দেশে আকস্মিক বড় আমলা, সাবেক সেনা ও পুলিশপ্রধানসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর আলোড়ন তুলেছে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, তারা রাতারাতি শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েনি। তিল তিল করেই এই অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। তাদের এই অবৈধ সম্পদ বানানোর খবর কেউ জানতে পারেনি, কেউ টের পায়নি, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
যারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন, নীতি-নৈতিকতা নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলেছেন, হঠাৎ কোন জাদুমন্ত্রে তারা ভিলেন হয়ে গেলেন? ছোট ছোট পত্রিকাগুলোও তাদের অবৈধ সম্পদদের তথ্য অনেক রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করছে। তাদের নিত্যনতুন বাড়ি, গাড়ি, জমি ও ভিলার খবর বের হচ্ছে? গণমাধ্যমই বা কেন হঠাৎ এমন বিপ্লবী হয়ে উঠল? যাদের নামে একটা লাইন লিখলে চাকরি থাকতো না, দেশে কী এমন ঘটল যে এখন ‘অজ্ঞাতকুলশীল’ সংবাদকর্মীও নিজ নামে তাদের বিরুদ্ধে ঢাউস ঢাউস অনুসন্ধানি প্রতিবেদন ছাপছেন?
‘কারণ ছাড়া কোনও কার্য সংঘটিত হয় না’— এটা যুক্তিবিদ্যার কথা। হঠাৎ কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতির চিত্র উন্মোচনের পেছনেও নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। তবে নেপথ্য কারণ যাই থাকুক, গণমাধ্যমে কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তির দুর্নীতির খবর চাউর হওয়ার পর থেকে কিন্তু প্রশাসনে একটা বিরাট নাড়া পড়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকেই অবৈধ উপার্জনে বিপুল-অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই এখন ভয়ে ভয়ে আছেন। কোনও কোনও পেশাজীবী গ্রুপ তো গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপনেরও চেষ্টা করছেন। সরকার যদি অবৈধ উপার্জন ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সত্যিই কঠোর হয়, তাহলে সমাজে এর একটা ইতিবাচক ফল ফলতে বাধ্য।
বর্তমান ক্ষমতাসীনরা নীতি-ঘোষণাপত্রে ও কথায় বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। ধারাবাহিক রাজনৈতিক ঘোষণা ও প্রত্যয়ের বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে ঘোষিত দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে। ইশতেহারে জবাবদিহিমূলক সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে রয়েছে ছয় অনুচ্ছেদ সম্বলিত পুরো এক অধ্যায়ব্যাপী প্রতিশ্রুতিমালা, একইসঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রয়েছে এক ডজনেরও বেশি সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার। যদিও কীভাবে এসব আড়ম্বরপূর্ণ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে, তার কোনও কৌশল বা পথরেখা নির্ধারিত নেই। এমন বাস্তবতায় এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার ও ক্ষমতাসীন দল যদি তাদের নিজেদের প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার বিন্দুমাত্র প্রমাণ দিতে চান, তবে বর্তমান সুযোগটিকে কাজে লাগানো উচিত। দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল ও পথরেখা নির্ধারণ করা উচিত।
এ কথা ঠিক, আমাদের দেশে দুর্নীতি বর্তমানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। সব সেক্টরের দুর্নীতি একসঙ্গে দমন করা সম্ভব নয়। তবে যেকোনও এক জায়গা থেকে শুরু করা দরকার। একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা দরকার। তারপর ধীরে ধীরে পুরো সমাজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি আমাদের জীবনে নিত্যদিনের অভিশাপ এবং জাতীয় জীবনে এক বড় কলঙ্ক। দুর্নীতি দূর করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। শুধু মুখের কথায় দুর্নীতি দূর হবে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্র হচ্ছে দুর্নীতির সূতিকাগার। আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি বন্ধ করতে পারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এটা করতে হলে সবার আগে নেতৃত্বকে সৎ হতে হবে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন জনপ্রশাসনকে ধ্বংস করে ফেলেছে। প্রশাসনে যারা এখনও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়নি তারাও ধান্দাবাজ হয়ে গেছে। অফিসের কাজে তাদের উৎসাহ কমে গেছে। দলবাজি সরকারের ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর ঢুকে গেছে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা কীভাবে চালাবে এর ওপর নির্ভর করে জনপ্রশাসন। রাজনীতিবিদরাই এর নিয়ন্ত্রক। কাজেই রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ করা বা কমানো সম্ভব সম্ভব নয়।
দলের ভেতরের দুর্নীতিবাজদের দমন করার পাশাপাশি আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি দমনে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য সবার আগে দরকার কোনও আমলার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হলে তার চাকরির মেয়াদ তখনই শেষ করে দেওয়া। অকাল অবসর দেওয়া ছাড়াও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত সাপেক্ষে তার শাস্তি হওয়া জরুরি। এ ছাড়া অভিযোগ ওঠার তিন মাসের মধ্যে তদন্তের অনুমতি বা অভিযোগ খারিজ করার রিপোর্ট দিতে হবে বিভাগীয় প্রধানকে। অভিযোগ কেন খারিজ করা হলো, তা যুক্তি দিয়ে জানাতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও ক্যাবিনেট সচিবের কাছে প্রতি তিন মাসে রিপোর্ট দিয়ে জানাতে হবে, কোনও আমলার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর তদন্তের অনুমতির বিষয়টি ঝুলে রয়েছে কি না। দুর্নীতির মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ অ্যান্টিকরাপশন আদালত খুলতে হবে। দশ বছর বা তার বেশি সময় ধরে যেসব দুর্নীতির মামলার নিষ্পত্তি হয়নি, সেগুলো দ্রুত মীমাংসার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিকে নিয়ে কমিটি গড়া যেতে পারে। এ কমিটিই মামলাগুলো বিবেচনা করে রিপোর্ট দেবে।
দরপত্র ডাকার বিষয়টিতে স্বচ্ছতা আনতেও সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করা দরকার। ন্যায়পাল নিয়োগের বিধানও কার্যকর করা যেতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তাদের তদন্ত করার ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। মেরুদণ্ডসম্পন্ন ব্যক্তিদের এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে। প্রশাসনে বদলি, পদোন্নতি ও প্রচলিত নিয়োগ পদ্ধতি নীতিমালা অনুযায়ী না হলে দুর্নীতির জন্ম হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। এসব সমস্যা দূর করতে পারলে এবং রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করে ওপরে ওঠার সুযোগ বন্ধ হলে প্রশাসনে হতাশা থাকবে না। দুর্নীতি দমনের স্বার্থে চিহ্নিত দলীয় এবং অযোগ্য কর্মকর্তাদের প্রশাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত।
প্রত্যেক সম্পন্ন নাগরিকের জন্য কর পরিশোধের বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। সময়মতো কর পরিশোধ যদি ন্যায়ানুগতা ও দায়িত্বশীল আচরণ এবং সামাজিক পুঁজির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়, তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা অতি নিম্নমানের। আয়কর না দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বিরাট অপরাধ। কিন্তু বাংলাদেশে অন্তত আশি লাখ ব্যক্তি করের আওতায় আসার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে বারো লাখের বেশি কর দেন না। আমরা খাবারের বেলায় ‘হালাল’ খুঁজি, কিন্তু উপার্জনের বেলায় তা মানি না! এই স্ববিরোধিতা থেকে সরে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীকে এমন একটা বার্তা দিতে হবে, দুর্নীতিপরায়ণ হলে তাকে অবশ্যই আইনানুগ পরিণতি ভোগ করতে হবে। তাহলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মতো স্বচ্ছতা এবং সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দুর্নীতির শাস্তি হওয়া উচিত দৃষ্টান্তমূলক। কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে, জনস্বার্থের দায়িত্বসম্পন্ন কোনও পদে বা কোনও নির্বাচন থেকে বিশ বছর বিরত রাখার কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দোষী প্রমাণিত হবেন তাদের আমলনামা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে, দুর্নীতি প্রতি বছর বার্ষিক প্রবৃদ্ধির শতকরা অন্তত ৪-৫ শতাংশ গ্রাস করে ফেলে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি মানুষেরই একটি সম্পদের বিবরণী থাকতে হবে। দেশ-বিদেশে যেখানেই তার সম্পদ থাকবে, তার বিবরণ ওই হিসাবে থাকবে। কেউ তার কোনও সম্পদ বিক্রি করলে সেটি তার হিসাব থেকে বাদ যাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তা যে কিনবে তার হিসাবে যুক্ত হবে। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক হিসাব থেকে শুরু করে আয়কর পর্যন্ত সবকিছুই একটি বোতামের নিচে নিয়ে আসা যাবে; আর এগুলো যদি ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, তবে সাধারণ জনগণ যেমন হয়রানির শিকার হবে না, তেমনি যদি কেউ কোনও রকম সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করে তা ধরাও খুব সহজ হবে। এসব ব্যাপারে অনেক দেশ সফল হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।
সরকার যদি সত্যিই দুর্নীতি বন্ধ করতে চায়, তাহলে সবার আগে মন্ত্রী-এমপিদের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব নিতে হবে। তারপর অভিযান শুরু করতে হবে সচিবালয়ে। সপ্তাহে না হলেও, মাসে অন্তত একবারও যদি মন্ত্রিপরিষদ কিংবা সচিব কমিটির সভায় দুর্নীতির বিষয়টি এজেন্ডা হিসেবে যুক্ত করেন, তাহলেও সুফল ফলবে।
প্রশ্ন হলো, সরকার কি উল্লিখিত কাজগুলো করতে চায়? সত্যিই দুর্নীতি দমন করতে চায়? নাকি হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখিয়ে সবাইকে ব্যস্ত রেখে ভিন্ন কোনও উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়?
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: chiros234@gmail.com