বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম নিউটনের বিরুদ্ধে সোনাজয়ী ক্রীড়াবিদসহ একাধিক নারী খেলোয়াড়কে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
তাদের মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। অভিযোগ আছে, এক পর্যায়ে গর্ভপাতও করানো হয় তার। এসব কাজে নিউটনকে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে সুমাইয়া আক্তার নামের জুজুৎসুর আরেক নারী খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে।
তবে সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নিউটন।
স্বপ্না (ছদ্মনাম) নামের মেয়েটি ভালো ফুটবল খেলতেন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্টেও খেলেছেন স্বপ্না। ৪ বছর আগে ফুটবল ছেড়ে যোগ দেন মার্শাল আর্টের খেলা কারাতেতে। যুব গেমসে কারাতে খেলায় জিতেছেন সোনার পদক। কারাতে খেলতে খেলতেই পরিচয় হয় একজন জুজুৎসু কোচের সঙ্গে। তিনি স্বপ্নাকে প্রলোভন দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার। সেই আশায় জুজুৎসু খেলা শেখেন স্বপ্না।
কিন্তু স্বপ্নার সেই আশায় গুড়ে বালি। খেলাটা ছেড়ে ইদানিং আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন স্বপ্না। শুধু স্বপ্না নন, এমন অনেক নারী জুজুৎসু খেলোয়াড়ই এই খেলাটা ছেড়ে দিয়েছেন।
সাধারণ সম্পাদক নিউটনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ
কারাতে, উশু, তায়কোয়ান্দোসহ বাংলাদেশের বেশিরভাগ মার্শাল আর্ট খেলার অনুশীলন হয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জিমনেসিয়ামে। কিন্তু নিউটন অনেকটা গোপনে জুজুৎসুর অনুশীলন করিয়ে থাকেন। এজন্য তিনি বেছে নিয়েছেন শ্যামলীর ২ নম্বর সড়কের ৩৫/এফ/৬ নম্বর ভবন। এখানেই একজন জাপানি কোচের অধীনে চলে জুজুৎসুর অনুশীলন।
সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জন খেলোয়াড় অনুশীলন করেন শ্যামলীতে। যেখানে পুরুষ খেলোয়াড় মাত্র ৫ জন। অনুশীলনে নারী খেলোয়াড় রাখতেই নাকি বেশি পছন্দ নিউটনের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খেলোয়াড় বলেছেন, “আমাদের ট্রেনিংয়ে মেয়ে খেলোয়াড়ের সংখ্যাই বেশি। ছেলেদের প্রাধান্য দিত না। আবার যদি কোনও অভিভাবক আসতো অনুশীলন দেখতে তাদের কোনও না কোনও অজুহাত দিয়ে সেখান থেকে বের করে দিত, যাতে খেলোয়াড়রা অভিভাবকেদের সঙ্গে নিয়ে না আসে।”
শুরুতে নারী খেলোয়াড়দের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতেন নিউটন। এরপর সেই খেলোয়াড়কে ভালো চাকরি পাওয়ার প্রলোভন দিতেন। বিদেশে খেলতে নিয়ে যাওয়ার লোভও দেখাতেন। মেয়েরা কখনও অনুশীলনের আগে পোশাক পরিবর্তন করতে গেলে সেই কক্ষে ঢুকেও তিনি ধর্ষণ করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ধর্ষণের শিকার এমন এক মেয়ে খেলোয়াড় বলেন, “অনেক মেয়েকে উনি ধর্ষণ করেছেন। আর এটার সঙ্গে জড়িত আছে সুমাইয়া ( জুজুৎসু খেলোয়াড় সুমাইয়া আক্তার) নামের এক মেয়ে। অনুশীলনে এসে সুমাইয়া প্রথমে বলতো, আমি বিদেশে খেলতে গেছি, তোমাদেরও বিদেশে খেলতে নিয়ে যাব। আমি যা বলি সেটা শুনতে হবে। না শুনলে তোমাদের তাড়িয়ে দেবে। খেলা থেকে বহিষ্কার করে দেবে। ক্রীড়া পরিষদে অভিযোগ দেবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই খেলোয়াড় নিউটন ও সুমাইয়ার ভয়ে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সুমাইয়ার বিরুদ্ধে তিনি ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ এনেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা ট্রেনিংয়ের পোশাক বদলাতে গেলে সুমাইয়া ওই কক্ষে ঢুকিয়ে দিত নিউটনকে। এরপর বাইরে থেকে দরজা আটকে দিত।”
প্রতিবাদ করে জেলে
ওই খেলোয়াড়ের অভিযোগ, তাকে একবার মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলেও পাঠানো হয়েছিল। মামলা করেছিলেন নিউটনের সহযোগী সুমাইয়া।
ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর এখন অনুশীলনে যাই না। আমি আইনের সাহায্য নেব- জানতে পেরে ওরা বিভিন্নভাবে আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। আমি ক্রীড়া পরিষদে অভিযোগ দিয়েছি। এটা জানতে পেরে নিউটন আমার বিরুদ্ধে শেরেবাংলা থানায় সুমাইয়াকে দিয়ে মিথ্যা মামলা দেয়।
“প্র্যাকটিস করা অবস্থায় আমি নাকি সুমাইয়ার পাসপোর্ট, সার্টিফিকেট ও টাকা চুরি করেছি। এরপর আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ১২ দিন জেল খেটেছি। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ আমার কাছ থেকে কিছু পায়নি।”
এই সুমাইয়া এশিয়ান যুব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে শুক্রবার (আজ) সকালে দুবাই থেকে দেশে ফিরেছেন।
ভুক্তভোগী ওই খেলোয়াড়ের প্রশ্ন, “আমি যদি পাসপোর্ট চুরি করি তাহলে সুমাইয়া বিদেশে খেলতে গেছে কীভাবে?”
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সব অভিযোগই অস্বীকার করেন সুমাইয়া।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সব মিথ্যা। আমি এসবের কিছুই জানি না। ওরা আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আমি যাতে বিদেশে যেতে না পারি, এজন্য পাসপোর্ট চুরি করেছিল সে। এজন্য আমি থানায় জিডি করি। এর বেশি কিছু আমি জানি না। আমি একজন ন্যাশনাল খেলোয়াড়, এসব করতে পারি না।”
তবে সুমাইয়াকে দিয়েই নিউটন হয়রানি করাচ্ছেন বলে অভিযোগ ওই ভুক্তভোগী খেলোয়াড়ের।
তিনি বলেন, “জামিনের সময় আমাকে দিয়ে লিখিত নিয়েছেন নিউটন। আমাকে উনার উকিল কিছু পড়তে দেয়নি। বলেছেন- এখানে সই করতে হবে। তখন আমি এক নজর দেখতে পারি শেষ পাতায় লেখা, উনার বিরুদ্ধে যেন মানহানি মামলা না করি। আমি যদি মানহানির মামলা করি তাহলে উনি আইনি পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আমাকে তিনি এসব বলবেন কেন? যদি কিছু করে সুমাইয়া করবে? কারণ পাসপোর্ট চুরি হয়েছে সুমাইয়ার। নিউটন কেন বলবেন মামলা না করার কথা? উনি আমার কাছ থেকে লিখিত নিলেন কেন?”
মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ
ভুক্তভোগী নারী এরই মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে পুরো ঘটনা জানিয়েছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদেও সাধারণ সম্পাদক নিউটনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি বলছেন, এই অভিযোগ দেওয়ার পর থেকেই তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
অভিযুক্ত নিউটন যা বলছেন
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে ফোন রিসিভ করেননি জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম নিউটন। কিছু সময় পর নিজেই ফোন করে পুরো অভিযোগ অস্বীকার করেন।
নিউটন বলেন, “আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, এর পুরোটাই মিথ্যা ও বানোয়াট। কেউ আমাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”
বিব্রত সভাপতি বললেন, তদন্ত হবে
জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশেনর সভাপতি গোলাম ফারুক প্রিন্স জানিয়েছেন, পুরো ঘটনা শুনে তিনি বিব্রত।
জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশেনর সভাপতি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ‘আমিও আজকে শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে কিছু জানি না। আমরা ঘটনার তদন্ত করে দেখব। প্রমাণ হলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। যদি সত্যি উনি দোষী হন, আর মেয়ে যদি বিচার চায়- তাহলে ফেডারেশন থেকে আমরা ব্যবস্থা নেব।”
জুজুৎসু কেমন খেলা
বাংলাদেশে মার্শাল আর্টভিত্তিক বেশ কয়েকটি খেলার প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যে অপ্রচলিত একটি খেলা জুজুৎসু। জুজুৎসু এখনও ফেডারেশন হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে (এনএসসি)। জুজুৎসু একটি জাপানি মার্শাল আর্ট পদ্ধতি। সাধারণত অস্ত্র ছাড়া কিংবা ছোট কোনও অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের সময় জাপানিরা এই পন্থা ব্যবহার করত। জাপানে খেলা হিসেবেও জুজুৎসু বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে এটি অ্যাসোসিয়েশন আকারে ক্রীড়া পরিষদের অধিভুক্ত হলেও গত ৬ বছরে কার্যনির্বাহী কমিটির কোনও সভা হয়নি।