চার দশক আগে সেপ্টেম্বরে মুক্তি পেয়েছিল মিলোস ফোরম্যানের অস্কার জয়ী ছবি ‘অ্যামেডেইস’। অনেকেরই হয়তো অজানা, এই সিনেমার ব্যাপারে আছে ঐতিহাসিক কিছু ভুলের অভিযোগ। এটি যখন অস্কার পায় তখন থেকে আজ অব্দি অনেক চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদেরও বিষয়টি নজরে আসেনি।
৪০ বছর আগে যখন প্রিমিয়ার শো হয়েছিল, তখন প্রশংসার সাগরে ভেসে যায় সিনেমাটি। দুই সুরস্রষ্টা , অ্যামেডেইস মোজার্ট এবং অ্যান্তোনিও সালিয়েরির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এই সিনেমাটি অস্কারে আটটি পুরস্কার জিতে নেয়। পরিচালক ফরম্যানের মাথায় ওঠে সেরা পরিচালকের মুকূট।
তবে সময় যত গড়িয়েছে অ্যামেডেইসের গল্পের ঐতিহাসিক ভুলগুলো নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া দিন দিন বেড়েছে। একবার দ্য গার্ডিয়ান তার একটি কলামে উল্লেখ করেছিল, “ভুলগুলো এতোই হাস্যকর যে এড়িয়ে যাওয়াও কঠিন”। আর বিবিসির মতে, “চলচ্চিত্রটি ঐতিহাসিক সত্যকে গুরুত্বের সঙ্গেই নেয়নি”।
সুরস্রষ্টা সালিয়েরিকে সিনেমাটিতে একজন ধার্মিক অবিবাহিত হিসেবে দেখানো হয়। আদতে তিনি আদৌ তা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিবাহিত এবং আট সন্তানের জনক। এমনও শোনা যায় যে, তার নাকি উপপত্নীও ছিল
অ্যামেডেইসে মোজার্ট এবং সালিয়েরির মধ্যে যে বিদ্বেষপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানো হয় সেটির পুরোটাই বানোয়াট। ইতিহাস ঘেঁটেই এ কথা বলছেন সমালোচকরা। মজার ব্যাপার হলো, মোজার্ট তার সন্তানকে উল্টো সালিয়েরির কাছে সংগীত শিক্ষা লাভের জন্য পাঠিয়েছিলেন।
আর মোজার্টের মুখে যে চটুল যৌন রসাত্মক ঠাট্টাগুলো বসানো হয়েছে সেগুলো মূলত ভিয়েনার মধ্যবিত্তের নিত্য আলাপের অংশ। এই সিনেমার সবচাইতে আপত্তিকর অংশটি হলো, মোজার্টকে কবরস্থ করার ঘটনাটি। এতে দেখানো হয়, কোনও রকম নাম নিশানা ছাড়াই মোজার্টকে একটি জীর্ণ কবরে দাফন করা হচ্ছে। যেটি একেবারেই সত্য নয়। সমালোচকরা একে ইতিহাসের প্রতি অশ্রদ্ধা বলছেন।
কিন্তু এইসব অভিযোগে জেরে ঢাকা পরে যাচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। নির্মাতা ফোরম্যানের এই বায়োপিকধর্মী সিনেমাটি ইঙ্গিত দিচ্ছে ভিন্ন কিছুর। দুই সুর সম্রাটের এমন বৈরিতার মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো বিংশ শতকের দুই সুপার পাওয়ার, আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে বিরাজমান ‘স্নায়ুযুদ্ধ’-কেই উপস্থাপন করেছেন।
বায়োপিকের আড়ালে সিনেমার ফোকাস ছিল ১৯৮৪ সালের প্রেক্ষাপট। আর তাতেই ১৭৮৪ সালের মূল প্রেক্ষাপট নির্মাণে ছাড় দিতে হয়েছে নির্মাতাকে।
নির্মাতা ফোরম্যান স্পষ্টতই মোজার্টের বায়োগ্রাফি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তিনি বরং সোভিয়েত রাষ্ট্রকে রূপকে হাজিরের চেষ্টায় অধিকতর মনযোগী ছিলেন। তার চিত্রনাট্যে মোজার্টকে দেখানো হয় এমন এক প্রতিভা হিসেবে যে কিনা তার পৃষ্ঠপোষোকদের কাছেই জিম্মি! যিনি একসময় রাষ্ট্রের দমন পীড়নের শিকার হন।
‘ফিল্ম ক্রিটিসিজিম, দ্য কোল্ড ওয়ার, অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাকলিস্ট’ গ্রন্থের লেখক জেফ স্মিথ বিবিসিকে বলেছিলেন, “যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মোজার্টের সংগ্রাম, তাকে সোভিয়েত সেন্সরশিপের সাথে মিলিয়ে দেখানোর ব্যাপারটা ফোরম্যানের সোভিয়েত বিষয়ক ব্যক্তিগত হতাশা।
“মোজার্টের এক অপেরা কম্পোজিশনের বিরুদ্ধে রাজ্য সম্রাট অভিযোগ এনেছিলেন যে, ওই কম্পোজিশনে ‘অনেক বেশি নোট’ এর ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘটনাটি নির্মাতা ফোরম্যান দেখতে চেয়েছেন সোভিয়েত জামানার মতাদর্শিক শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে আভাগ্রাদ শিল্পের দ্বন্দ্বের আয়নায়। সম্রাটের সেই রায়ে মোজার্টের যে হতভম্ব অভিব্যক্তি তাকে ফোরম্যান তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে সোভিয়েত ‘দমন পীড়নে’র রূপকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।”
সোভিয়েত টোটালিটারিয়ানিজম-কে ‘অ্যামেডেইস’ দিয়ে দেখানোর আইডিয়া সবাইকে গেলানো সম্ভব না। পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক কেভিন হ্যাগোপিয়ান বলেছেন, “রূপকের আশ্রয়ে সবখানে সোভিয়েত ‘ভূত’ খোঁজার বাতিক শিল্পকে রাজনীতির নিছক দাসে পরিণত করে।”