সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রাঙ্গণ ও আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষ ৪ ঘণ্টায়ও থামেনি।
সোমবার রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলসহ আশেপাশের এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে বলে খবর পাওয়া যায়।
সোমবার বিকাল ৫টার দিকে হামলায় আহত অনেককেই বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে ভার্তি করা হয়। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি, ছাত্রলীগের হামলায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, হামলাকারীদের অনেকেরই হেলমেট পরা ছিল। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে হামলাকারীরা হকিস্টিক, রড, স্টাম্প, লাঠি নিয়ে বিজয় একাত্তর হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধাওয়া দেয়। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পিছু হটেন। তখন তাদের ধরে মারধর করা হয়। তখন অনেকেই গুরুতর আহত হয়।
আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় আহত অন্তত ৯১ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীরা বিকাল ৪টার পর থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসতে থাকেন। বিকাল ৫টা পর্যন্ত হিসাবে ৯১ জনের চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য জানা গেছে। তবে এই সংখ্যা সন্ধ্যার আরও বাড়ে বলে জানা যায়।
শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে আটকে রাখা হয়েছে এমন খবরে এদিন বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন আবাসিক হলে যাওয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে বিজয় একাত্তর ও সূর্যসেন হলের সামনে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় উভয়পক্ষ একে অন্যের দিকে ইট-বোতল ছুড়ে মারে।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে এর আগে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী বিক্ষোভে যোগ দেয়।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে’– এ ধরনের বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে রবিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন। শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। আদালতের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসে আমাদের কিছু করার থাকে না, এটা বাস্তবতা।”
মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের (কোটাবিরোধীদের) এত ক্ষোভ। কেন এত ক্ষোভ? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?”
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর রবিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ‘তুমি কে আমি কে – রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে- সরকার সরকার’, ‘কোটা নয় মেধা- মেধা মেধা’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার- হয়ে গেলাম রাজাকার’—এসব স্লোগান দিতে দেখা যায়।
তবে বিক্ষোভে কোটাবিরোধীদের শিক্ষার্থী দেওয়া ‘তুমি কে আমি কে – রাজাকার, রাজাকার’—এই স্লোগান নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় অনেককে সমালোচনা করতে দেখা গেছে। অনেকে আন্দোলনকারীদের পক্ষেই যুক্তি তুলে ধরেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বুয়েট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে।
মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করার পর প্রধানমন্ত্রীর ‘অপমানজনক বক্তব্য’ প্রত্যাহার এবং এক দফা দাবিতে সারাদেশের সব ক্যাম্পাসে সোমবার বিক্ষোভ মিছিল ও জনসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
সেই কর্মসূচি অনুযায়ী সোমবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা। পরে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে ঢাবির বিভিন্ন হল এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভে যোগ দেয়।
সেখানে দুপুর পৌনে ২টার দিকে বক্তব্য দেন আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, কোটার যৌক্তিক সংস্কার। দাবি আদায়ের আগ পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না।
“আমরা যেন দ্রুত পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে পারি, সেই ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।”
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখার খবর ছড়িয়ে পড়লে দুপুর পৌনে ৩টার দিকে রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে বিভিন্ন হলের দিকে যেতে শুরু করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
এ সময় বিজয় একাত্তর ও সূর্যসেন হলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা বাইরে থেকে ইট ছুড়লে হলের ভেতর থেকে কাচের বোতল ছোড়া হয়।
বিকাল ৫টার দিকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
রাত ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে যান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি দল। সেসময় সহকারী প্রক্টর ড. লিটন কুমার সাহা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন। চার ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ চললেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন কোনও ব্যবস্থা নিল না—এমন প্রশ্ন তোলেন আন্দোলনকারীরা।
রাত সাড়ে ৮টায় শহীদুল্লাহ হল, ঢাকা মেডিকেল ও চানখারপুল মোড়ে উত্তেজনা দেখা যায়। দফায় দফায় চলছে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চানখারপুল মোড়ে অবস্থান নিয়েছে। শহীদুল্লাহ হলের ভেতরে ও হলের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
সরকারি চাকরিতে আগে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলেও ২০১৮ সালে এক আন্দোলনের মুখে পূর্বতন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে তা তুলে দিয়ে পরিপত্র জারি করে সরকার।
ওই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের নেতা অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন হাইকোর্টে আবেদন করেন।
সেই আবেদনের শুনানি শেষে গত ৫ জুন ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের পাশাপাশি জেলা, নারী, প্রতিবন্ধীসহ সব কোটাই পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়।
কোটা পুনর্বহালের রায়ের পর আবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে তারা নামে আন্দোলনে।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষ রায়টি স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে আবেদন করেন।
সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ গত ১০ জুলাই কোটা এবং হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থিতাবস্থা জারি করে। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে আপিলের আবেদনও করতে বলা হয়।
আদেশের সময় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চাইলে আদালতে তাদের বক্তব্য দিতে পারে।
সর্বোচ্চ আদালতের আদেশকে ইতিবাচক বললেও আন্দোলনকারী বলছে, তাদের দাবি সরকারের কাছে। নির্বাহী বিভাগকেই সংস্কার করে কোটা ৫ শতাংশে কমিয়ে আনতে হবে।
আন্দোলনকারীরা এর আগে রবিবার (১৪ জুলাই) রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারে পদক্ষেপ দাবি জানিয়েছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাতেই বিক্ষোভ করে।
চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের হামলা
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দােলনরত শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের বাধার মুখে পড়েন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েক দফা এবং চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর রেলস্টেশনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ষোলশহরের রেলস্টেশনে লাঠিসোটা নিয়ে চত্বর দখলে নিয়েছে ছাত্রলীগ। কিছুটা দূরে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান নিয়েছে কোটাবিরােধী শিক্ষার্থীরা।
বুধবার দেশের সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে দেশের সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
সোমবার রাতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাবি শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, “আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার ও কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে মঙ্গলবার বেলা ৩টায় দেশের সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল হবে।”