বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের তথ্য জালিয়াতি করে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের কার্গো শাখা থেকে আমদানি পণ্য বের করার ঘটনা ঘটেছে। দেশে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে সিঅ্যান্ডএফের একটি চক্র আগস্ট মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক চালান বিমানবন্দর থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছে।
এ ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ায় গত জুন মাস থেকেই কার্গো শাখা থেকে পণ্যছাড় বন্ধ রেখেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার। তখন নির্দেশনা ছিল শুধু প্রকৃত যাত্রীরাই ‘এ’ ফরম দিয়ে পণ্যছাড় করতে পারবেন। এই সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়ে যায় দীর্ঘদিন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের চক্রটি। কিন্তু তারা সুযোগ খুঁজছিল।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সবার নজর যখন দেশের প্রধানতম ঘটনা প্রবাহের দিকে ছিল, ঠিক সেই সময়েই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের একটি চক্র সুযোগ নেয়। চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারের অগোচরেই কার্গো শাখা থেকে অবৈধভাবে পণ্য বের করে নেয়।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর কয়েকদিন দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। সেই সুযোগে আগস্ট মাসের শুরু থেকে অন্তত ১০০টি চালান বিমানবন্দর থেকে ছাড় হয়ে যায়।
বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টম ও সিভিল এভিয়েশন কর্মীদের একটি চক্রের সঙ্গে মিলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা এই পণ্য বের করে নিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়।
মঙ্গলবার এ বিষয়টি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নজরে আসে। এরপর কাস্টমের অধীন কাস্টম গোয়েন্দা সংস্থা (এআইআর) কর্মকর্তারা গিয়ে বিমানবন্দরের কার্গো শাখা থেকে রেজিস্ট্রার, ফাইলসহ কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে আসেন। ছাড় হওয়া ও ছাড়ের অপেক্ষায় থাকা আমদানি পণ্য চালানের কাগজপত্র জমা দিতে বলেন। কিন্তু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা ডকুমেন্ট জমা না দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। আর এতেই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।
চালান নিবন্ধন হওয়া কার্গো শাখার মূল রেজিস্ট্রার জব্দ করে আনার বিষয়টি স্বীকার করে কাস্টম গোয়েন্দা দল এআইআরের প্রধান ও কাস্টম উপ কমিশনার এ কে এম খায়রুল বাশার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কাস্টমের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা সেই রেজিস্ট্রার জব্দ করে নিয়ে এসেছি। এখন রেজিস্ট্রারের সাথে পণ্য চালান খালাসের ‘এ’ ফরম যাচাই করে দেখা হচ্ছে। একইসাথে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে ‘এ’ ফরমের বিপরীতে সব ডকুমেন্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।”
“অনিয়ম হয়েছে বা কতটা জালিয়াতি হয়েছে, সেটি জানতে তদন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে,” যোগ করেন কাস্টমের এই কর্মকর্তা।
বিমানবন্দরে দুই শিফটে দায়িত্ব পালন করে দুটি টিম। তাদের একজন সহকারী কমিশনার আলিফ রহমান নির্ভুল। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আসলে সেই সময়ে প্রায় ২০ দিনের মতো আমি ছুটিতে ছিলাম। ১০ আগস্ট যোগ দিয়েছি। যোগদান করে এসে শুনি এই ঘটনা। এখন তদন্ত চলছে। আশা করছি, সত্যটা বেরিয়ে আসবে।
“জুন মাস থেকে নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে। এই নিয়মে যেসব ‘এ’ ফরম বিদেশ থেকে আসা যাত্রী সরাসরি কাস্টমে জমা দেবেন, তারা নিজেই সেগুলো বুঝে নিয়ে বন্দর ছাড়বেন। অর্থাৎ যাত্রী হতে হবে জেনুইন। কিন্তু বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টম কর্মকর্তারা সেগুলো ছাড় দিয়েছেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের বিপরীতে।”
কীভাবে ছাড় দিলেন—জানতে চাইলে বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমের রাজস্ব কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জামাল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা যে পণ্যগুলো ছাড় দিয়েছি, সেগুলোর যাত্রী সরাসরি উপস্থিত ছিল।”
কিন্তু দেশে কারফিউ-অস্থিরতা চলার সময় একজন যাত্রীর বিপরীতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কীভাবে এতগুলো পণ্যছাড় নিল—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি উত্তর না দিয়ে এ বিষয়ে জানতে কাস্টমের ফোকাল পয়েন্টের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কাস্টম থেকে অনুমতির পণ্যছাড়ের জন্য যাত্রীকে যেতে হয় চট্টগ্রাম বিমানবন্দর কার্গো শাখায়। সেখানে সিভিল এভিয়েশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যাত্রীর পরিচয় শনাক্ত করেই পণ্য তাকে বুঝিয়ে দেন। এক্ষেত্রে সেই চালান যাত্রীর বদলে সিঅ্যান্ডএফকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কার্গো শাখার প্রধান ওমর শরীফ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কাস্টমের স্ক্যানিং অনুমতির পর আমরা যাত্রীদের পণ্য বুঝিয়ে দিই। তার আগে আমরা বিমানবন্দরের কার্গো চার্জ নিই। কাস্টম অনুমতি দিলে এখানে আমাদের পণ্য বুঝিয়ে দেওয়া ছাড়া করণীয় নেই। ফলে এখানে অবৈধ লেনদেনের সুযোগ নেই।”
বিমানবন্দরের কর্মরতরাই অভিযোগ করেছেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা যাত্রীর বিপরীতে যে ‘এ’ ফরম কাস্টমে পণছাড়ের জন্য জমা দেন তার ৯৫ শতাংশই ভুয়া। অর্থাৎ যাত্রীর পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস, স্বাক্ষর ‘এ’ ফরমে জমা দেওয়া তথ্যের সঙ্গে যাচাই করলেই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়বেই। কয়েকজন যাত্রীর ফোন নম্বরে ফোন করলে দেখবেন তাদের নামে যে পণ্য আনা হয়েছে, সেটি তারা নিজেরাও জানে না। অথচ এই ধরনের জালিয়াতির বিষয়গুলো চলছে এখানে। এই কাজের সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ, সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের একটি চক্র জড়িত।
চট্টগ্রাম কাস্টম ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, ১২ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১৩৪টি ‘এ’ ফরম জমা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি পণ্য চালান এসেছে তিনটি সিঅ্যান্ডএফের নামে।
একটি হচ্ছে আল মোস্তফা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল দেশে অস্থিরতার সময়ে একজন যাত্রী কীভাবে পণ্যছাড় নেন? প্রশ্ন শুনে উত্তর এড়িয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোবারক হোসাইন পিন্টু সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার নামে কতগুলো ফরম এখনও হিসাব কষে দেখিনি। রবিবার আমি ‘এ’ ফরম জমা দেব।” এরপর কথা না বাড়িয়ে তিনি ফোন কেটে দেন।
দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে, এস এন বি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, যার মালিক বাবুল কুমার দাশ। আরেকটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এওস ট্রেডার্স, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম জগলুল ফারুক।
এর মধ্যে বাবুল কুমার দাশের দুটি ফোন নম্বরে কল দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। আর এ বি এম জগলুল ফারুককে কল দেওয়া হলে তিনি সাড়া দেননি। ফলে তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
কীভাবে কার্গোতে পণ্য আসে
একজন যাত্রী বিদেশ থেকে যখন দেশে পৌঁছান তখন তার সঙ্গে কিছু পণ্য নিয়ে আসেন। এখন যাত্রী প্রতি তার পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০০ কেজি। এই পরিমাণ পণ্যছাড় হয় বিমানবন্দরের কার্গো শাখা থেকে। কার্গো শাখায় কর্মরত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট যাত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে পণ্যছাড়ের যাবতীয় ডকুমেন্টেশন করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ যাত্রীই এই ধরনের পদ্ধতিতে পণ্য আনেন না। এই কারণে ২০২৪ সালের জুন মাস থেকে সেই নিয়ম বন্ধ করে কাস্টম। নতুন নিয়মে মূলত প্রকৃত যাত্রী রিয়েল টাইম মেনে এই পণ্য আনতে পারবেন। তা যাত্রীপ্রতি সর্বোচ্চ একশ কেজি। কিন্তু সেই নিয়ম না মেনে বিমানবন্দরে কর্মরত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা পণ্যছাড় নিচ্ছেন।
একজন যাত্রী যখন বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নামেন তখন ইমিগ্রেশন পার করার সময় তার বোর্ডিং পাস, পাসপোর্ট কপি ইমিগ্রেশন বিভাগে সংরক্ষিত থাকে। সেখান থেকে কোনো না কোনোভাবে যাত্রীর ডকুমেন্টগুলো পাচার হয়ে সেই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাছে পৌঁছে। আর যাত্রীর অগোচরেই সেই কপিগুলো পৌঁছে যায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাছে। সেই কপি দিয়েই পণ্যছাড়ের আবেদন ‘এ’ ফরম পূরণ করে কাস্টমে জমা দিয়ে পণ্য অনায়াসেই ছাড় করে নেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের চক্রটি।
বেশ কয়েক বছর ধরেই এ অনিয়ম চলার পর চট্টগ্রাম কাস্টম কমিশনার ফাইজুর রহমানের নজরে আনা হলে তিনি সত্যতা পেয়ে গত জুন মাসেই জড়িত বেশ কয়েক জন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে দপ্তরে ডেকে পাঠান। তিনি অনিয়ম বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পণ্যছাড় মৌখিকভাবে স্থগিতের নির্দেশ দেন। এরপর জুলাই মাস থেকেই বিমানবন্দরের কার্গো শাখা থেকে ‘এ’ ফরমের বিপরীতে আর পণ্যছাড় হয়নি।
অনিয়মের এই পদ্ধতি আবার চালুর জন্য বিমানবন্দরে কর্মরত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের একটি চক্র জোট বেঁধে জুলাই মাসেই অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খাতুনের স্মরণাপন্ন হন। তার পিএসকে ধরে একটি চিঠি অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠায় চক্রটি। এজন্য সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বেশকিছু অর্থলগ্নি করে তারা। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তাদের সেই চেষ্টা আর সফল হয়নি। এজন্য নতুন কৌশলে তারা এই পণ্যছাড় শুরু করে।