাম শিহাব।
ঢাকার একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের খরচ চালাতে মিরপুর-২ নম্বর এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন তিনি। বৃহস্পতিবার সেখানে কাজ শেষেই বাড়ি ফিরছিলেন। তখনই গুলিতে আহত হন।
শিহাব বললেন, “মিরপুর-২ নম্বর পুলিশ স্টেশনের সামনে দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। গুলি কোনদিন দিয়ে এল আমি জানি না। কেবল দেখলাম রক্ত আর রক্ত।”
গোটা শরীরে ৬২টা গুলি লেগেছে শিহাবের। কিছু বের করা হয়েছে, কিছু শরীরের ভেতরেই রয়ে গেছে। বাম চোখ দিয়ে গুলি ঢুকে মাথার ভেতরে আঘাত করেছে। কিছু গুলি এমন জায়গায় আছে যেগুলো বের করা যাবে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বাম চোখে এখন একেবারেই দেখতে পাচ্ছেন না শিহাব, ডান চোখও ঝাপসা।
ছেলের এই অবস্থায় দিশাহারা মা রানী আক্তার।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি জানালেন, গুলি লাগার পর ছাত্ররা শিহাবকে মিরপুর-১০ এলাকার একটি হাসপাতালে নিয়েছিল। সেখান থেকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। মাঝে বাড়িতে নিয়েছিলেন কিন্তু চোখের অবস্থা খারাপ হওয়ায় আবার হাসপাতালে এনেছেন।
মাত্র ১৮ বছরের তরুণের জীবনের এই পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। বাবাহীন ছেলেটির ভবিষ্যৎ দিনগুলো কীভাবে কাটবে সেটাই এখন তাদের চিন্তার কারণ।
হাসপাতালটির বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডেই চিকিৎসা নিচ্ছেন গুলিতে আহত রোগীরা। ৪৫১ নম্বর ওয়ার্ডে দেখা হলো বরিশালের রাকিবের সঙ্গে, ৪৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে অনিক হাওলাদার, সাব্বিরসহ রয়েছেন কয়েকজন।
মাদারীপুর সদর থেকে এসেছে অনিক, চোখে কালো চশমা। পুরো মাথায় ছররা গুলির আঘাতের চিহ্ন। চিহ্ন রয়েছে গলার কাছে, পিঠেও। কিছু গুলি বের করা হলেও কিছু রয়ে গেছে।
অনিক জানালেন, গত বৃহস্পতিবার কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। সাড়ে ৫টার দিকে একটি ভবনের ছাদ থেকে গুলি ছোড়ে পুলিশ, সেই গুলি এসে লাগে তার চোখে।
এরপর তাকে ধরাধরি করে প্রথমে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ফরিদপুর হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন বলে জানালেন অনিকের বাবা নুরুল ইসলাম।
বরিশাল সদর থেকে এসেছেন রাকিব। তিনি আছেন ৪৫১ নম্বর ওয়ার্ডে।
মাছের রেনু পোনা উৎপাদন করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন।
রাকিব বলেন, “হঠাৎ দেখলাম চারদিকে অন্ধকার, আমার গায়ে রক্ত। চোখ থেকেও রক্ত পড়ছে। তখন পাশের এক ওষুধের দোকান থেকে দুজন দৌড়ে এসে আমাকে দোকানের ভেতর নিয়ে যায়। এরপর আর কিছু মনে নেই।”
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে দেখতে পান বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে আনা হয় ঢাকায়।
রাকিবের স্ত্রী শারমিন বললেন, খুব ছোট চাকরি করে রাকিব সংসার চালান, বিদেশে যাবার জন্য চেষ্টা করছিলেন। সেজন্য ধার দেনাও করেছেন। কিন্তু এখন সবই অনিশ্চিত হয়ে গেল।
বরিশালে বাবা-মা আর সাড়ে ৩ বছরের মেয়ে সন্তান রয়েছে জানিয়ে রাকিব বলেন, “আমিতো কোনও দল করি না, তাহলে আমি চোখ হারাব কেন? আমার জীবনটা এখন কিভাবে পার হবে?”
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা সকাল সন্ধ্যাকে জানান, গত ১৭ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৯ জন। তাদের মধ্যে ৩২৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। ভর্তি হওয়া এই রোগীদের মধ্যে ৩০২ জনের অস্ত্রোপচার দরকার হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ৩১৪ জন চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
কত জনের চোখ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা কতজন একেবারে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তা জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, “এটা ঠিক এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না। যারা এখান থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের নিয়মিত ফলোআপে আসতে বলা হয়েছে।
“তবে ‘কিছুটা’ ক্ষতি যে হয়েছে সেটাতো বলাই যায়। আর একেবারে দৃষ্টিশক্তি কতজনের যাবে সেটা বুঝতে আরও সময় লাগবে।”
চোখের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের চোখ কীভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তা জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, “মোস্টলি গানশট। তবে অন্যান্য আঘাতও রয়েছে।”