আলোচনায় ছিল সোনা চোরাচালান; এর মধ্যেই এল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সন্দেহ; সেই পথ ধরে আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডে ঘটনায় গ্রেপ্তার হলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। এখন তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনার জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনবার সংসদ সদস্য হন তিনি। গত ১২ মে ভারত যাওয়ার পরদিন তিনি কলকাতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বলে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি জানিয়েছে, যদিও তার লাশ এখনও পাওয়া যায়নি।
আনার খুনের হোতা হিসাবে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র, আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুজ্জামান সেলিমের ভাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহিনকে চিহ্নিত করে ডিবি। ভারতের সংবাদ মাধ্যমে খবর আসে, সোনা চোরাচালান নিয়ে শাহিনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে খুন হন আনার।
এরই মধ্যে গত ১১ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ইঙ্গিত দেন, ঝিনাইদহের রাজনৈতিক কোন্দল দলীয় এমপি হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে। তার ঠিক আগেই গ্রেপ্তার হন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলার পরপরই গ্রেপ্তার করা হয় ঝিনাইদহে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা মিন্টুকে।
আদালতের অনুমতি নিয়ে বৃহস্পতিবার তাকে আট দিনের জন্য হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদও শুরু করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মিন্টুকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ- এই প্রশ্নে ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তার চারজনের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা মিলিয়ে দেখার জন্যই মিন্টুকে রিমান্ডে আনা হয়েছে।
আনারকে অপহরণ ও খুনের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবেও মিন্টুও চলে আসতে পারেন বলে তারা ধারণা করছেন। তবে এবিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ সরাসরি এখনই কিছু বলতে চাইছেন না।
তিনি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “আনার হত্যায় সরাসরি যুক্ত বলে জবানবন্দি দেওয়া আসামিদের মাধ্যমে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নাম এসেছে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
“চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় কে জড়িত, আর কে জড়িত নয়, তা বলার সময় এখনও আসেনি। দুই দেশে পৃথক মামলায় তদন্ত চলমান। তাতে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।”
বলা হচ্ছে, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিবা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে আনারকে খুন করা হয়। সেখানে কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে, তার মধ্যে কিছু মাংসের টুকরা ও হাড়ও রয়েছে। সেগুলো আনারের কি না, তা নিশ্চিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন ভারতে যাচ্ছেন বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন।
ডরিন এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বাবার খুনি হিসাবে সন্দেহভাজন কয়েকজনের নাম জানিয়েছেন। তবে সেই নামগুলো প্রকাশ পায়নি।
মিন্টু জড়ালেন কীভাবে
গত ২২ মে আনার খুনের খবর ভারতের সংবাদ মাধ্যমে আসার পর শাহিনকে ঘিরেই গড়াচ্ছিল আলোচনা। প্রায় তিন সপ্তাহ পর আসে মিন্টুর নাম।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা কাজী কামাল আহম্মেদকে (গ্যাস বাবু) জিজ্ঞাসাবাদে মিন্টুর নাম আসে। আবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া শিমুল ভুঁইয়ার জবানবন্দিতেও মিন্টুসহ কয়েক নেতার নাম এসেছে।
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, কলকাতার ফ্ল্যাটে খুন করার পর এমপি আনারের লাশের ছবি তোলা হয় চেয়ারে বসিয়ে। তখন তার হাত-পা ও মুখ বাঁধা ছিল। সেই ছবি বাবুর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠিয়েছিলেন শিমুল ভুঁইয়া। বাবু পরে সেই ছবি মিন্টুকে দেখিয়েছিলেন।
এরপর ছবি ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের আলামত মুছে ফেলতে বাবুর ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল গায়েব করে দেওয়া হয় বলে ডিবি জানিয়েছে। বাবু নিজেই মোবাইল হারানোর কথা বলে জিডি করেন।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনায় শুধু বাবুই নয়, আড়াল থেকে শাহিনের সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আরও অনেকে। শিমুল ভূঁইয়ার মোবাইলে এসব নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগের প্রমাণ রয়েছে।
আনার খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে দেশে প্রথমেই গ্রেপ্তার হন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিমুল ভূইয়া, তার ভাতিজা তানভির ভূইয়া এবং শাহিনের কথিত বান্ধবী শিলাস্তি রহমান। তারা সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
নির্দোষ দাবি মিন্টুর
সাইদুল করিম মিন্টুকে বৃহস্পতিবার আদালতে তোলা হলে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।
আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে তার মেয়ে ডরিন ঢাকায় যে মামলা করেন, মিন্টুকে সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালতে তোলে ডিবি।
শুনানি শেষে তাকে আট দিন রিমান্ডের আদেশ দেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন। মিন্টুর পক্ষে জামিন আবেদন করা হলেও তা নাকচ করেন তিনি।
শুনানির সময় আদালতের জিজ্ঞাসায় মিন্টু বলেন, “আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আজ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছি। ৪৬ বছরের রাজনীতিতে আমার খুন খারাবির কোনও রেকর্ড নেই।”
রাজনৈতিক কারণে তাকে ফাঁসানো হচ্ছে দাবি করে মিন্টু বলেন, “রাজনীতির কারণে আমি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছি। ওয়ান-ইলেভেনে গ্রেপ্তার হয়েছি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছি। এখন মনোনয়ন চাওয়ায় আমার অপরাধ হয়েছে।”
আনারের আসনে ছিল মিন্টুর চোখ
সাইদুল করিম মিন্টু স্বল্প শিক্ষিত হলেও কিশোর বয়স থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত। তিনি ১৯৮৩ সালে ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, পরের বছর সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৯ সালে তিনি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন।
ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে এলাকায় আলোচিত হলেও পরে তিনি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। রাজনীতির ধারাবাহিকতায় তিনি এক পর্যায়ে জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাতে পরিণত হন। এক পর্যায়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
জনপ্রতিনিধি হিসেবেও মিন্টু নানাভাবে আলোচিত। ২০০৮ সালে তিনি নিজ এলাকা ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেন। সেখানে পরাজিত হওয়ার পর এলাকা ছেড়ে ঝিনাইদহ শহরে বসবাস শুরু করেন। ২০১১ সালে তিনি ঝিনাইদহের পৌর মেয়র নির্বাচিত হন। মামলা জটিলতায় ভোট না হওয়ায় মেয়রের পদে টানা ১১ বছর কাটিয়ে দেন তিনি।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্স এবং দোকান মালিক সমিতির সভাপতিও।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মিন্টু ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। সেসময় জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপু নৌকা প্রতীক পেলে মিন্টু দলের জেলা কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।
২০১৪ সালেও একই আসনে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন মিন্টু। দলের প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করলেও তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।
এবার তিনি চেষ্টা করতে থাকেন ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে মনোনয়ন পেতে। কিন্তু ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন আসনে প্রার্থী বদল হলেও মিন্টু কখনোই মনোনয়ন পাননি আওয়ামী লীগ থেকে।
ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনে ২০১৪ সাল থেকে আনারই নৌকার মনোনয়ন পেয়ে আসছিলেন এবং জিতেও যাচ্ছিলেন। যুবক বয়সে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ নিয়ে থাকা আনার পৌর কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান হওয়ার পর এমপি হন। ঝিনাইদহের রাজনীতিতেও প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিলেন।
আনার খুনের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মূলত সংসদ সদস্য হওয়ার ইচ্ছে থেকেই মিন্টু জড়িয়ে যেতে পারেন আনার হত্যাকাণ্ডে। যদিও রাজনৈতিকভাবে এমপি আনারের সঙ্গে তার সখ্যের তথ্যই বেশি মিলছে। কমিটি গঠন নিয়ে কিছু বিরোধ হলেও তা মিটে গেছে কয়েকবার।
মিন্টু সর্বশেষ ঝিনাইদহ-১ (শৈলকূপা) আসনে উপনির্বাচনেও প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইয়ের মৃত্যূতে সেখানে উপনির্বাচন হয়। তবে এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন নায়েব আলী জোয়ার্দ্দার।