Beta
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

সড়ক শীতল রাখার পথ দেখাচ্ছে ৩ হাজার বছর পুরনো পদ্ধতি

স্পেনের সেভিয়ার কার্তুজা দ্বীপে প্রাচীন পারস্যের সুড়ঙ্গ খাল থেকে অনুপ্রাণিত প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনারের একটি পরীক্ষামূলক স্থাপত্য।
স্পেনের সেভিয়ার কার্তুজা দ্বীপে প্রাচীন পারস্যের সুড়ঙ্গ খাল থেকে অনুপ্রাণিত প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনারের একটি পরীক্ষামূলক স্থাপত্য।
[publishpress_authors_box]

স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সেভিয়ায় গত গ্রীষ্মে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। গত বছরের ওই অসহনীয় তাপপ্রবাহের নাম দেওয়া হয় হিটওয়েভ ইয়াগো। এটি ছিল শহরটির দ্বিতীয় নামকরণকৃত তাপপ্রবাহ।

২০২২ সালেও এমন গরম পড়েছিল শহরটিতে, তখন তার নাম দেওয়া হয়েছিল হিটওয়েভ জো। তাপপ্রবাহের তীব্রতা স্মরণীয় করে রাখতেই এই নামকরণ। বিশ্বের মধ্যে স্পেনেই প্রথম তাপপ্রবাহের এমন নামকরণ করা হয়।

ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশের শহরগুলোর মতো সেভিয়ার বাড়িঘর-অবকাঠামো এতো বেশি তাপমাত্রার কথা মাথায় রেখে বানানো হয়নি। তাই শহরটির এতো উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করার সক্ষমতা নেই।

২০২২ সালের গ্রীষ্মে লন্ডনে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে আগুন লেগেছিল বাড়িঘরে। এছাড়া বেঁকে গিয়েছিল রেললাইন, গলে গিয়েছিল বিমানবন্দরের টারমাক। প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে জার্মানরা ২০২৩ সালের জুলাই মাসে দিনের মধ্যভাগে (২টা-৫টার মধ্যে) কাজকর্ম বন্ধ রাখার প্রথা চালু করার কথা ভাবতে শুরু করেন।

মোটা দাগে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় শীতল আবহাওয়ায় অভ্যস্ত শহরগুলো এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার না করে বিকল্প উপায়ে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উপায় খুঁজছে। যাতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনও গ্যাস নির্গমন ছাড়াই সমস্যা সমাধান করা যায়।

এজন্য সেভিয়ার একটি ছোট গবেষক দল ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন এক পদ্ধতি থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছেন। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগেই যেখানকার বাসিন্দারা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করেই এমন তাপ মোকাবেলা করতেন।

কেউ কেউ তাদের এই প্রচেষ্টাকে প্রাচীন চিন্তাবিদদের প্রজ্ঞার প্রতি সম্মান প্রদর্শন হিসেবে দেখছেন। তবে অনেকে বলছেন, এই পুরোনো পদ্ধতিগুলো প্রযুক্তির চেয়েও আরও বেশিকিছু। প্রাচীন প্রযুক্তিগুলো পরিবেশ দূষণ করত না এবং টেকসইও ছিল। জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় এখন সে ধরনের টেকসই প্রযুক্তিরই প্রয়োজন।

৩ হাজার বছরের পুরনো মধ্যপ্রাচ্যের এই ভূগর্ভস্থ পানি প্রবাহের সুড়ঙ্গ খালভিত্তিক প্রযুক্তির নাম কানাত। মানুষের তৈরি এই ভূগর্ভস্থ জল-প্রণালি প্রযুক্তিকে আধুনিক বিশ্বে পুনরুজ্জীবিত করতে চেষ্টারত অল্প কয়েকজন বিশেষজ্ঞের একজন মজিদ লাব্বাফ খানেইকি।

‘মানুষ ও প্রকৃতির বিশেষ সম্পর্ক’

প্রাচীনকালের কানাত টানেলগুলো গাইতি, শাবল ও বেলচা দিয়ে হাতে খুড়ে তৈরি করা হতো। চীন, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আফগানিস্তানসহ বিশ্বের ৩৫টি দেশে এখনও সেগুলোর নিদর্শন পাওয়া যায়।

তবে পণ্ডিতদের অনুমান, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে বা প্রায় ৩ হাজার বছর আগে পারস্যের মানুষেরা সর্বপ্রথম কানাত নামের এই পদ্ধতি তৈরি করেন। এরপর তা সারা বিশ্বের শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রাচীন এই পদ্ধতিতে মরুভূমিতে মাটির ২০ থেকে ২০০ মিটার গভীরে সুড়ঙ্গ খালের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হতো, যার সাহায্যে উপর থেকে নীচের দিকে পানি প্রবাহিত করানো হতো। ঢালুভাবে নির্মিত সুড়ঙ্গ খালগুলো পানি পরিবহনের জন্য মধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্যবহার করত। কুয়ার মতো একাধিক উল্লম্ব খাদ সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো।

প্রথমে কুয়ার মতো একটি গর্ত খোড়া হতো। যতক্ষণ পর্যন্ত পানির স্তর না পাওয়া যেত ততক্ষণ পর্যন্ত (২০-২০০ মিটার পর্যন্ত) কুয়াটি নিচের দিকে খোড়া হতো। পানি পাওয়া গেলে সেই পানি প্রবাহিত করে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেখান থেকে ঢালু করে সুড়ঙ্গ খাল খোড়া হতো। সুড়ঙ্গ খাল বরাবর মাটির উপরে কিছু দূর পরপর কুয়ার মতো খাদ খোড়া হতো প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহারের জন্য বা বাতাস চলাচলের জন্য। সুড়ঙ্গে থেকে বের হয়ে আসা বাতাস মাটির উপরের তাপও কমাতো।

এভাবে কখনও পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খালের নেটওয়ার্ক তৈরি করে পানি নিয়ে যাওয়া হতো লোকালয়ে, গ্রামে, শহরে বা আবাদি জমিতে। আবার কখনও মরুভূমি অঞ্চলে পানিপ্রবাহের জন্য এই সুড়ঙ্গ খালের নেটওয়ার্ক তৈরি করা হতো। উপর থেকে একে মরুভূমির মাঝখানে হাজার হাজার সারিবদ্ধ উইঢিবি বা পিঁপড়ার বাসার মতো দেখাতো।

পারস্যবাসীরা এর প্রথম ধারণা পান তামার সন্ধানে থাকা খনি শ্রমিকদের খনন করা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত স্থায়ী পানিপ্রবাহ দেখে। পারস্যের কৃষকরা ওই খনি শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের কৃষিজমিতে পানি সরবরাহের জন্য আরও সুড়ঙ্গ খনন করার অনুরোধ জানান। খনি শ্রমিকরা তা করতে রাজি হয়েছিল, কারণ আরও সুড়ঙ্গ খাল নির্মাণে খনি শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত কোনও অসুবিধা ছিল না।

এই পদ্ধতিতে প্রাচীন ইরানিরা খনি শ্রমিকদের প্রয়োজন ছিল না- এমন পানি ব্যবহার করতেন এবং তাদের কৃষি জমিতে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের জন্য কানাত নামে একটি মৌলিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই উদ্ভাবন বর্তমান ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল এবং পরে প্রতিবেশী অঞ্চলে চালু হয়েছিল, যা তখন জাগ্রোস পর্বতমালা নামে পরিচিত ছিল।

৪৯ বছর বয়সী খানেইকি ওমানের নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওহাইড্রোলজির অধ্যাপক। তার পুরো কর্মজীবন ব্যয় হয়েছে শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক পরিবেশে ভূপৃষ্ঠের নীচ দিয়ে পানি বহনকারী এই প্রাচীন সুড়ঙ্গ খালগুলো নিয়ে গবেষণা করে। তার বাবাও প্রত্নতত্ত্বের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন এবং ছোটবেলায় তাদের বাড়ি ইতিহাসের বইয়ে পূর্ণ ছিল।

খানেইকির পরিবার পূর্ব ইরানের কানেক নামের একটি ছোট গ্রামের বাসিন্দা, যেখানকার আবহাওয়া ছিল শুষ্ক। গ্রামের নামটিই তার নামের শেষ অংশের ভাষাগত উৎস। খানেইকি ছোটবেলায় সেখানে কয়েকবছর গ্রীষ্মকাল কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, “গ্রামটিতে একমাত্র পানির উৎস ছিল একটি কানাত। এটি সরাসরি গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, যা দেখতে মরুভূমির মাঝখানে একটি সবুজের মরূদ্যানের মতো ছিল।”

খানেইকি বলেন, “কানাতটি আসলে মানুষের আড্ডা দেওয়া এবং জমায়েত হওয়ার একটি জায়গাও ছিল। আমার মনে আছে, আমি ঠিক সেই জায়গায় অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করতাম এবং আমরা সেখানে খেলতাম।

“কানাতের উপরিভাগ জনসভার স্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। হয়তো সে কারণেই আমি এটি নিয়ে এত আগ্রহী, কারণ এটি আমার পরিচয় ও ব্যক্তিত্বের একটি অন্তর্নিহিত অংশ।”

কানাতকে শুধু অতীত নয় বরং ভবিষ্যতের ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠায়ও আশাবাদী খানেইকি। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, “আমার শেষ নাম হওয়া উচিৎ ছিল কানাত নির্মাতা।”

খানেইকি বলেন, “কানাত শুধু মাটির নিচে একটি সুড়ঙ্গ নয়। এটি একটি জীবনযাপনের পদ্ধতিও।”

প্রাচীন কানাত ব্যবস্থা মরুভূমির পরিবেশে কৃষি সেচ এবং কৃষির বিকাশ সম্ভব করে তোলে। একে ইরানের বিকেন্দ্রীকৃত পানি ব্যবস্থাপনার ভিত্তি হিসেবেও দেখা হয়। আধুনিক পাম্পিং ও বাঁধের চেয়েও টেকসই সমাধান মনে করা হয় এই ব্যবস্থাকে।

খানেইকি বলেন, “কানাত সিস্টেম জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার উদ্দেশ্যেও পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে।”

প্রাচীন চীনেও এই কানাত ব্যবস্থা ছিল। দেশটিতে প্রায় ৮০০টি কানাত পাওয়া যায়। বিভিন্ন কানাত ব্যবস্থার ইতিহাস এবং প্রকৌশল নিয়ে একটি জাদুঘরও তৈরি করেছে চীন।

ইরান থেকে এই প্রকৌশল আরব অঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকা হয়ে স্পেন এবং স্পেনীয়দের মাধ্যমে আমেরিকায়ও ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্বের প্রায় ৩৫টি দেশে বর্তমানে কানাতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় এবং একেক দেশে এর একেক নাম দেওয়া হয়েছিল।

কানাত সিস্টেম আফগানিস্তানে কারেজ, স্পেনে গ্যালেরিয়া, মরক্কোতে খোতারা, আরব উপদ্বীপে আফলজ, উত্তর আফ্রিকায় ফোগারা, চীনে কানেরজিং এবং সৌদি আরব ও মিশরে আওন নামে পরিচিত। প্রাচীন রোমানরাও কানাত প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন।

ইরানে প্রায় ২২ হাজার কানাত তৈরি করা হয়েছিল, যেগুলোতে মাটির নিচ দিয়ে মোট ২ লাখ ৭৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ খালের নেটওয়ার্ক আছে।

ইরানে বর্তমানে ব্যবহৃত পদ্ধতি হাজার হাজার বছর আগের পদ্ধতি থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। তবে বিশ্বব্যাপী কানাত ব্যবস্থার বর্তমান সমস্যা হলো, সেগুলো দ্রুত শুকিয়ে যায়, আগের মতো আর সহজে পানি পাওয়া যায় না।

পুরনোকে কীভাবে নতুন করে বানানো হচ্ছে

মধ্যপ্রাচ্যের শুষ্ক অঞ্চল থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার এবং এমনকি চীন থেকে আরও বেশি দূরে বিজ্ঞানী হোসে সানচেজ রামোস ও সার্ভান্দো আলভারেজ স্পেনের সেভিয়া শহরে একটি ঠান্ডা মরূদ্যান তৈরির জন্য কানাতের ধারণা ব্যবহার করছেন।

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সমাধান খুঁজে বের করার জন্য শহরের উদ্যোগের অংশ হিসেবে রামোস ও আলভারেজকে শক্তি-ঘন প্রযুক্তির উপর নির্ভর না করে বাইরের জায়গায় তাপমাত্রা কমিয়ে আনার পরীক্ষা করার জন্য স্থান বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

এর মধ্যে একটি স্থান ছিল সেভিয়া শহরের কেন্দ্রের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত লা ইসলা দে লা কার্তুজাতে। এটি ১৯৯২ সালের বিখ্যাত সেভিয়া এক্সপোজিশনের স্থান, যা ৬ মাসে বিশ্বের প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ দর্শককে আকৃষ্ট করেছিল। শহর কর্তৃপক্ষ স্থানটিতে নগরায়নের কিছু প্রচেষ্টা চালালেও বর্তমানে অনেকটাই পরিত্যক্ত এবং বড়বড় ঝোপঝাড়ে পূর্ণ। ফুটপাথগুলোতে ফাটল ধরেছে এবং মনোরেল স্টেশনটিও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।

তবে এলাকাটিতে একটি কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন কমপ্লেক্স রয়েছে, যেখানে ১৫ হাজার মানুষ কর্মরত। এ ছাড়া একটি ফুটবল স্টেডিয়াম ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ আন্দালুসিয়ার ক্যাম্পাসও আছে সেখানে।

এক্সপোতে ব্যবহৃত একটি পরিত্যক্ত অ্যাম্ফিথিয়েটার রামোস ও আলভারেজের পরীক্ষামূলক কাজের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

তাদের এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে কার্তুজাকানাত, যা প্রাচীন পারস্যের কানাত ব্যবস্থার অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পে লা ইসলা দে লা কার্তুজার মধ্যে দুটি ফুটবল মাঠের আকারের একটি স্থানের স্থল তাপমাত্রা ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ইউরো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরবান ইনোভেটিভ অ্যাকশন (ইউআইএ) এর আংশিক ব্যয় বহন করছে। প্রকল্পটিতে মাটির ২০ মিটার নিচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ খাল তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হবে। তবে এই সুড়ঙ্গ খালের উদ্দেশ্য নাগরিকদের পানি সরবরাহ নয়।

প্রাচীন কানাতগুলোর প্রবেশপথের মতো করে সেভিয়ার এই সুড়ঙ্গ খাল বরাবরও উল্লম্বভাবে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর লম্বা ভেন্টিলেটর বা জানালা রাখা হয়েছে, যেগুলো পানির শীতলতাকে উপরের দিকে পাঠাবে। এতে মাটির তাপমাত্রা কমবে।

রামোস বলেন, “জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ কৌশলগুলোর চাবিকাঠি হলো দিন-রাতের চক্র।”

রাতের বেলায় ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ খালের পানি স্বাভাবিকভাবেই কম তাপমাত্রায় ঠান্ডা হয়ে যায়। এতে প্রায় ১৪০ কিউবিক মিটার (৩৬,৯৮৪ কিউবিক গ্যালন) পানি ধরে। কিছু পানি পাম্প করে অ্যাম্ফিথিয়েটারের ছাদে পাঠানো হয়। ছাদটি সৌর প্যানেলে আবৃত। নজল দিয়ে সৌর প্যানেলগুলোর উপর পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়, যাকে ‘পতনশীল ফিল্ম’ বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পানি বাইরের কম তাপমাত্রায় দ্রুত শীতল হয়। ফলে পানি শীতলকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।

দিনের বেলা সৌরচালিত পাম্পগুলো ঠান্ডা পানিকে মাটির উপরে ঠেলে দেয়, যেখানে ছোট পাইপের মাধ্যমে পানি ফ্যানগুলোর সামনে দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং ঠান্ডা বাতাস তৈরি হয়। ফ্লোর ও সিঁড়ির ছোট ছোট ভেন্টিলেটর দিয়ে ওই শীতল বাতাস অ্যাম্ফিথিয়েটারের নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাইরে পানির ছোট পুলগুলো থেকে নজলের আলাদা একটি সেট বাতাসে কুয়াশার মতো করে পানি ছড়ায়, যার বাষ্পীভবনের মাধ্যমে চারপাশ শীতল হয়।

সেখানে থাকা আরও কয়েকটি উপাদানও তাপমাত্রা কম রাখতে সাহায্য করে। চত্বরটির ভেতরে লাগানো গাছপালা বাষ্পের মাধ্যমে শীতল হয় (পাতা থেকে অতিরিক্ত জল বাতাসে বাষ্পীভূত হয়), গাছগুলো বাইরে ছায়া দেয়। আর ছাদেও তাপ প্রতিফলিত করার জন্য সাদা রঙ করা হয়েছে।

এই ব্যবস্থার নির্মাতাদের প্রত্যাশা, স্থানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং কাছাকাছি কোম্পানিতে কাজ করা লোকদের আড্ডা ও জমায়েতের জায়গা হয়ে উঠবে।

রামোস বলেন, “প্রকল্পটির লক্ষ্য রাস্তায় প্রাণ ফিরিয়ে আনা। এটি গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে কিছু সময়ের জন্য একটু শীতল আশ্রয় এবং গরমের মাসগুলোতে আউটডোর কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে উঠবে।”

আলভারেজ বলেন, প্রকল্পটির কাজ আগামী জুনের মধ্যেই পুরোপুরি সম্পন্ন করা হবে, ঠিক গ্রীষ্মের সময়, যখন স্পেন তার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা অনুভব করে।

প্রকল্পটির বেশিরভাগ কাজ ২০২২ সালের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। ২০২৩ সালের গ্রিষ্মেই উদ্বোধন করে খুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটির উদ্যোগ নেওয়া প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক দল গত বছরের মে মাসে স্থানীয় নির্বাচনে রক্ষণশীল পিপলস পার্টির কাছে হেরে যাওয়ায় এর উদ্বোধন বিলম্বিত হচ্ছে।

ঠান্ডা ভবিষ্যত

রামোস ও আলভারেজের প্রথম দেখা হয় ৩০ বছরেরও বেশি আগে, যখন রামোস সেভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আলভারেজের একজন ছাত্র ছিলেন। আলভারেজ বলেন, “রামোস ভালো প্রশ্ন করতে পারতেন। শ্রেণীকক্ষে যারা আমার কাছে আকর্ষণীয় সমস্যা উপস্থাপন করে, তাদের আমি ভবিষ্যতের জন্য নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করি।”

তারপর থেকেই তারা দুজনে সেভিয়াকে ঠান্ডা করার জন্য একসঙ্গে কাজ করছেন। ১৯৯০-র দশকে তারা সেভিয়ার বিভিন্ন অ্যাভিনিউতে বাতাসের অনেক টানেল তৈরি করেছেন। সেগুলোও প্রাচীন পারস্যের বাগদির নামক উইন্ড ক্যাচার বা বাতাস ধারকের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে।

বাগদির হলো ভবনের ছাদের ওপর নির্মিত একটি উঁচু টাওয়ার, যার উপর দিকটা খোলা থাকে এবং সেখান দিয়ে বাতাস ঢুকে ভবনের নীচের দিকে ঘরগুলোতে প্রবাহিত হয়। মধ্য ইরানের মরুভূমির শহর ইয়াজদে এখনও বাগদির প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।

ইরানের ইয়াজদ শহরের একটি বাড়ির ছাদে বাগদির।

আলভারেজ বলেন, তারা প্রায়ই সমাধানের জন্য অন্যান্য দেশের দিকে তাকান, বিশেষ করে যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তীব্র তাপের সঙ্গে মোকাবেলা করে আসছে।

যেমন মরোক্কার আধুনিক ভবনগুলোতে উত্তরমুখী বড় জানালা এবং দক্ষিণমুখী ছোট জানালা লাগানো হয়, এতে ঘর শীতল থাকার পাশাপাশি সূর্যের আলোও পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেস ও ভারতের আহমেদাবাদে সূর্যের আলো ৯৮.১ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিফলিত করতে এবং অতিবেগুনী রশ্মি শোষণ করতে একটি নতুন ধরনের সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে শহুরে তাপ মোকাবেলার পাশাপাশি বিদ্যুৎ শক্তিও সাশ্রয় হয়।

মরোক্কো ও গ্রীসে শতশত বছর ধরে তাপ প্রতিফলিত করা সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়। মরোক্কোর একটি বিখ্যাত শহরও ক্যাসাব্লাঙ্কা বা সাদা ঘর নামে পরিচিত।

রামোস ও আলভারেজ সেভিয়ার অন্যান্য অংশেও তাদের নতুন প্রযুক্তি জ্ঞানের প্রয়োগ শুরু করেছেন।

রামোস গত গ্রীষ্মে স্থানীয় সংবাদপত্র সুরকে বলেছিলেন, “কার্তুজাকানাতের ক্ষুদ্র সংস্করণ ব্যবহার করে গ্রীষ্মকালের জন্য বায়োক্লাইম্যাটিক বাস স্টপ তৈরি করা হচ্ছে। এই যাত্রী ছাউনিগুলোর অভ্যন্তরে একটি বদ্ধ জলাধারের মাধ্যমে শীতল করা বাতাসকে ছাদে থাকা সৌর প্যানেল দিয়ে চালিত ছোট গর্তের মাধ্যমে পাম্প করা হয়- অনেকটা রেফ্রিজারেটরের মতো।”

রামোস ও খানেইকি বলছেন, প্রকল্পটি এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আরও বেশি নাগরিকের অংশগ্রহণের আশা করছেন।

খানেইকি বলেন, “সেভিয়ায় হাজার হাজার বছর আগে নির্মিত সিস্টেমগুলোকে আধুনিকভাবে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এগুলো আধুনিক মানুষদের জন্য আধুনিক মানুষদের নির্মিত কানাত। নতুন যুগে কানাতদের পুনরুত্থান।”

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, ব্লুমবার্গ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত