আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার পর কোটাবিরোধী বিক্ষোভ থেকে সহিংসতা ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। তাতে অন্তত ছয়জন নিহত এবং বহু আহত হয়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকায় নিহত হয়েছে দুজন। চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে একজন নিহত হয়েছে। এমাসের শুরুতে আন্দোলন শুরুর পর নিহতের ঘটনা এটাই প্রথম।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থক ও পুলিশের দিনভর সংঘর্ষের পর ঢাকাসহ ছয় জেলায় বিজিবি নামানো হয়েছে। এরমধ্যেই রাতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দুটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ও স্নাতকের শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভে কলেজ শিক্ষার্থীরাও যোগ দেওয়ার প্রেক্ষাপটে সারাদেশে স্কুল-কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়ও।
বিক্ষোভের কারণে সারাদেশেই মহাসড়কে যান চলাচল ব্যাহত হয়। ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সংঘাতের কারণে রাজধানীর সড়কও অচল হয়ে ছিল।
ঢাকার মহাখালীতে শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করার পর সারাদেশের সঙ্গেই ঢাকার ট্রেন চলাচল বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। সড়ক অবরোধের প্রভাব পড়ে বিমান চলাচলেও। দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালালে ফ্লাইট সূচি হয়ে পড়ে এলোমেলো।
রাজপথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মঙ্গলবারই আপিল আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগে এই মামলার শুনানির জন্য ৭ অগাস্ট দিন নির্ধারিত রয়েছে।
আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারের দাবিটি সরকারের কাছে জানিয়ে এলেও সরকারের পক্ষ থেকে আগের মতোই বলা হচ্ছে, এর সমাধান আদালতেই হবে।
এদিকে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ দিনের কর্মসূচি শেষ করলেও নতুন কোনও কর্মসূচি দেয়নি।
এই প্ল্যাটফর্মের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম দিনভর পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে রাতে সাংবাদিকদের বলেন, “এই পরিস্থিতিতে পড়ব, তা আমরা জানতাম না। সরকার আমাদের এদিকে ঠেলে দিয়েছে। আন্দোলন পরিচালনার জন্য এখন পরিকল্পনা লাগবে। আমরা বসে দীর্ঘ পরিকল্পনা করে কর্মসূচি ঘোষণা করব।”
এদিকে এই আন্দোলন ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য অব্যাহত আছে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করে তার নিন্দা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিক্রিয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছে ঢাকা।
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সোমবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখার কথা বলার সময় দুজন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
একদিন আগে দুজন নিহত হওয়ার এই তথ্য ভিত্তিহীন দাবি করে এর ঢাকা থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
হামলার জন্য অভিযোগের মুখে থাকা ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের যারা ‘বিভ্রান্ত’ করেছে, তাদের ‘উচিৎ জবাব’ দেবেন তারা।
হাইকোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্হালের পর কোটা সংস্কারের দাবিতে এমাসের শুরু থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে রাজপথে আন্দোলনে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। সরকারের কাছে তাদের দাবি, সংস্কার করে কোটা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
এই দাবি পূরণে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেওয়ার পরদিন সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে নামার পর বেধড়ক পিটুনির শিকার হন আন্দোলনকারীরা, হামলা হয় জাহাঙ্গীরনগরে আন্দোলনকারীদের ওপরও।
তাতে বহু আহত হলেও এবারের আন্দোলনে নিহতের ঘটনা মঙ্গলবারই প্রথম ঘটল।
ঢাকায় সংঘাতে নিহত ২
ঢাকা কলেজের সামনের সড়কে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে মঙ্গলবার দুপুরের পর। তাতে দুজন নিহত হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষের পর ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের পেট্রোল পাম্পের সামনে থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় এক তরুণকে উদ্ধার করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বয়স আনুমানিক ২৫ বছর।
ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তার পুরো শরীর রক্তাক্ত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে তাকে লাঠিপেটা করা হয়। এতেই তার মৃত্যু হয়েছে।”
নিহত এই যুবকের নাম সবুজ আলী (২৫) বলে পরে নিশ্চিত করে পুলিশ। তার বাড়ি নীলফামারী সদর উপজেলায়। তার বাবার নাম বাদশা মিয়া, মায়ের নাম সূর্য বানু। জাতীয় পরিচয়পত্র মিলিয়ে সবুজের পরিবারে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান নিউ মার্কেট থানার এসআই মাহাবুব।
সবুজ ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান।
সন্ধ্যায় সিটি কলেজের সামনে থেকে আরেকজনের লাশ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। তার নাম শাহজাহান (২৫)। তিনি হকার বলে পুলিশ জানিয়েছে।
একই সময় চানখারপুলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সমর্থকরা। পরে পুলিশও সেখানে যায়।
সেখান থেকে গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক।
তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি একজনকে দেখলাম, খারাপ অবস্থা। আর চানখারপুল থেকে ৪/৫ জনকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদেরকে গুলি করা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক রয়েছি আমরা। কিন্তু কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।”
মহাখালীতে দুপুরে রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এতে দুটি ট্রেন আটকা পড়ে। সেখানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে বিকালে। তখন পুলিশ বক্স ও দুটি মোটর সাইকেল জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। পুলিশও কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে দফায় দফায় সংঘাত চলে।
মহাখালীসহ বিভিন্ন স্থানে মঙ্গলবার আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভে ইউনিফর্ম পরা কলেজ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়।
চট্টগ্রামে নিহত ৩
চট্টগ্রাম নগরীতে মঙ্গলবার বিকালে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগকর্মীদের সংঘর্ষে দুই কলেজছাত্রসহ তিনজন নিহত হয়েছে।
তারা হলেন- চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, ওমর গণি এমইএস কলেজের ম্যানেজমেন্টের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত এবং পথচারী ফার্নিচার দোকানি মোহাম্মদ ফারুক।
ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম ও ফার্নিচার দোকানি ফারুক মুরাদপুরে ঘটনাস্থলেই মারা যান। ফয়সাল মারা যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আঘাত দেখে মনে হচ্ছে মোহাম্মদ ফারুক এবং ফয়সাল আহমেদ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আর ওয়াসিম আকরাম ফিজিক্যালি অ্যাসল্ট হয়েছেন।”
সংঘর্ষে আহত ৩০ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে ২০ জনের অবস্থা গুরুতর।
সংঘর্ষের পর বিকালে চট্টগ্রামে তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
রংপুরে নিহত ১
রংপুরে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালেয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২ ব্যাচের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, দুপুর আড়াইটার দিকে ১ নম্বর গেট এলাকায় এ সংঘর্ষের সময় গুলিতে প্রাণ হারান আবু সাঈদ।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। মৃত্যুসনদে তার ঠিকানা লেখা ছিল রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুরে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক অধ্যাপক ডা. ইউনুস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সংঘর্ষের ঘটনায় একজন মারা গেছে। তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। হাসপাতালে আনার পর উত্তেজিত ছাত্ররা মরদেহ নিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ ফেরত এনেছে। এখন আইন অনুযায়ী সব কিছু করা হবে।”
তার মৃত্যুর পর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রংপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। লাঠি সোঁটা, রড নিয়ে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুল ফটকের সামনে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখলে নেন আন্দোলনকারীরা।
বিকালে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হাসিবুর রহমানের বাড়ির সামনের গেট ভেঙে বাড়ির সামনে রাখা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এসময় ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ।