কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার মধ্যে যাদের লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়েছে ঢাকায়, তাদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন সহিংসতায় নিহত বলে নিশ্চিত হয়েছে সকাল সন্ধ্যা।
ঢাকার রায়েরবাজার কবরস্থান, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, মর্গের কর্মী এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এই সংখ্যাটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে আটটি লাশ দেওয়া হয় আঞ্জুমান মুফিদুলকে, সাতটি লাশ দেওয়া হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গত ১৫ জুলাই সহিংসতায় গড়ানোর পর কয়েকদিনে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দুই শতাধিক নিহতের হিসাব করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নিহতের সংখ্যা ১৫০। তবে আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হিসাবে সংখ্যাটি অন্তত ২৬৬।
এই আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ১৬ জুলাই, সেদিন ৬ জন নিহত হয়। এরপর ১৮ জুলাই অন্তত ৪১ জন নিহত হয়। ১৯ জুলাই সবচেয়ে বেশি ৭৫ জনের মৃত্যুর খবর মেলে। এর পরের দুদিনও সহিংসতায় নিহতের ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে আহত অনেকেরও মৃত্যু ঘটে।
সহিংসতায় নিহত অনেককে বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়েছে বলে খবর ছড়ানোর পর সকাল সন্ধ্যা খবর নিতে যায় দেশের সবচেয়ে বড় কবরস্থান রায়েরবাজারে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পেছনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এই কবরস্থানে ৮৫ হাজার ৫০০ লাশ দাফনের সক্ষমতা রয়েছে।
এই কবরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকের দক্ষিণ পাশে ঠাঁই হয় অজ্ঞাতনামাদের। সেখানে গত ১৫ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ২ সপ্তাহে দাফন করা হয়েছে ৪৩টি লাশ।
সোমবার সকালে কবরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকের দক্ষিণ পাশে গিয়ে দেখা মেলে ৫৮টি নতুন কবরের। অন্য কবরের সামনে নম্বর, নামফলক থাকলেও এই কবরগুলোতে তা নেই। দেখেই বোঝা যায় খুব সম্প্রতি খোঁড়া হয়েছে এগুলো। কাজল নামে এক গোরখোদককে দেখা যায় আরও কবর খুঁড়তে।
রায়েরবাজার কবরস্থান সূত্রে জানা যাচ্ছে, জুলাই মাসের শুরুর দিন থেকে গত ১৪ জুলাই পর্যন্ত ৩৫টি অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন হয়েছিল সেখানে। গত ১৫ জুলাই থেকে সোমবার ২৯ জুলাই পর্যন্ত সেখানে দাফন করা হয় ৪৩টি অজ্ঞাতনামা লাশ।
এর মধ্যে গত ১৫ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত একটিও অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন হয়নি রায়েরবাজারে। ২২ জুলাই একদিনেই ১১টি, এরপর ২৩ জুলাই ১টি, ২৪ জুলাই ৯টি, ২৫ জুলাই ৩টি অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন হয়। ২৬ জুলাই অজ্ঞাতনামা কোনও লাশ যায়নি রায়েরবাজারে। ২৭ জুলাই ৭টি, ২৮ জুলাই ১১টি ও সবশেষে ২৯ জুলাই ১টি অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন করা হয়।
রায়েরবাজারে অজ্ঞাতনামাদের লাশ নিয়ে যায় দাতব্য প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।
নজরুল ইসলাম নামে কবরস্থানের এক কর্মী জানান, নিয়মিতই বেওয়ারিশ লাশ যায় সেখানে। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম লাশ নিয়ে এলে তারা দাফন করেন। কোন মাসে কতগুলো লাশ দাফন করা হয়, তার হিসাব মাস শেষে সিটি করপোরেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের বিষয়টি দেখভাল করেন গোলাম রব্বানী নামে এক ব্যক্তি। গত ক’দিনে কতগুলো অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন করা হয়েছে, জানতে চাইলে অফিস কক্ষে নিয়ে যান এই প্রতিবেদককে।
তবে অফিসে ঢাকার আগে মোবাইল ফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে রাখার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “হাতে মোবাইল থাকলে কোনও কথা বলা যাবে না, কোনও তথ্যও পাওয়া যাবে না। আপনি কোনও ছবিও তুলতে পারবেন না।”
বেওয়ারিশ লাশ দাফনের রেজিস্ট্রার খাতা দেখতে চাইলে রব্বানী তাতেও রাজি না হয়ে বলেন, “আমরা শুধু মৌখিক তথ্য দিতে পারব। সাংবাদিকদের খাতা দেখানোর অনুমতি নেই আমাদের।”
জুলাই মাসে লাশ দাফনের হিসাব দেওয়ার পর এসব মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা লাশ দাফন করি, কারও মৃত্যুর কারণ আমাদের জানা নেই।”
রাব্বানী জানান, অজ্ঞাতনামাদের লাশ দাফনের ক্ষেত্রে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম শুধু কাফনের কাপড় দেয়। বাঁশ, চাটাইসহ অন্যান্য খরচ কবরস্থানের পক্ষ থেকে বহন করা হয়।
এরপর এই প্রতিবেদক যান ঢাকার কাকরাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে। এই প্রতিষ্ঠানটি একশ বছর ধরে এভাবে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে আসছে।
প্রতিষ্ঠানটির দাফন সেবা বিষয়ক কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, হাসপাতাল মর্গ থেকে কিংবা পুলিশের কাছ থেকে বেওয়ারিশ লাশ পাঠানো হলে সেগুলোই কেবল তারা দাফন করেন। বর্তমানে শুধু রায়েরবাজার কবরস্থানেই বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছেন তারা।
তিনি জানান, গত ২২ জুলাই ১১টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেন তারা। এর মধ্যে ৯টি তারা পান ঢাকা মেডিকেল মর্গ থেকে, বাকি দুটি পান সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল মর্গ থেকে। ২৪ জুলাই দাফন করা ৯টি লাশের সবক’টি গেছে ঢাকা মেডিকেল মর্গ থেকে। ২৭ জুলাইয়ের ৭টি লাশই গেছে সোহরাওয়ার্দী মর্গ থেকে। ২৮ জুলাই ১১টি লাশ তারা পান ঢাকা মেডিকেল মর্গ থেকে। এছাড়া ২৫ জুলাই ৩টি, ২৩ জুলাই ১টি এবং ২৯টি জুলাই ১টি লাশ পান তারা।
“সহিংসতার কারণে ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত আমাদের কোনও গাড়ি চলাচল করেনি। সেকারণে ওই সময় কোনও মৃতদেহও দাফন করিনি আমরা,” বলেন কামরুল।
কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে সহিংসতায় নিহত ২১ জনকে বেওয়ারিশ হিসাবে দাফনের যে তথ্য এসেছে, তা ঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।
বেওয়ারিশ লাশগুলোর মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে অবশ্য সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি কামরুল।
কবরস্থান ও আঞ্জুমান মুফিদুলে গিয়ে বেওয়ারিশ লাশের হিসাব পেলেও তাদের মৃত্যুর কারণ জানতে না পেরে এই প্রতিবেদক যান ঢাকা মেডিকেলে।
আঞ্জুমান মুফিদুলকে লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে জানতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বাচ্চু মিয়াকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, “আমি গত ২৮ জুলাই ৫-৬টি লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে জানি শুধু। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”
একথা বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। এরপর বারবার ফোন দিলেও আর ধরেননি।
এরপর ঢাকা মেডিকেল মর্গে খবর নিয়ে জানা যায়, গত ২৪ জুলাই সেখান থেকে আঞ্জুমান মুফিদুলকে দেওয়া অজ্ঞাতনামা ৯টি লাশের ৮টিই চলমান আন্দোলনে সহিংসতায় নিহতদের।
মর্গের সহকারী রামু চন্দ্র দাস বলেন, “ওই দিন শাহবাগ থানার কনস্টেবল ছালাউদ্দিন আহমেদ খানের কাছে সহিংসতায় নিহত ৮ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া আর কোনও অজ্ঞাতনামা লাশ পাইনি আমরা।”
এরপর শাহবাগ থানার কনস্টেবল ছালাউদ্দিন আহমেদ খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওই মৃতদেহগুলো যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী এলাকার সহিংসতায় নিহতদের। ছবি ও ডিএনএ প্রোফাইল রেখে মৃতদেহগুলো দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুলকে দেওয়া হয়।”
এরপর এই প্রতিবেদক যায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেখানে গিয়ে জানা যায়, গত ২৭ জুলাই সেখান থেকে আঞ্জুমান মুফিদুলকে সাতটি লাশ হস্তান্তর করা হয়।
লাশগুলো এই আন্দোলনে সহিংসতায় নিহতদের বলে জানিয়েছেন শেরেবাংলা নগর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, লাশগুলো মোহাম্মদপুর, আদাবর ও উত্তরা এলাকায় সংঘর্ষে নিহতদের।
এবিষয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি মো. আহাদ আলী বলেন, “লাশগুলো বিভিন্ন থানা এলাকা থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছিল। এর মধ্যে ৬টি লাশের কথা আমার মনে আছে। ২টি মোহাম্মদপুর থানার, ২টি উত্তরা পূর্ব থানার ও ২টি উত্তরা পশ্চিম থানার।”
তারা কীভাবে মারা গিয়েছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা শুধু লাশগুলোর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছি। কীভাবে মারা গেল, সেটা পুলিশ বলতে পারবে না, এটা জানেন চিকিৎসকরা।”
বেওয়ারিশ হিসাবে যাদের কবর দেওয়া হয়েছে, তাদের ছবি ও আঙুলের ছাপ রেখে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ওসি আহাদ আলী বলেন, “নিহতদের ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনার সময় ইন্টারনেট না থাকায় অ্যানালগভাবে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা আছে। এছাড়া প্রত্যেকের ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণ করে সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
এই আন্দোলনে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও স্বজনের লাশ খুঁজে পাচ্ছেন না, এমন কাউকে এখনও সকাল সন্ধ্যা পায়নি।