Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

আবারও কি রোহিঙ্গা ঢল, শঙ্কায় স্থানীয়রা

সংঘাতের জের ধরে ঘরছাড়া রোহিঙ্গারা মংডু শহরের পশ্চিমের খোলা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। ছবি : সংগৃহীত
দুই মাস আগে সংঘাতের জের ধরে ঘরছাড়া রোহিঙ্গারা মংডু শহরের পশ্চিমের খোলা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল; তাদের অনেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে চাইছে । ছবি : সংগৃহীত
Picture of নুপা আলম, কক্সবাজার

নুপা আলম, কক্সবাজার

সরকারের কঠোর অবস্থান, বিজিবি-কোস্ট গার্ডের সতর্কতার পরও রোহিঙ্গা আসা কমছে না; প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে অনুপ্রবেশের খবর।

২০২৪ সালের এই পরিস্থিতি দেখে ২০১৭ সাল উঁকি দিচ্ছে সীমান্ত জেলা কক্সবাজারের বাসিন্দাদের মনে। উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আবার রোহিঙ্গা ঢল নামতে পারে।

মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে গত শতকের ৭০ এর দশক থেকে নানা সময়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ৬ লাখের মতো রোহিঙ্গা। এই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার তার দেশের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চায় না।

এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে বাংলাদেশ সীমান্তে স্রোতের মতো আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। এক মাসেই ৭ লাখের মতো রোহিঙ্গা আসে সেই দফায়।

সব মিলিয়ে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে না বাংলাদেশ তৎপরতা চালালেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

এরমধ্যে বছরখানেক ধরে মিয়ানমারে চলছে গৃহযুদ্ধ; তাতে বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন প্রদেশে জান্তা সরকারের বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত লেগেই আছে।

বাংলাদেশেও যখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় সরকার পরিবর্তন ঘটল, তার সুযোগে দেশেরই দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের অর্থের বিনিময়ে ঢুকতে দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এক মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে, এমন ধারণা পাওয়া যায় স্থানীয়দের কাছ থেকে।

সীমান্তের একটি সূত্র জানিয়েছে, রবিবার মধ্যরাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়ার ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে অন্তত ৪৭৫ জন রোহিঙ্গা এসেছে। এদের অনেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে ভাড়া বাসায় উঠেছেন।

বাংলাদেশে এর আগে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উথিয়ার ক্যাম্পে শরণার্থী জীবন কাটাচ্ছে। কিছু সংখ্যককে নেওয়া হয়েছে নোয়াখালীর ভাসানচরে।

উখিয়ার পালংখালীর চেয়ারম্যান গফুর জানান, রাতে টেকনাফের নাফ নদী সীমান্ত দিয়ে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে প্রবেশ করতে দেখেছেন তিনি।

এসব রোহিঙ্গা যাতে স্থানীয়দের বাড়িতে অবস্থান নিতে না পারে, সেজন্য এলাকাবাসীকে সতর্ক করেছে জনপ্রতিনিধিরা।

সীমান্ত সুরক্ষায় আরও কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়ে গফুর বলেন, “নইলে আবারও ২০১৭ সালের মতো রোহিঙ্গা ঢল নামতে পারে।”

২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যে অভিযান চালিয়েছিল, তাকে ‘জাতিগত নির্মূলের সুস্পষ্ট উদাহরণ’ বলেছে জাতিসংঘ।

প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা যখন পালিয়ে আসছিল, তখন শুরুতে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলতে রাজি না হলেও পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।

দুইবার প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ সরকার নতুন করে আর শরণার্থী না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তারাও একই অবস্থানেই রয়েছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা রোহিঙ্গাদের প্রতি নমনীয় হওয়ার আহ্বান জানালেও গত ৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আর কোনও রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়।

তার মতে, মানবিক কারণে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে।

বিজিবি জানিয়েছে, সীমান্তে এখন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে তারা।

গত এক মাসে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী ৪ হাজার ৫০৬ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবি সদরদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম।

তারপরও যে রোহিঙ্গা ঢুকছে, তার স্বীকারোক্তি পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায়ও রয়েছে। তিনি বলেন, রাখাইনে চলমান সংঘাত থেকে বাঁচতে সম্প্রতি প্রায় ৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছে জানালেও সীমান্ত যে পুরোপুরি সুরক্ষিত করা কঠিন, তাও স্বীকার করেন তিনি।

টেকনাফের একটি পয়েন্ট দিয়ে সোমবার ভোরে আসে এই রোহিঙ্গারা।

টেকনাফে রয়েছে নৌ পুলিশের একটি ফাঁড়ি। সেখান থেকে জানানো হয়েছে, ৫ সদস্যের জনবলের ফাঁড়িতে বর্তমান কোনও কর্মকর্তা নেই। ৪ জন স্টেশনে রয়েছেন। তাদের কোনও যানবাহন নেই। কিছু রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশ করতে দেখা গেলেও বাঁশি বাজানো ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কিছু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। দালালরা কৌশলে এসব রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের যে পরিস্থিতি তাতে বিজিবির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর যে জনবল আছে, তা দিয়ে নিশ্ছিদ্র নজরদারি সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে দালাল চক্রের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য নানা মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গার অনেকেই ক্যাম্পের স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। কেউ কেউ বাসা ভাড়া করে থাকছে শোনা যাচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছে, টেকনাফের জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্তসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্টে দিয়ে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে।

মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় থাকা রোহিঙ্গারা শতাধিক দালালের সহায়তায় অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। তারপর তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকছে। এ কারণে তাদেরকে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা।

নতুন রোহিঙ্গাদের তালিকা করা হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের জন্য তারা তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনও নতুন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত আসেনি তাদের কাছে। তাই নতুন রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের কোনও উদ্যোগ নেই।

তিনি বলেন, “আমাদের কাছে তথ্য আছে নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মীয়-স্বজনের কাছে রয়েছে। যারা যুদ্ধে আহত হয়েছে, তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের ব্যাপারে উপর থেকে নির্দেশনা আসলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা খবর পেয়েছি বাংলাদেশের কিছু দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। বিষয়টি নিয়ে বিজিবিসহ সবাইকে জানানো হয়েছে আরও কঠোর হওয়ার জন্য।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত