বাংলাদেশে শিক্ষার দর্শন, শিক্ষানীতি এবং শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে আমরা সকলেই উদ্বিগ্ন। রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেনের কথার সূত্র ধরে বলা যায় যে, শিক্ষার অভাবই বর্তমান বাংলাদেশের সকল সমস্যার মূল কারণ। বর্তমান সময়ে বিশ্বের অগ্রগণ্য দার্শনিক অমর্ত্য সেনের শিক্ষাচিন্তা নিয়ে লেখার প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপট এটাই। নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের শিক্ষাচিন্তা বুঝতে আত্মজীবনীগ্রন্থে বর্ণিত তাঁর শিক্ষাজীবনের ভিত্তিগুলো প্রাথমিকভাবে এখানে তুলে ধরব। সেখানে দেখাতে চেষ্টা করব যে, স্বপ্নদর্শী প্রতিষ্ঠান ও চিন্তাশীল ব্যক্তির সংস্পর্শ কীভাবে সমন্বিতভাবে তাঁর মানসগঠনে ভূমিকা রেখেছে।
অমর্ত্য সেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও অর্থনীতি— একইসঙ্গে দুটি বিভাগেই অধ্যাপনা করছেন। আত্মজীবনী “হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: আ মেমোয়ার” [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাঁথা] গ্রন্থে তিনি নিজের ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাজীবনের চিত্রটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বইটির তৃতীয় অধ্যায়ের নামই ‘স্কুল উইথআউট ওয়াল্স’ বা ‘দেয়ালবিহীন স্কুল’। শিরোনামটি শোনামাত্রই আমাদের মনে পড়ে যায় ১৯৭৯ সালের নভেম্বরের শেষে প্রকাশিত ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা রক গানের দল পিংক ফ্লয়েডের বিখ্যাত ‘দ্য ওয়াল’ অ্যালবামের ‘অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল’ গানটির কথা। যেখানে দেখানো হয়, স্কুলে কোমলমতি শিক্ষার্থীকে জীবন ও জগৎ নামক কুটিরের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কারের পরিবর্তে তাদের ভেতর বিভেদের মানসিক দেয়াল সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে প্রত্যেক বিদ্যার্থী হয়ে উঠছে একজন অনুগত ক্রীড়ানক। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে শারীরিক শাস্তি, অসম্মান ও নিগ্রহের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং এভাবে সৃজনশীলতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। গানের ভেতর এসবের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এক প্রবল প্রতিবাদ ও বিদ্রোহকে দেখানো হয়। ফলে বিদ্যার্থী গানের কথায় সেই অচলায়তন ভেঙ্গে তার ফ্রিডম বা ‘স্বক্ষমতা’র মৌলিক দাবিকে জোরালোভাবে তুলে ধরে।
অমর্ত্য সেনের আত্মজীবনীর অধ্যায়টির শিরোনাম—‘স্কুল উইথআউট ওয়াল্স’ বা ‘দেয়ালবিহীন স্কুল’— একারণেই চুম্বকের মতো মনোযোগ কেড়ে নেয়। প্রথমেই বলা দরকার অমর্ত্য সেনের শিক্ষাচিন্তার মূলে রয়েছে ‘ফ্রিডম এন্ড রিজনিং’ বা স্বক্ষমতা’ ও যুক্তিবিচারের গভীর অঙ্গীকার। এই মৌলিক বিষয়টি তিনি শান্তিনিকেতনের ব্যাতিক্রমধর্মী বিদ্যাপীঠ থেকে পেয়েছিলেন যার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণভ্রমোরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ যখন ইহলোক ত্যাগ করেন তখন বালক অমর্ত্যর বয়স মাত্র ৭ বছর ৯ মাস। সেসময় অমর্ত্য ঢাকায় সেন্ট গ্রেগরিজ-এ পড়ছেন। ঐ বয়সে অমর্ত্যর রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে অনুধাবন করার কথা নয়, যদিও স্কুলছুটিতে অবকাশ কাটাতে শান্তিনিকেতনের দিনগুলিতে নানা-নানী বা মায়ের সঙ্গে নিয়মিতই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। রবীন্দ্র-প্রয়াণের সেই আগস্টের শোকে মূহ্যমান পরিবেশে বালক অমর্ত্য নিজেকে প্রশ্ন করেন:
‘তা, পৃথিবীতে এই মানুষটির এত কিসের গুরুত্ব? হ্যাঁ, এটা জানতাম যে রবীন্দ্রনাথ একজন বড় কবি (এমনকি ওঁর বেশ কিছু কবিতা আবৃত্তিও করতে পারতাম), কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তা আমার কাছে একেবারেই পরিষ্কার ছিল না।’ [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাঁথা, পৃষ্ঠা ৪০]
যাহোক, বালক অমর্ত্য সেন তাঁকে আরও গভীরভাবে জানার পণ করেন যা পরবর্তীতে তাঁর সারা জীবনের ব্রত হয়ে ওঠে। স্কুলজীবন থেকেই ছোট্ট অমর্ত্য বড় মাপের চিন্তাশীল মানুষদের সঙ্গ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নানা ক্ষিতিমোহন সেন অন্যতম। অমর্ত্য সেনের ভাষায়:
‘শৈশব থেকেই আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল বিপুল। আমার মা অমিতা তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের শুধুমাত্র একজন বিদ্যার্থীই ছিলেন না— বরং রবীন্দ্রনাথ রচিত ও নির্দেশিত কলকাতার নৃত্যনাট্যগুলোতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নিয়মিত অভিনয়ও করতেন। আমার নানা ক্ষিতিমোহন সেন কয়েক দশক ধরে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজে লিপ্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতনকে বিদ্যাপীঠ হিসেবে গড়ে তুলতে আমার নানা ও রবীন্দ্রনাথ ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।’ [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাঁথা, পৃষ্ঠা ৪১]
পারিবারিক এ সম্পর্কের ফলেই বাবা অধ্যাপক আশুতোষ সেন ও মা অমিতা সেনের প্রথম সন্তানের নাম ‘অমর্ত্য’ রাখেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথমে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে ব্যতিক্রমধর্মী একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯২১ সালে তিনি সেখানে ‘বিশ্বভারতী’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সর্বজনবিদিত যে, গতানুগতিক ধারার স্কুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীতশ্রদ্ধই ছিলেন। পরিবার থেকে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, তবে সেখানে তার ভালো লাগেনি। যেসব স্কুলে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল সেগুলোর কোনোটিই তাঁর মনে ধরেনি। শুধু তাই নয়, উপমহাদেশে সেসময়ের শিক্ষার অবস্থা তাঁর কাছে স্বস্তির চেয়ে বরং ছিল ভীতিপ্রদ। ছেলেবেলায় কলকাতার স্কুলগুলোর সমস্যা-সঙ্কুল বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত লিখিত মত ছিল। পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে পাওয়া শান্তিনিকেতনের জমিতে তিঁনি যখন নতুন ধরনের একটি বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে তিনি চিরাচরিত সমস্যগুলোর পুনরাবৃত্তি না ঘটার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। নতুন এই বিদ্যাপীঠের লক্ষ্য ছিল বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতির অনুশীলন এমনভাবে করা যাতে করে একজন কোমলমতি বিদ্যার্থীর কাছে জগৎটি আর অচেনা-অজানা না থেকে তা হয়ে ওঠে নিজের আপন কুটির। কিন্তু আমাদের প্রচলিত বিদ্যাশিক্ষায় শিক্ষার্থীর মনের পরিধি থাকে সঙ্কুচিত যেখানে বিশ্বনাগরিক ও মানবিক হয়ে ওঠার বিষয়টি একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে, অমর্ত্যর ভাষ্যে স্বপ্নদর্শী শান্তিনিকেতনের বিশেষত্ব একদিকে যেমন ছিল এর গ্রাহক নমনীয় কাঠামো ও অন্তর্ভূক্তিমূলক চর্চা, তেমনি অন্যদিকে নম্বরের ইঁদুর দৌড় ও শারীরিক শাস্তির ভয় ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার স্তম্ভ দু’টি: স্বাধীনতা ও যুক্তিচর্চা। বিশেষ করে বিগত দুই শতাব্দীর ঘটনাবলীতে এটি প্রমাণিত যে, সমাজের গুণগত রূপান্তরে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর স্বাধীনতা মৌলিক বিষয়। একইসঙ্গে, এই স্বাধীনতাকে সুস্থায়ী করতে যুক্তিবিচারের গুরুত্ব কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া চলে না। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের নানা প্রান্তের সমাজ, সংস্কৃতি ও যাপিত জীবনের বাস্তবচিত্র স্বচক্ষে দেখেছেন ভ্রমণের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভ্রমণ তাঁর নিজের বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল। শিক্ষার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো সাম্য অভিমূখী এর রূপান্তর ক্ষমতা। সাম্যের আকর্ষণ হলো ন্যায্যতায়। শিক্ষার বড় ভূমিকা হলো সমদর্শিতারূপী ন্যায্যতার ভেতর দিয়ে জীবনকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে যাওয়া। সমদর্শিতারূপী ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে মৌলিক অবদান রাখতে সক্ষম শিক্ষা। শিক্ষার মূল আকর্ষণ এটাই। সদ্যপ্রয়াত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল মোমিন চৌধুরী ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ’ প্রবন্ধে বিদ্যাশিক্ষার চারটি মৌলিক স্তম্ভের কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন:
‘শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নোক্ত চারটি মৌলিক বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে হবে যা প্রত্যেক বিদ্যার্থীর জ্ঞানের ভিত্তি হবে: এক. কীভাবে শিখতে হয় তা জানা, দুই. শেখা বিষয়টি কীভাবে প্রয়োগ করতে হয় তা জানা, তিন. অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে শেখা, চার. উল্লিখিত তিনটি বিষয়ের অগ্রগতির সম্মিলিত ফলাফলে ব্যক্তির (সত্ত্বা) হয়ে ওঠা। প্রকৃতপক্ষে, জ্ঞানার্জনের এই চারপথের উৎস মূলত: একক সমগ্র থেকে সৃষ্ট। কিন্তু এই চারস্তম্ভের বিষয়টি কোন বিশেষায়িত বিষয় নয়, যেখানে কোনটির গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার কমবেশি হতে পারবে। বরং উল্টো, এই চারস্তম্ভের গুরুত্ব হবে সমান, কারণ এগুলো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।’ [ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা: মেকিং, আনমেকিং, রিমেকিং, পৃষ্ঠা-৩৬]
একজন ব্যক্তির সমগ্রজীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস হলো শিক্ষা। আর এই অভিজ্ঞতার ভেতরে থাকে বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও তার প্রয়োগলব্ধ জ্ঞান। জ্ঞানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিসত্ত্বা ও সমাজে তার অবস্থান বুঝতে পারা। ফলে, শিক্ষার্থীর জীবনে ভালো স্কুলের গুরুত্ব বিপুল। আজ থেকে এক হাজার বছরেরও বেশি আগে ইবনে সিনাহ শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে এক সামগ্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করেন। তাঁর মতে, বড় অর্থে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো একজন ব্যক্তির শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উন্নয়ন সাধন। তবে নির্দ্দিষ্টভাবে উচ্চশিক্ষা বা বিশেষায়িত শিক্ষার অভিমূখটি হলো অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজের বিনির্মাণ। দার্শনিক ইবনে সিনাহ’র কাছে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির দেহ, মন ও চরিত্রের পরিপূর্ণতার মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের ভারসাম্য ও তার পূর্ণবিকাশ। [মোমিন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৩]
দার্শনিক ইবনে সিনাহ’র এই চিন্তার সঙ্গে আমরা মিলিয়ে পড়তে পারি অমর্ত্য সেনের শিক্ষাজীবনের স্মৃতিকথা। অমর্ত্য শান্তিনিকেতনে তাঁর ১০ বছরের শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতার কথা আত্মজীবনীতে খুব সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন। অধ্যাপক সেনের ভাষায় :
‘সেখানে শিক্ষার অভিমুখটি ছিল সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেশগুলোর শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ছাত্রছাত্রীদের মনে সত্যিকারের বিশ্ববীক্ষার উদ্বোধন ঘটানো। শান্তিনিকেতনে যে বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হতো সেটি হলো শিশুদের মনকে কৌতুহলী করে গড়ে তোলা। শান্তিনিকেতন শিশুর কৌতুহলকে তার কল্পনার সঙ্গে যুক্ত করে নিজেকে বিকশিত করতে শেখায়। শান্তিনিকেতন তার শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতায় নিপুণভাবে তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে চলতো না। ফলে, শান্তিনিকেতনে পরীক্ষায় ভালো ফল করার চাপ ও ভালো গ্রেড অর্জনের অভিমুখী করে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা হতো না। কেবল তাই নয় বরং এহেন প্রতিযোগিতার প্রতি বিদ্যার্থীদের যথেষ্ঠ নিরুৎসাহিত করা হতো। শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত গ্রন্থাগারের বইয়ের তাকে থরে থরে সাজানো গ্রন্থগুলো যেন ছিল আমায় ঘেরা এক সমৃদ্ধ পৃথিবী। স্কুলের পরীক্ষায় আমি ভালো ফল না করায় আমি আমাকে নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট ছিলাম। …একটি অসহায় শিশুকে মারধর করার মতো বর্বরতা পরিহার করার কাজটা আমাদের শেখা উচিত। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে হবে, তারা যেকাজগুলো করবে সেগুলো যুক্তি ও বিবেচনার সাহায্যেই করবে, শাস্তি এড়ানোর জন্য নয়।’ [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাঁথা, পৃষ্ঠা-৪৩]
শুধু অমর্ত্য সেনই নন, অস্কার পুরস্কারে সম্মানিত মহান চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ও ছিলেন এই শান্তিনিকেতনের একজন অন্যতম উজ্জ্বল ছাত্র। শান্তিনিকেতন থেকেই তাঁর প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গির সক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছিল, তাঁর স্বীকৃতি পাওয়া যায় নিজের লেখা থেকেই:
‘যে তিনটি বছর আমি শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছি আমার বিবেচনায় সেটাই আমার জীবনের সবথেকে ফলপ্রসু সময়। .. শান্তিনিকেতনই প্রথম ভারতীয় এবং সুদূর প্রাচ্যের অগাধ শিল্প ভাণ্ডারের দিকে আমার দৃষ্টি মেলে ধরেছিল। তার আগে অবধি আমি পশ্চিমী শিল্প, সঙ্গীত এবং সাহিত্যেই পুরোপুরি ডুবেছিলাম।.. প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলনে এই যে আমি, তা শান্তিনিকেতনের নির্মাণ।.. আমার মনে হয় শান্তিনিকেতনে এসে শিক্ষানবিশি না করলে আমি পথের পাঁচালী বানাতে পারতাম না। মাস্টারমশাই (নন্দলাল বসু)-এর পায়ের কাছে বসে আমি প্রকৃতিকে দেখতে শিখেছিলাম এবং প্রকৃতির ভেতর যে ছন্দ লুকিয়ে আছে তা অনুভব করতে পেরেছিলাম।’ [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাঁথা, পৃষ্ঠা-৪৬]
জগৎ কুটির থেকে আমরা জানতে পারি, রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানচর্চা ও জীবনের মধ্যে কোনো দূরত্ব রাখতে চাইতেন না। এমনকি প্রতিদিনের জীবনচর্চায়ও কোনো প্রকার বন্ধন পছন্দ করতেন না। একারণেই তাঁর শ্রেণিকক্ষ ছিল চারদেয়ালের বাইরে খোলা আকাশের নীচে গাছের কোলে উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তরে। রবীন্দ্রনাথ চাননি কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শুধু নিজ নিজ সম্প্রদায়, ধর্ম, শ্রেণি, পেশা ইত্যাদি দেয়ালের ভেতর সীমিত থাকুক। তিঁনি জাতীয়তাবাদের কড়া সমালোচনা করে গেছেন। তিঁনি চাইতেন নিজেদের জাতিগত সঙ্কীর্ণতার বাইরে যেন আমরা চিন্তা করতে শিখি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তিঁনি একটি নির্দিষ্ট সাহিত্যচর্চায় বেঁধে রাখার বিরোধিতা করেছেন। তিঁনি মনে করতেন এভাবে কেবল বইয়ে পড়া সীমাবদ্ধ দেশপ্রেম দেখানো যায়, বাইরের পৃথিবীর কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করা হয়ে ওঠে না। [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাঁথা, পৃষ্ঠা-৪৪]
রবীন্দ্রনাথের এই চিন্তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ২০১১ সালের শেষ দিকে অমর্ত্য সেনের ডেভিড হিউম স্মারক বক্তৃতায়। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিক ডেভিড হিউমের চিন্তা ব্যাখ্যা করেন এভাবে:
‘ডেভিড হিউমের জন্ম তিনশ বছর আগে, ১৭১১ সালে। তাঁর সময়ের তুলনায় আজকের পৃথিবী অনেক বদলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর চিন্তা ও অনুজ্ঞাগুলো এখনও খুবই প্রাসঙ্গিক। হিউমের অন্তর্দৃষ্টিগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে, নৈতিক বিষয়গুলোকে ভালোভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে তথ্য ও জ্ঞানের গুরুত্বকে স্বীকার করা। অন্য একটি ব্যাপার হচ্ছে, মানব সংবেদনের (সেন্টিমেন্টস) জোরালো ভূমিকাটাকে অগ্রাহ্য না করেও যুক্তির গুরুত্বকে মেনে নেওয়া।.. মানুষের দৃষ্টির ব্যাপকতা এবং তাদের পারস্পরিক সংযোগের জোর যেমন যেমন বেড়ে চলেছে, ন্যায্যতার পরিধিটাও তেমন তেমন প্রসারিত হচ্ছে।.. হিউম প্রায়োগিক জ্ঞান, বিশেষত কোনটা কাজ করছে আর কোনটা করছে না, সেই অভিজ্ঞতা প্রসূত জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন (এটি আমাদের সময়কার উন্নয়ন অর্থনীতির একটি প্রধান ব্যাপার)। অধিকতর ন্যায্য একটি পৃথিবীর দিকে এগোনোর চেষ্টায় আমরা হিউমের এই দিকনির্দেশ থেকে লাভবান হতে পারি। এটি কেবল বিভিন্ন রকমের সাহায্য ও সহায়তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, অর্থনৈতিক প্রগতিসহ উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ভূমিকা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এটা খাটে। … তাঁর অন্তর্দৃষ্টি আমাদের শেখায়, যাঁরা এই পৃথিবীর অন্যত্র, আমাদের থেকে বহু দূরে বাস করেন, এমনকি যাঁরা এখনও জন্মাননি, ভবিষ্যতে এই পৃথিবীর বাসিন্দা হবেন, তাঁদের কথা ভাবাও আমাদের দায়িত্ব।’ [ন্যায্যতার পরিধি: ডেভিড হিউম ও আমাদের পৃথিবী, মূল : অমর্ত্য সেন, অনুবাদ: আহমেদ জাভেদ, এ প্রবন্ধটি ডেভিড হিউমের তিনশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত স্মারক বক্তৃতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬) দুজন ভিন্ন সময়ের মানুষ হলেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির ঐকতান লক্ষ্যণীয়। এদিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরালে দেখা যাবে যে, হিউম একটি ন্যায্য বিশ্বের সন্ধানে বৈশ্বিক জ্ঞান (নিজেদের সমাজের বাইরে অন্য সমাজের সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি), তথ্য ও সংবেদনশীলতার পরিধি প্রসারিত করার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথও ভারতবর্ষীয় সমাজের অচলায়তনের পরাকাষ্ঠাকে ভাঙার অভ্যস্ততা ও চেনাজানার বাইরে বিশ্বের নানা প্রান্তের সভ্যতা ও জ্ঞানচর্চার নবতর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন—বিশ্বভারতীতে। ভারতবর্ষে বিশ্বের যে কোনো স্থানের জ্ঞান নিয়ে চর্চা হলে নতুন প্রজন্মের কাছে পৃথিবী হবে নিজের ঘর সদৃশ্য—যেখানে শান্তি ও বিশ্বন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ফলে বিদ্যার্থীর মনে সংবেদনশীলতার সৃষ্টি হবে যা তাকে মানবিক, সদাচারী ও সুবিবেচক নাগরিকে পরিণত করবে।
অমর্ত্য সেনের চিন্তার একটি পদ্ধতি হলো কোনোরকম ‘সর্বশ্রেষ্ঠান্বেষী প্রতিষ্ঠানে’র অনুসন্ধান না করে বাস্তব অবস্থাগুলোর তুলনা করা। অর্থাৎ আদর্শ কোনো কল্পিত অবস্থার কথা ভেবে বাস্তবকে তার সাপেক্ষে বিচার করার প্রচলিত ধারাকে এড়িয়ে অধ্যাপক সেন প্রস্তাব করেন যে, কমপক্ষে দুটি বাস্তব অবস্থার তুলনা করলে এবং সেখান থেকে প্রকট অন্যায্যতাগুলো পর্যায়ক্রমে কমানোর লক্ষ নেওয়া হলে তা আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিভিত্তিক ফলাফলের তুলনায় ভালো ফল দিতে পারে। আর এটি করতে পারলে পৃথিবীটা বিদ্যমান অবস্থার তুলনায় একটু একটু করে ন্যায্য হয়ে উঠতে পারে। এজন্যই তিঁনি ‘দেয়ালঘেরা স্কুল’—সেন্ট গ্রেগরিজ ও ‘দেয়ালবিহীন স্কুল’— শান্তিনিকেতনে তাঁর স্কুলপড়ুয়া জীবনের অভিজ্ঞতার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।
অমর্ত্যর স্কুলজীবন শুরু হয় পুরান ঢাকার ওয়ারীর সেন্ট গ্রেগরিজ থেকে। যদিও এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে তাঁর শৈশব কেটেছে কলকাতা, ঢাকা ও মান্দালয়— এই তিন শহর মিলিয়ে। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ-এ শিশু অমর্ত্য ভর্তি হন তাঁর পিতা অধ্যাপক আশুতোষ সেনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতার চাকরিসূত্রে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটায় বাবা অধ্যাপক আশুতোষ সেনের কাছে ঢাকা নিরাপদ মনে না হওয়ায় ছেলে অমর্ত্যকে কলকাতার পার্শ্ববর্তী বোলপুরের শান্তিনিকেতনে ভর্তি করে দেন। কারণ, তাঁর বাবা ছেলের জন্য যুদ্ধের বাতাবরণে বোলপুরকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ভেবেছিলেন। যদিও শুরু থেকেই মা অমিতা সেনের অভিপ্রায় ছিল ছেলে শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করুক। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর তাঁর এই ইচ্ছা আরও জোরালো হয়। যদিও যুদ্ধ-পূর্ব স্বাভাবিক সময়ে ছেলে ঢাকা ছেড়ে যাক তাতে বাবার সায় ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাসন্ন হওয়ায় বাবা ও মায়ের মত ছেলের স্কুল নির্বাচনের সিদ্ধান্ত একবিন্দুতে মিলে যায়।
আত্মজীবনীতে অধ্যাপক সেন শান্তিনিকেতনে স্কুলের স্মৃতি তুলে ধরেছেন এভাবে:
‘একটা স্কুল যে এত আনন্দের হতে পারে, শান্তিনিকেতনে না এলে আমি বুঝতেই পারতাম না। আমি কী করতে চাই, সে ব্যাপারে ভাববার অনেক স্বাধীনতা ছিল। ক্লাসের অন্যান্য বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগত। বিশেষ করে শিক্ষকরা একেবারে বন্ধুর মতো মিশতেন এবং সিলেবাসের বাইরেও নানা বিষয় নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যেত। সর্বোপরি ধরাবাঁধা নিয়মের গণ্ডি এবং কথায়-কথায় কঠিন শাস্তির ভয় কাজ করত না। … শান্তিনিকেতনের ক্লাসগুলোও ছিল অন্যরকম। বৃষ্টি না হলে বা ল্যাবরেটরির কাজ না থাকলে, সমস্ত ক্লাসই হতো খোলা আকাশের নীচে। … শান্তিনিকেতন অবশ্যই ছিল প্রগতিশীল, এখানে ছেলে ও মেয়েরা একসঙ্গে পড়ত, পাঠক্রম ছিল খুবই প্রসারিত, তাতে ভারতবর্ষের বাইরেও এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছিল।… শান্তিনিকেতনে ক্লাসরুমে এমন একটা আবহ তৈরি হতো যেখানে খুব সহজেই ভারতীয় থেকে আলোচনা শুরু করে সমসাময়িক পশ্চিমা ধ্রুপদী চিন্তাভাবনা হয়ে সোজা চীন-জাপান বা লাতিন আমেরিকা অব্দি চলে যাওয়া যেত। সেসময় ভারতবর্ষের বিদ্যালয় শিক্ষা, উপর থেকে বোঝা না গেলেও, রক্ষণশীলতার গণ্ডিতেই আটকে ছিল। তার বিপরীতে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন সংস্কৃতির সমাহার তাকে করে তুলেছিল স্বতন্ত্র।’ [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাঁথা, পৃষ্ঠা-৪৩]
বিশ্ববীক্ষার প্রশ্নে, বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন সংস্কৃতির সমাহারের প্রশ্নে উপরিল্লিখিত মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার গতিপ্রকৃতির মূল্যায়ন করতে আমাদের এই প্রশ্নটি করতে হবে যে বাংলাদেশে বিদ্যমান শিক্ষাক্রম উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যের সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ?
বাংলাদেশে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অভিমুখ একইসঙ্গে হাজার বছর আগের দার্শনিক ইবনে সিনাহ কিংবা নিকট অতীতের রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের শিক্ষাপদ্ধতির একেবারে বিপরীত। আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববীক্ষা সৃষ্টির পথটি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা হয়েছে। খুব কম শিক্ষকই এমন আছেন যিঁনি নিজে তাঁর জীবনে বিশ্ববীক্ষার ধারণা লালন করেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, বিশ্ববীক্ষা তো বহু দূরের বিষয়, শিক্ষার্থীদের কাছে খোদ বাংলাদেশই অনুপস্থিত। একইসঙ্গে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের শিক্ষায় খোদ বাংলাদেশই অনুপস্থিত, উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশ প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের ধারণা আয়ত্ত্ব করার পর অন্তত আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশগুলোর শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় সেরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি জানার বিশ্ববীক্ষা তো আরও সুদূর পরাহত বিষয়। বিশেষ করে, আমাদের দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষায় ‘বাংলাদেশে’র যে বড্ড অভাব অথবা ‘বাংলাদেশের অনুপস্থিতি’ আমাদের জাতিরাষ্ট্র গঠনে ও এর অভ্যুদয়ে শিক্ষার বিশেষ ভূমিকার সর্বজ্ঞাত বিষয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মনে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের জন্ম একটি প্রগতিশীল বড় ঘটনা হলেও ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে তা যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তাতে চিন্তার বিশ্ববীক্ষা ও বিশ্বন্যায্যতা সম্পর্কে সিনাহ, হিউম, রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেনের মতো দার্শনিকদের চিন্তাকে ভীষণ অবহেলা করা হয়েছে। অথচ এই দার্শনিকদের চিন্তা ও অনুজ্ঞাগুলো বর্তমান সময়েই বেশি প্রাসঙ্গিক। এমন প্রগতিশীল চিন্তাগুলোর প্রতি অবহেলার কারণে একদিকে যেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ চলা বিশ্বের দিকে তাকালে দুঃখিত হতে হয়, তেমনি অন্যদিকে আমাদের দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির করুণ দশার দিকে দৃষ্টি ফেরালেও বেদনার্ত হতে হয়। আমাদের শিক্ষাদর্শনের অন্তঃসারশূন্যতা আমাদের শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়। এখনো দেশে সাধারণ বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়, আরবী-ফার্সি-বাংলামাধ্যমের মাদ্রাসা, ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়সহ বহুধারায় বিভক্ত শিক্ষাক্রম চলছে। আবার বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়গুলোর বিপুল অংশেই এখনও রক্ষণশীলতার কারণে ছেলে ও মেয়েরা একসঙ্গে পড়তে পারে না। আবার ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয় অনেক ক্ষেত্রেই, পাঠ্যক্রমগুলোও ভয়ানক সঙ্কীর্ণ এবং ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবিক-সম্পর্কের পরিবর্তে বাণিজ্যিক-সম্পর্ক বিদ্যমান।
আমাদের সমাজে, বিশেষ করে গোটা উপমহাদেশ জুড়ে মানুষের বঞ্চনা ও নানাবিধ দুর্দশার কথা রবীন্দ্রনাথের লেখায় উঠে এসেছে। রাশিয়া ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার ইজভেস্তিয়া পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে শিক্ষার উপর গুরুত্বের অভাব কীভাবে ভারতবর্ষের সকল দুর্দশার মূলে রয়েছে তা তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মন্তব্যে উঠে এসেছে: ‘[সমগ্র] ভারত উপমহাদেশের বুকের উপর এই পর্বতসম দুর্দশার বোঝা চেপে বসার শেকড় রয়েছে শিক্ষার অভাবের ভেতর।’
নিশ্চিতভাবেই প্রায় শতবর্ষ পূর্বের সমাজের শোষণ ও বঞ্চনা বর্তমান কালের সঙ্গে মিলে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু কারণ খুঁজলে দেখতে পাব যে—‘উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে মৌলিক শিক্ষার ভূমিকা যেমন ব্যাপক তেমনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।.. রবীন্দ্রনাথ জাপানের আর্থিক উন্নতি সাধনের পেছনে, তাদের সুসংগঠিত স্কুলগুলোর ভূমিকা যে অনেকটাই সেকথা উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীকালে বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘের আর্থিক উন্নয়ন সম্পর্কিত লেখায় সেকথারই প্রতিধ্বনি করেছে।’ [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাঁথা, পৃষ্ঠা-৬৩]
অমর্ত্য সেন সত্যকে জানতে ও বুঝতে যে পরিমাণ অধীর ও ঐকান্তিক আগ্রহ নিয়ে ছুটে চলেছেন এবং জীবনভর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজেকে নিবেদিত করে যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন তা এককথায় অতুলনীয়। স্মৃতিকথায় তিঁনি নিজের দর্শনকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব রচনায় শিক্ষার এই অন্তর্ভূক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির দর্শনই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বিশ্বসভ্যতার এই একক বৃক্ষটি সমগ্র মানবজাতির বহু শত সহস্র বছরের অভিজ্ঞতা ও শ্রম সাধনায় তিলে তিলে গড়ে উঠেছে। পৃথিবীতে এপর্যন্ত যত মানুষ জন্মেছে ও যত ধরনের সম্প্রদায় এসেছে তারা পরস্পর আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরষ্পরের কাছ থেকে যা কিছু শিখেছে তার সবটা মিলে এই বিশ্বসভ্যতা গড়ে উঠেছে। ‘রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্বসভ্যতাকে ভারতের অভিজ্ঞতায় ধারণ করার জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে এই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন।’ তিঁনি বিশ্বাস করেন, জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতার এই বিনিময়ের মাধ্যমে বিশ্বসভ্যতা বিভিন্ন জায়গায় তার শেকড় ও শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিয়েছে। এই বিশ্বসভ্যতাই নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় ফুল ফুটিয়ে পৃথিবীকে বৈচিত্রময় করে তুলেছে।
অমর্ত্য সেনের শিক্ষাচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা না বললেই নয়। ‘শিক্ষার মৌলিক গুরুত্ব’ নিয়ে আলোচনায় অমর্ত্য ও জঁ দ্রেজ বলেছেন, উপমহাদেশের অধিকাংশ দেশেই শিক্ষার গুরুত্বের বিষয়টি রাজনৈতিক দলের দাবি হয়ে ওঠেনি। তাঁর মতে, সমাজ রূপান্তরে রাজনৈতিক দলের ইশতেহার ও তাদের শাসনকালের ফলাফল মূল্যায়নে শিক্ষার মানের অগ্রগতিকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিতে হবে। তিঁনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এত বিরাট একটা সমস্যাকে দূর করতে জনপরিসরে আলোচনা ও সামাজিক যুক্তিপ্রয়োগের মাত্রাটা বহুগুণে বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।’ [ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা, শিক্ষার গুরুত্ব, পৃষ্ঠা-১৫৬]
লেখাটি শেষ করব রবীন্দ্রনাথের গানের কথা দিয়ে। রবীন্দ্রদর্শনের নির্যাসটি তাঁরই রচিত গানের মাধ্যমে সকলের হৃদয়ে সঞ্চারিত হবে বলে বিশ্বাস।
‘‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।।
নয়কো বনে নয় বিজনে
নয়কো আমার আপন মনে।।
সবার যেথায় আপন তুমি
হে প্রিয়
সেথায় আপন আমারও
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার।।
সবার পানে যেথায় বাহু পসারওৎ
সেইখানেতেই প্রেম জাগিবে আমারও।।
গোপনে প্রেম রয় না ঘরে
আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে।।
সবার তুমি আনন্দধন
হে প্রিয়
আনন্দ সেই আমারও।।
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার
সেইখানে যোগ তোমারসাথে আমারও।।’’
লেখক: শিক্ষক ও সংগঠক। বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। বর্তমানে সিটি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত।
ইমেইল: ronieleo@gmail.com