সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মৃত্যুর কারণ হিসাবে এতদিন ধরে সোনা চোরাচালান নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি আলোচনায় থাকলেও এখন রাজনৈতিক বিরোধই প্রাধান্য পাচ্ছে তদন্তে।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুকে গ্রেপ্তারের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কথায় তেমন ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, আনার সোনা চোরাচালানে জড়িত ছিলেন, এমন তথ্য তার কাছে নেই। এর সঙ্গে ঝিনাইদহে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কথাও আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়।
আনার খুনের তদন্ত চালিয়ে আসা গোয়েন্দা পুলিেশর কর্মকর্তা, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদও বলেছেন, তদন্তে পাওয়া তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতেই বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাবুর পর ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকেও আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন ডিবি কর্মকর্তারা।
ঝিনাইদহ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনার গত ১২ মে কলকাতায় যাওয়ার পরদিন খুন হন বলে ভারতের পুলিশ জানিয়েছে। আনারের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। বলা হচ্ছে, আনারকে খুন করার পর লাশ টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়।
নিজ দেশে প্রতিবেশী দেশের আইনপ্রণেতা খুনের ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে ভারতের সিআইডি। একজনকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি যে ফ্ল্যাটে আনারকে খুন করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকে কিছু মাংস ও হাড় উদ্ধার করেছে। সেগুলো আনারের কি না, তা নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশেও গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে শুরুতেই গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। তাদের মধ্যে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিমুল ভূইয়া রয়েছেন।
আনার খুনের ‘হোতা’ হিসাবে যাকে ডিবি চিহ্নিত করেছে, সেই আক্তারুজ্জামান শাহিন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র, আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুজ্জামান সেলিমের ভাই।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহিনের সঙ্গে সোনা চোরাচালান নিয়ে দ্বন্দ্বে আনার খুন হন বলে ভারতের গোয়েন্দাদের উদ্ধৃত করে দেশটির সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। আনারের বিরুদ্ধেও সোনা চোরাচালানের অভিযোগ ছিল।
এদিকে বাংলাদেশে ডিবি ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগ নেতা বাবুকে গ্রেপ্তার করেছে। ক্ষমতাসীন দলের আরও কয়েকজন নেতাকে খোঁজা হচ্ছে বলেও ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার ঢাকার রাজারবাগে পুলিশের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, “অনেকেই গ্রেপ্তার হতে পারেন। এখনও তদন্ত চলমান।”
চোরাচালানের দ্বন্দ্বই হত্যাকাণ্ডের কারণ কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিল এমপি আনার, তা আমরা কখনোই বলিনি।
“আমরা সবসময় বলে আসছি, ঝিনাইদহ সন্ত্রাসপূর্ণ একটি এলাকা। ওখানে সত্যিকারে কী হয়েছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। আমরা এ ঘটনার তদন্ত করছি, তদন্তের পর আপনাদের সবকিছু জানাব।”
যুবক বয়সে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়া আনার অর্থ ও প্রভাব বলয়ে ৫৬ বছর বয়সে হয়ে ওঠেন ঝিনাইদহের রাজনীতিতে প্রতাপশালী। পৌর কাউন্সিলর, পৌর চেয়ারম্যান হওয়ার পর ২০১৪ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য হন। এরপর টানা তৃতীয় মেয়াদে এবার নির্বাচিত হন তিনি। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি ছিলেন আনার।
আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন সন্দেহভাজন কয়েকজনের নাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন বলে জানা গেছে।
কাদের নাম বলেছেন- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান কামাল উত্তর এড়িয়ে বলেন, “যখন তদন্ত চলে, তখন আমাদের মন্ত্রী, আইজিপি কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের পক্ষে তদন্ত না করে কোনও কিছুই বলা সম্ভব না। আমরা মনে করি তদন্ত শেষ হলে এগুলো নিয়ে কথা বলব। অনেকের নাম আসতে পারে, অনেকে গ্রেপ্তার হতে পারেন।”
ডরিন তার বাবাকে হত্যার উদ্দেেশ্য অপহরণের অভিযোগে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় যে মামলা করেছেন, তা ধরেই চলছে ডিবির তদন্ত।
এই মামলায় বাবুকে গ্রেপ্তারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করছেন ডিবি কর্মকর্তারা। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তির সূত্র ধরে এ ঘটনার তদন্ত ভিন্ন দিকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এমন কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যা রাজনৈতিক বিরোধকে ইঙ্গিত করছে।
“হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটনে আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ ও গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তবে এ মূহূর্তে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে মরদেহ উদ্ধার ও ডিএনএ টেস্টকে। যার জন্য ভারতের তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে।”
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রেপ্তার শিমুল ভূইয়া ও শিলাস্তি রহমানের জবানবন্দিতে বেশ কিছু নতুন তথ্য মিলেছে, যা যাচাই করতে গিয়ে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সামনে আসে। আনারের মেয়েও কয়েকজনের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
বাবুসহ চারজনের মোবাইলের ফরেনসিক পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে ডিবি। তারা মোবাইলে থাকা ছবি, ভিডিওসহ অপহরণ ও খুন-সংক্রান্ত কোনও তথ্য মুছে ফেলেছেন কি না, সেটি জানার চেষ্টা চলছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, “এমপি আনারকে হত্যার পর তার ছবি শিমুল ভূঁইয়া এদেশে থাকা পরিকল্পনাকারীদের কাছে পাঠিয়ে দেন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। বাবু তার তিনটি মোবাইল ফোন হারিয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন। তিনি এ বিষয়ে ঝিনাইদহে জিডি করেছেন। আলামত ধ্বংসের পর তিনি নিজেকে রক্ষায় মোবাইল হারানোর নাটক করছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।”
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন মঙ্গলবার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ডিবির ওয়ারি বিভাগ এই ঘটনার তদন্ত করছে।
খুনের পর আসামিরা কার কার কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছিল, সেটাই এখন খুঁজে বের করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
হারুন বলেন, “কিলিং মিশনে যারা অংশ নিয়েছিল, কলকাতা থেকে এমপি আনারের ছবি হোয়াটসঅ্যাপে কার সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে এবং এতে কোনও আর্থিক সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, সব বিষয়ে তদন্ত চলছে।”
আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সকল তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে মনে করেছি, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। এজন্য তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে এনেছি। তার রিমান্ড চলছে, তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি।”
হারুন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর বিকালে ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকা থেকে ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টুকে আটকের খবর আসে।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “আক্তারুজ্জামান শাহীনের সাথে সাইদুল করিম মিন্টুর যোগাযোেগর কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। আনারের মোবাইল নম্বর থেকে সর্বশেষ যে কয়েকজনকে কল ও মেসেজ দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম মিন্টু।”
ডিবির বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পরিকল্পনা সাজিয়ে কলকাতায় গিয়ে আনারকে হত্যা করা হয়। খুনের পর শাহিন দেশে ফিরেছিলেন। পরে ভারত, নেপাল হয়ে যুক্তরােষ্ট্র চলে যান। শিলাস্তি, শিমুল ভূইয়া এবং দেেশ গ্রেপ্তার আরেকজন তানভির ভূইয়া দেশে ফিরে আসেন।
এই খুনে জড়িত অভিযোগে কলকাতায় গ্রেপ্তার হন আরেক বাংলাদেশি জিহাদ হাওলাদার। এছাড়া নেপালের কাঠমান্ডুতে গ্রেপ্তার হন সিয়াম হোসেন নামে আরেক বাংলাদেশি। তাকে ভারতের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান হারুন।
তদন্তের প্রয়োজনে এর আগে ভারত ও নেপাল ঘুরে আসা হারুন বলেন, প্রয়োজনে সিয়ামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও ভারতে পুনরায় যাবেন তিনি।
আনার হত্যাকাণ্ডের পর দুই কোটি টাকা লেনদেনের যে খবর আসছে, সে বিষয়ে হারুন বলেন, “এগুলো আমরাও শুনেছি, সবকিছু তদন্ত করছি।”
এদিকে আক্তারুজ্জামান শাহীনের দুটি গাড়ি ঢাকার গুলশান থেকে জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। শাহীনের ভাড়া করা একটি বাসার গ্যারেজে টয়োটা প্রাডো ও মাইক্রোবাসটি ছিল।