খাগড়াছড়ির একটি ঘটনার রেশ ধরে রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পার্বত্য অঞ্চল সফর করলেও তারা কেন সংঘর্ষের ঘটনাস্থলগুলো পরিদর্শন করেননি, কেন মসজিদ-কেয়াংসহ ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলো পরিদর্শনে যাননি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং।
রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় রবিবার জেলা প্রশাসন আয়োজন করেছিল সম্প্রীতি সমাবেশে। যেখানে প্রশাসনের পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সাংবাদিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আয়োজিত এই সভায় জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক কে এস মং বলেন, “গতকাল রাতেও রাঙ্গামাটির মানুষ আতঙ্কে ছিল। কারণ উপদেষ্টাদের কাছ থেকে আমরা কোনও মেসেজ পেলাম না।
“তারা রাঙ্গামাটিতে এসে কোনও ঘটনার স্থান পরিদর্শন করেননি। তারা আঞ্চলিক পরিষদ পরিদর্শন করলে, মসজিদ-কেয়াংসহ ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা পরিদর্শন করলে দেশের মানুষ, পাহাড়ের মানুষ একটা বার্তা পেত।”
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকালে সংঘর্ষের জের ধরে রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। বিকালের সংঘর্ষ ও রাতের গোলাগুলির ঘটনায় তিনজন নিহত হয়।
দীঘিনালার ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে রাঙ্গামাটি শহরে মিছিল বের করে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা। পরে মিছিল থেকে ‘ইটপাটকেল ছোঁড়া’কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাধে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে। সংঘর্ষ চলাকালে বেশ কিছু যানবাহনের ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
শুক্রবারের ওই সংঘর্ষে অন্তত একজন নিহত ও দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাঙ্গামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন।
এই পরিস্থিতিতে শনিবার রাঙ্গামাটি পরিদর্শনে যান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। তবে তারা সংঘর্ষের ঘটনাস্থলগুলো পরিদর্শন করেননি। কেবল প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে খাগড়াছড়ি চলে যান।
যার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের ক্ষোভের কথা জানান কে এস মং।
রাঙ্গামাটিতে সম্প্রীতি মিছিল করতে হলে জেলা পরিষদের প্রতিনিধি, আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করতে জেলা প্রশাসনকে পরামর্শ দেন তিনি।
জনসংহতি সমিতির এই নেতা বলেন, “আমরা শুধু হাত ধরে দাঁড়ালেও একটা মেসেজ তৈরি হবে।”
সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে চান জানিয়ে কে এস মং বলেন, “আমরা সবাই অধৈর্য্য হয়ে গেছি। পাহাড়ে কিছু হলেই পাহাড়ি-বাঙালি হামলা-দাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে, আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব কী এতই বিলুপ্ত হয়ে গেছে?”
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খানের সভাপতিত্বে রবিবারের সম্প্রীতি সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার এসএম ফরহাদ হোসেন, সেনাবাহিনীর সদর জোন কমান্ডার এরশাদ হোসেন চৌধুরী, সিভিল সার্জন ডা. নূয়েন খীসা, ফায়ার সার্ভিসের জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক দিদারুল আলমসহ অন্যরা।
সহিংসতার পর এখন গুজব মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলে জানান পুলিশ সুপার এসএম ফরহাদ হোসেন।
তিনি বলেন, “গুজবের কারণে গতকাল রাতেও আমাদের ঘুম হয়নি। বিভিন্ন জায়গা থেকে উস্কানিমূলক পোস্ট করা হচ্ছে। আমরা প্রকৃত তথ্য চাই।”
শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনতে চান বলেও জানান পুলিশ সুপার।
সেনাবাহিনীর রাঙ্গামাটি সদর জোন কমান্ডার এরশাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, “আমি ২০০৭ সাল থেকে পাহাড়ে আছি, এই অঞ্চলের প্রতি আমার একটা টান আছে। রাঙ্গামাটির মতো এমন সম্প্রীতির নজির খুব কম জায়গায় রয়েছে।
“এখানে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ আছে, কাজেই ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু সেই ঝামেলা এমন হবে তা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। আমাদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখতে হলো। এটি যেন আর না হয় আমরা সেই প্রত্যাশা করছি। কেউ যদি মনে করে আমরা চেষ্টা করিনি তাহলে ভুল ধারণা। সবকিছু মিলে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমাদের দায়িত্ব পালনে কেউ কষ্ট পেলে আমরা দুঃখিত।”
সমাবেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-ধর্মের মানুষের কথায় বিভিন্ন দাবি উঠে আসে। যার মধ্যে অন্যতম হলো আসন্ন দুর্গাপূজা ও কঠিন চীবর দান উৎসবের নিরাপত্তা জোরদার। এ দুটি আয়োজন ঘিরে যেন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করা।
উপস্থিত সকলেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার দাবি করেন। দাবি ওঠে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের এলাকা নির্ধারণ করে দেওয়ারও। এছাড়া আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা, এলাকাভিত্তিক সম্প্রীতি কমিটি গঠন, গুজব নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়াসহ নানা প্রস্তাব উঠে আসে।
সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু, সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হারুন মাতব্বর, জেলা সিএনজি-অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি আলী বাবর, অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাবু, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি রাজীব চাকমা, মৈত্রী বিহারের সাধারণ সম্পাদক অমৃত দেওয়ান, বনরূপা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আয়ুব চৌধুরী, রাজবন বিহারের সাধারণ সম্পাদক অমীয় খীসা, ছদক ক্লাবের সভাপতি প্রীতিময় চাকমা, জেলা জামায়াতের আমীর আব্দুল আলিম, ইসলামী আন্দোলন জেলার সেক্রেটারি নূর হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাঙ্গামাটির প্রতিনিধি মো. শাকিলসহ অন্যরা।
সবশেষে সিদ্ধান্তের কথা জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান।
তিনি বলেন, “আমরা এলাকা অনুযায়ী সম্প্রীতি কমিটি করব। শহরের বনরূপা রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি কলেজ গেইট ও ভেদভেদীতে সম্প্রীতি সমাবেশ হবে। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। ফেইসবুকে গুজব সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেসহ বনরূপা ও রাস্তার ওপর কোনও সভা সমাবেশ করা যাবে না বলেও ঘোষণা দেন তিনি। সমাবেশের জন্য নির্ধারণ করে দেন জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণ ও পৌরসভা চত্বর। তবে সব ধরনের সভা-সমাবেশের আগে প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার কথাও জানান জেলা প্রশাসক।