লাশ এখনও না মিললেও কলকাতায় বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার যে খুন হয়েছেন, তা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের কর্মকর্তাদের তরফেই বলা হচ্ছে।
কলকাতার গোয়েন্দাদের উদ্ধৃতি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রে খবর এসেছে, শ্বাসরোধে হত্যার পর খণ্ড খণ্ড করা হয় আনারের লাশ।
আনারকে হত্যায় বাংলাদেশিরা জড়িত বলে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা দাবি করছেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সোনা চোরাচালান নিয়ে দ্বন্দ্বের কথাই আসছে ঘুরেফিরে।
ভারত সীমান্তের জেলা ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগের তিন বারের সংসদ সদস্য আনার (৫৬) চোরাচালান চক্রে ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও ছিল। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি এক সময় ভারতেও পালিয়ে ছিলেন।
চিকিৎসার কথা বলে গত ১২ মে ভারতে গিয়েছিলেন আনার; সেদিন তিনি উঠেছিলেন বরাহনগরের সিঁথি এলাকায় গোপাল বিশ্বাস নামে এক সোনা ব্যবসায়ীর বাড়িতে। তিনি ছিলেন আনারের বন্ধু।
গোপালের ভাষ্য অনুযায়ী, পরদিন দুপুরে চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে আনার বেরিয়েছিলেন ভাড়া করা একটি গাড়িতে। তারপর তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
ঢাকা থেকে আনারের মেয়ে ১৭ মে বাবার খোঁজ না পাওয়ার কথা গোপালকে জানালে পরদিন তিনি বরাহনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
তার সূত্র ধরে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ কলকাতার নিউ টাউনের অভিজাত ভবন সঞ্জিবা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পায়। বুধবার সেখানে তল্লাশি চালিয়ে জানায়, আনারকে এই ফ্ল্যাটেই হত্যা করা হয়।
ওই ফ্ল্যাটে আনারের লাশ না পেলেও সেখানে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ পাওয়ার কথা জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্মকর্তারা।
কলকাতার দৈনিক সংবাদ প্রতিদিনে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ১৩ মে নিউ টাউনের ওই ফ্ল্যাটেই শ্বাসরোধে খুন করা হয় আনারকে। এরপর টুকরো টুকরো করে কাটা হয় মরদেহ। ১৬ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত তিন দিন ধরে দেহের খণ্ডিত অংশগুলো অন্য স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়।
ওই ফ্ল্যাট থেকে প্লাস্টিক ব্যাগ উদ্ধারে খবর দিয়ে সংবাদ প্রতিদিনে লেখা হয়েছে, পুলিশের অনুমান, প্লাস্টিক ব্যাগে ভরেই দেহাংশ বিভিন্ন জায়গায় ফেলা হয়েছে। তবে দেহাংশ কারা ফেলে রেখেছে, কোথায় ফেলা হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
আনার নিখোঁজের জিডির সূত্র ধরে ঘটনার তদন্ত এখন চালাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। সংস্থার আইজি অখিলেশ কুমার চতুর্বেদী বুধবার সঞ্জিবা গার্ডেন্সে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, সন্দীপ রায় নামে একজন শুল্ক কর্মকর্তার এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান নামে একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
আখতারুজ্জামান বাংলাদেশি কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি চতুর্বেদী।
নেপথ্যে সোনা চোরাচালান?
যে আক্তারুজ্জামানের নাম পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখে এসেছে, সেই তিনি আনারের এক সময়কার বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহিন বলে বাংলাদেশি গোয়েন্দারা মনে করছেন।
আখতারুজ্জামানের বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে। তবে তিনি অনেকদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকছেন বলে জানা যায়।
ঝিনাইদহ এলাকায় ঘিরে চোরাচালানের চক্রে আনারের জড়িত থাকার অভিযোগ বেশ পুরনো।
বাংলাদেশে এই ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সংসদ সদস্য আনারের ব্যবসা ও ব্যক্তিগত জীবন ততটা স্বচ্ছ ছিল না। তিনি এক সময় ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ছিলেন। স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক ব্যবসাসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।”
২০০৯ সালে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর আনার তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি পেতে থাকেন। তারপর ২০১৪ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবার তৃতীয় দফায় সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সোনা ও অস্ত্র চোরাচালানের পৃষ্ঠপোষকতা তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনা চোরাচালানের আন্তঃদেশীয় চক্রের দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে আনারকে ভারতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
খুনের পরিকল্পনা কমপক্ষে এক মাস আগে হয়েছিল দাবি করে সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, এতে জড়িত অন্তত তিনজন ঘটনার ১৩ দিন আগে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যান। তারও আগে যান দুজন। এর মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহিন।
আনার পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার- একথা বুধবারই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সেই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, এতে জড়িত সন্দেহে বাংলোদেশ পুলিশ তিনজনকে আটক করেছে; যদিও তাদের পরিচয় তিনি প্রকাশ করেননি।
চোরাচালানের পাশাপাশি ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া অঞ্চলে এক সময় সক্রিয় চরমপন্থিদের সঙ্গেও আনারের সখ্য থাকার খবর স্থানীয় সূত্রে পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তিনি (আনার) চোরাচালান সিন্ডিকেটের একটি বিশেষ বৈঠকে যোগ দিতেই কলকাতা গিয়েছিলেন এবং সেখানেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “মূলত হত্যার মোটিভ ও জড়িতদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহে এখন জোর দেওয়া হচ্ছে। সংসদ সদস্যের হত্যার পেছনে রাজনৈতিক ও স্থানীয় বিরোধ আছে কি না, সে বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে আগে।
“এজন্য তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। সন্দেহ করার মতো অনেকগুলো বিষয় ইতিমধ্যে সামনে এসেছে। তবে হত্যার মোটিভ ও হত্যাকারীদের ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলার মতো সময় এখনও আসেনি।”
আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বুধবারই ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেছেন। সেখানে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশও তদন্ত করছে গোপালের জিডির সূত্র ধরে।
ঘটনাস্থল ভিন্ন দেশে হওয়ায় মামলা ও তার তদন্ত প্রক্রিয়া কী হবে, তা নিয়েও চলছে জোর আলোচনা। তবে দুই দেশের পুলিশ কর্মকর্তারাই তদন্তের বিষয়ে কৌশলী জবাব দিচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির মহাপরিদর্শক অখিলেশ চতুর্বেদী বলছেন, “আনোয়ারুল আজীমকে খুন করা হয়েছে বলে আমরা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছি। কিন্তু আমরা তদন্তে এসে শনাক্ত করা ফ্লাটে তার মরদেহ পাইনি।”
ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশিত হয়ে সিআইডি তদন্তে নেমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট থেকে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে।
আনারের নিখোঁজ ও হত্যার রহস্য উদঘাটনে ভারত ও বাংলাদেশের পুলিশ যৌথ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি।”
এদিকে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানার ওসি মু. আহাদ আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এমপি আনার হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এখন তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ বিষয়ে বলার মতো অন্য কোনও তথ্য এখন নেই।”