২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
এরমধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলাটি চালিয়ে যেতে চায়।
সম্প্রতি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে এ আপিল দায়েরর পর তা শুনানির জন্য আপিল বিভাগের বুধবারের কার্যতালিকায় আসে।
ঈদের ছুটি শেষে ২০ এপ্রিলর পর মামলাটি শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একটি লিভ টু আপিল (আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন) দায়ের করা হয়েছে। এটি আজকে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের ২৪ নম্বার তালিকায় রয়েছে। এখনও শুনানি শুরু হয়নি। যখন শুনানি শুরু হবে আমরা এতে অংশ নেব।”
শিশির মনির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী। বাবর এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন। হাই কোর্টের রায়ে খালাস পান তিনিও।
২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও শ্রবণশক্তি হারান।
২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সিআইডি বিএনপি আমলের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর পাশাপাশি জঙ্গিদের অভিযোগপত্র দেওয়ার পর এই মামলার বিচার শুরু হয়েছিল। তখন আসামি ছিল ২২ জন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অধিকতর তদন্তে আসামির তালিকায় যুক্ত হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে, বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও ৩০ জনের নাম। আসামির সংখ্যা বেড়ে হয় ৫২ জন।
তার প্রায় এক দশক পরে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এ মামলার রায় দেন।
রায়ে ৫২ আসামির মধ্যে ৪৯ জন দণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে তারেকসহ ৭ জন রাজনীতিক, ৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা, ৫ জন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা এবং ২৯ জন জঙ্গি ছিলেন।
অন্যান্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বাকি ৩ আসামির নাম বাদ দেওয়া হয় এই মামলা থেকে। এই তিনজন হলেন-খালেদা জিয়ার সরকারের মন্ত্রী, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১ ডিসেম্বর এ মামলায় আপিলের রায় দেয় বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
তাতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) খারিজ এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল আবেদন মঞ্জুর করে সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, এ মামলার দ্বিতীয় অভিযোগপত্র, এক আসামির দ্বিতীয়বার দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার কারণে নিম্ন আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হল।
ওই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পর দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এই রায় প্রত্যাখ্যান করে ভয়াবহ সেই হামলার বিচারের ভার জনগণের ওপর দেয়।
হাই কোর্টের রায়ের পর বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “রায়ের কারণ দেখে ও নির্দেশনা নিয়ে তারপরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপিল করা উচিৎ বলে মনে করি।”
এই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে ৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল সাবেক পুলিশ প্রধান খোদা বকশ চৌধুরীর। আপিলের রায়ে তিনিও খালাস পান। তিনি এখন প্রতিমন্ত্রী পদ মর্যাদায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ সহকারী হিসাবে কর্মরত।
যারা দণ্ডিত ছিলেন
এ মামলায় ৭ রাজনৈতিক নেতা, ৮ পুলিশ কর্মকর্তা, ৫ সামরিক কর্মকর্তা ও ২৯ জঙ্গি, অর্থাৎ ৩৯ জনকে সাজা দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
বিএনপির ৭ নেতা হলেন- ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সালাম পিন্টু, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ ও ঢাকার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ।
তারেক রহমান, কায়কোবাদ ও হারিছ চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। বাবর, পিন্টু ও হানিফকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
খালাস পাওয়া ৮ পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- সাবেক আইজিপি খোদা বকশ চৌধুরী, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক উপকমিশনার খান সাঈদ হাসান, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান ও সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদ।
সাবেক তিন আইজিপির মধ্যে খোদা বকশ চৌধুরীর ৩ বছর এবং শহুদুল হক ও আশরাফুল হুদার ২ বছর কারাদণ্ড হয়েছিল। ওবায়দুর রহমান, খান সাঈদ হাসানের ২ বছর, রুহুল আমিন, আতিকর রহমান ও আবদুর রশীদের ৩ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
খালাস পাওয়া সামরিক বাহিনীর ৫ কর্মকর্তা হলেন- ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহীম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক এ টি এম আমিন আহমদ, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার এবং খালেদা জিয়ার ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক।
তাদের মধ্যে রেজ্জাকুল ও আবদুর রহীমের মৃত্যুদণ্ড এবং আমিন আহমদ, সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ও সাইফুল ইসলাম ডিউককে ২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল।
হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি), লস্কর-ই-তাইয়েবা, হিযবুল মুজাহিদীন, তেহরিক-জিহাদি আল ইসলাম এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, এ পাঁচটি জঙ্গি সংগঠনের ২৯ জনের সাজা হয়েছিল।
হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসাবে হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান এবং একই সংগঠনের নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনের সস্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছিল বিচারিক আদালতের রায়ে। তাজউদ্দিন সাবেক উপমন্ত্রী সালাম পিন্টুর ভাই।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড হওয়া ১৪ জঙ্গি হলেন- মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মাইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, রফিকুল ইসলাম ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ, মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন, আবদুল মাজেদ ভাট, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে ফরিদ ও মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি।
যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল আরও ১৫ জঙ্গির। তারা হলেন- শাহদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, আরিফ হাসান সুমন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান, মহিবুল মোত্তাকিন, আনিসুল মোরসালিন, মো. খলিল, মো. ইকবাল, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি আবদুল হাই ও বাবু ওরফে রাতুল বাবু।
সেদিন যা ঘটেছিল
তখন ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোট, সংসদে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা বের করার কর্মসূচি দেয়।
শোভাযাত্রার আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে। সেখানে একটি ট্রাক এনে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, শোভাযাত্রার আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ করে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সময় ঘটে পর পর দুটি বিস্ফোরণ। এরপর সামান্য বিরতি দিয়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়। তারই মধ্যে শোনা যায় গুলির আওয়াজ।
মঞ্চে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা বিস্ফোরণে মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।
সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।
নিহত অন্যরা হলেন- শেখ হাসিনার দেহরক্ষী মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় অজানাই থেকে যায়।