রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের অভিঘাত ও অভ্যন্তরীণ নানা অব্যবস্থাপনায় চাপে পড়া অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে চলতি জুন মাসের মধ্যে আরও ১২৫ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিচ্ছে সরকার।
এই ঋণের বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভে যুক্ত হবে। এর ফলে রিজার্ভ কিছুটা বাড়ার পাশাপাশি দেশের ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার চাপ কিছুটা কমবে।
এর আগে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রথম ধাপে সরকার ৮১ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা নিয়েছিল।
চলতি অর্থবছরের জন্য দুই ধাপে দেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০৬ কোটি ৬ কোটি বা ২ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার বাজেট সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে চাপে পড়া অর্থনীতি টেনে তুলতে রেকর্ড ২৫৯ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়েছিল।
বাজেট সহায়তা সরকারের অগ্রাধিকার খাতে ব্যয় করার জন্য নেওয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে ব্যয়ে এই বাজেট সহায়তা নেওয়া হয়। সহায়তার শতভাগ অর্থ টাকায় ব্যয় করে এই বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই রিজার্ভে যুক্ত করা হয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার দ্বিতীয় ধাপে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) এবং দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের কাছ থেকে মোট ১২৫ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিচ্ছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, বাজেট সহায়তার জন্য সোমবার (১০ জুন) ‘দ্বিতীয় সামাজিক সহনশীলতা কর্মসূচি’র জন্য এডিবির সঙ্গে ২৫ কোটি ডলারের চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
আগামী ২১ জুন ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে বোর্ড সভায় ‘বাংলাদেশ সেকন্ড রিকভারি অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স’ প্রকল্পের ৫০ কোটি ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদন পেতে পারে। চলতি জুন মাসের মধ্যে এআইআইবির সঙ্গে ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আরও ১০ কোটি ডলারের চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।
ইআরডির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য দ্বিতীয় ধাপে এসব বৈদেশিক মুদ্রা বাজেট সহায়তা হিসেবে নিচ্ছে।
এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে চলতি অর্থবছরে প্রথম ধাপে ৮১ কোটি ১০ লাখ ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়েছিল বাংলাদেশ। ওই সময়ে সরকার এডিবি দিয়েছিল ৪০ কোটি ডলার। দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে ফ্রান্স দিয়েছিল ৩০ কোটি ইউরো, যা মুদ্রা বিনিময় হার অুনযায়ী ৩২ কোটি ডলার। সেই ধাপে দক্ষিণ কোরিয়া দিয়েছিল ৯ কোটি ডলার।
এবারের ১২৫ কোটি ডলার ধরে চলতি অর্থবছরের জন্য দুই ধাপে মোট ২০৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের বাজেট সহায়তা নিচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে এই বাজেট সহায়তা গ্রহণ একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এই অর্থ সরাসরি রিজার্ভে যুক্ত করা যাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বাড়বে।
“দেশে চলমান পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করতে না পারায় বাজেট বাস্তবায়নে অর্থের জোগান দিতে পারছে না। এর ফলে দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে।”
বাজেটের আওতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় যে অর্থ ব্যয় করতে হয়, তা টাকায় এই তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে, আর বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভে যুক্ত হবে।
সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এই রিজার্ভ দিয়ে দুই মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি বিল পরিশোধ করা সম্ভব। তবে ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতি ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হচ্ছে না।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকার সেই লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৫ শতাংশ কাটছাঁট করে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার সংশোধিত লক্ষ্য ধরে।
কিন্তু এনবিআর গত এপ্রিল পর্যন্ত দশ মাসে মাত্র ২ লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা বা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রারও ৭০ দশমিক ৫৭ রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে।
অর্থনীতির এই সংকটকালের কথা উল্লেখ করে আইএমএফের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এই রকম একটা পরিস্থিতিতে বাজেট সাপোর্ট নিতে পারলে এটা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।”
“এই ঋণের বৈদেশিক মুদ্রাটা রিজার্ভে যুক্ত করতে পারবে, আবার সেই বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা বাজেট বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে,” বলেন তিনি।