Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

চার মাসে ৯ শহর আরাকান আর্মির দখলে

আরাকান আর্মি (এএ) গত চার মাসে জান্তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে রাখাইন ও দক্ষিণ চিন রাজ্যের নয়টি শহর দখল করেছে। ছবি: দ্য ইরাবতী।
আরাকান আর্মি (এএ) গত চার মাসে জান্তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে রাখাইন ও দক্ষিণ চিন রাজ্যের নয়টি শহর দখল করেছে। ছবি: দ্য ইরাবতী।
[publishpress_authors_box]

গত বছরের ১৩ নভেম্বর মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ অংশে জান্তা সরকারের সামরিক ও বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) অবস্থানগুলোতে হামলা শুরু করে রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। এর মধ্য দিয়ে তারা ২০২২ সালে মানবিক কারণে জান্তা সরকারের সঙ্গে করা যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে।

২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) রাজ্যটির রাজনৈতিক সংগঠন আরাকান ইউনাইটেড লিগের (এইউএল) সশস্ত্র শাখা। এছাড়া শান রাজ্যের তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এমএনডিএ) আর্মির সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সেরও সদস্য এএ। গত বছরের অক্টোবর থেকে বিদ্রোহীদের এই জোট মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

রাখাইন রাজ্যে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করার আগে আরাকান আর্মি গত বছরের ২৭ অক্টোবর থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এবং অন্যান্য প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে শান রাজ্যে অপারেশন ১০২৭-এও অংশগ্রহণ করে। বিদ্রোহীদের ওই সমন্বিত হামলার পর থেকেই মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এর আগে আর কখনও দেশটির সামরিক শাসকরা এত বড় প্রতিরোধের মুখে পড়েনি। এতে পতনের শঙ্কায় রয়েছে মিয়ানমার জান্তা।

১৩ নভেম্বর থেকে আরাকান আর্মি তাদের নিজেদের রাজ্যেও জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। তবে তারা শুধু এই দুই ফ্রন্টেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সম্প্রতি আরাকান আর্মি দেশের অন্যান্য অংশে, যেমন কাচিন রাজ্য ও সাগাইং অঞ্চলেও জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) ও জাতীয় ঐক্য সরকারের বাহিনী পিপলস ডিফেন্সসহ (পিডিএফ) অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও সমন্বয় করছে।

পুরো মিয়ানমারজুড়ে সামরিক শাসনবিরোধী জনগণ আরাকান আর্মির ব্যাপক সাফল্য ও অব্যাহত অগ্রগতি দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। প্রথমে তারা উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের শহরগুলো দখল করে। এরপর নিজেদের রাখাইন রাজ্যেও একের পর এক শহর দখল করে নিতে থাকে। তাদের এই সিরিজ জয় ও সাফল্য মিয়ানমারসহ বহির্বিশ্বেও বিস্ময় জাগিয়েছে।

সম্প্রতি রাখাইনে জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে দ্রুতগতিতে সাফল্য পাচ্ছে তারা। আরাকান আর্মি প্রায় প্রতিদিনই জান্তার বাহিনীর কাছ থেকে ফাঁড়ি ও ঘাঁটি দখল করছে। এমনকি যেসব শহর সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে জান্তার শাসনের নিয়ন্ত্রণে ছিল সেসবও দখল করে নিচ্ছে।

আরাকান আর্মির দখলে যেসব শহর

গত চার মাসে তারা রাখাইনের আটটি ও চিন রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের একটিসহ মোট নয়টি শহর দখল করেছে। দক্ষিণ চিনে তারা পুরো পালেতোয়া শহরটি দখল করে নেয়। আর রাখাইনে কিয়াউকতো, ম্রাউক-উ, মিনবিয়া, পাউকতো ও পোন্নাগুন শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এ ছাড়া মিয়েবন, বুথিডং, তাউং পিয়ো লেটবে শহর এবং সম্প্রতি রামরি শহরটিও দখল করেছে। তবে বুথিডং ও রামরি শহরে এখনও লড়াই চলছে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহরেও যুদ্ধ চলছে, শহরটিরও কিছু এলাকা দখল করে নিয়েছে এএ। রাজধানী সিত্তের দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি।

১৬টি বড় ঘাঁটি দখল

গত চার মাসে অন্তত ১৬টি প্রধান ঘাঁটিসহ আরাকান আর্মি শত শত জান্তা মিলিটারি ও বর্ডার গার্ড পুলিশের ফাঁড়ি, কৌশলগত পাহাড়চূড়ার ফাঁড়ি ও ঘাঁটি দখল করেছে।

এসবের মধ্যে রয়েছে পোন্নাগুনে লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন (এলআইবি) ৫৫০ ও ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন (আইব) ২৭০ এর ঘাঁটি; ম্রাউক-উতে এলআইবি ৩৭৭, ৩৭৮ ও ৫৪০; এবং মিনবিয়াতে এলআইবি ৩৮০, ৩৭৯ ও ৫৪১। এগুলো রাখাইন রাজ্যে জান্তাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কমান্ড সেন্টারগুলো মধ্যে ছিল।

রাখাইনের প্রধান শহরগুলোর একটি কিয়াউকতোতে জান্তার অনেক ঘাঁটি আছে। শহরটি ভৌগলিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শহরটি রাখাইনকে পালেতোয়া শহর হয়ে চিন রাজ্যের সঙ্গে যুক্তকারী সড়কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। কিয়াউকতোতে আরাকান আর্মি এলআইবি ৩৭৪, ৩৭৫, ৩৭৬ ও ৫৩৯ এবং আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন ৩৭৭ এর মতো ঘাঁটিগুলো দখল করেছে।

দক্ষিণ চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহরের এলআইবি ৩০৮ ও আইবি ২৮৯ও দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি।

এই বড় ঘাঁটিগুলো ছাড়াও আরাকান আর্মি মিনবিয়া শহরে জান্তার নবম সেন্ট্রাল মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলও দখল করেছে। স্কুলটি একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পরিচালনায় ছিল এবং এই অঞ্চলে জান্তা ফাঁড়িতে অনেক সৈন্য মোতায়েন ছিল। সেগুলোও দখল করা হয়েছে।

পালাচ্ছে জান্তার সৈন্যরা

রাখাইন ও দক্ষিণ চিনে আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই তীব্র আকার ধারণ করার পর থেকে ৭০০-রও বেশি জান্তা সৈন্য ভারতে এবং ৫০০-রও বেশি বর্ডার গার্ড পুলিশ অফিসার বাংলাদেশে পালিয়েছে। সেনাদের এই পলায়ন থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যে অভ্যন্তরীণভাবেও সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে তাও প্রকাশ হয়।

জান্তার নৌবাহিনীর জাহাজ ধ্বংস

রাখাইন রাজ্যের নদীগুলোতে জান্তা তার নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করেছে। সেগুলো থেকে শহর ও গ্রামের বেসামরিক এলাকাগুলোতেও গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে। আরাকান আর্মি এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে বহু বেসামরিক লোকও নিহত হয়েছে।

এর জবাবে আরাকান আর্মি গত চার মাসে রাখাইনে জান্তার নৌবাহিনীর কমপক্ষে সাতটি কম্ব্যাট বোট ও দুটি অবতরণ নৌযান ধ্বংস করেছে। এই হামলার পর আরাকান আর্মি জান্তা সেনাদের তাদের বোট ডুবে যাওয়ার পর ডুবে মরা থেকেও রক্ষা করেছে।

অনেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাও হারিয়েছে জান্তা

আরাকান আর্মি জান্তার সামরিক বাহিনীর কমপক্ষে সাতজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে এবং কমপক্ষে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

ফেব্রুয়ারিতে কিয়াউকতো শহরের পাশের আপাউক ওয়া গ্রামের কাছে জান্তার নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষের সময় আরাকান আর্মি জান্তার ৯নং মিলিটারি অপারেশন কমান্ড (এমওসি ৯) এর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাও মিন টুন (৫১) ও তার কিছু সৈন্যকে নদী থেকে ধরে নিয়ে যায়।

অন্যান্য সংঘর্ষে আহত জান্তার কয়েকজন উচ্চ পদস্থ অফিসারসহ কিছু সৈন্যকে বাঁচাতে পারেনি আরাকান আর্মি। তাদের মধ্যে ছিলেন ১১তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডার কর্নেল মিন মিন তুন। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরাকান আর্মি পালেতোয়া শহরের কৌশলগত হাননেবু পাহাড়চূড়ায় জান্তার সামরিক ঘাঁটির বিরুদ্ধে সফল আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের পর ঘাঁটিটির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল বানিয়ার পাইং সোয়ের মৃতদেহ খুঁজে পায়।

জান্তার অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যাদেরকে আরাকান আর্মি মৃত বলে নিশ্চিত করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন- মেজর কিয়াও থেত নাইং, যিনি একটি কলামের কমান্ডার ছিলেন; লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়ে হুট উইন, যিনি নাম্বার নাইন অ্যাডভান্সড মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলের প্রশাসনিক কমান্ডার ছিলেন; কর্নেল মায়ো মিন কো কো, যিনি এলআইবি ৫৫০ এর কৌশলগত কমান্ডার ছিলেন। এ ছাড়া আইবি ২০৮-এর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফিও থু অং ও এলআইবি ৫৫০ এর মেজর স তোয়েও নিহত হয়েছেন।

এলআইবি ৩৪৪-এর ডেপুটি কমান্ডার মেজর থান্ট জিন তুন, এমওসি ৯ এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল নায়ি নায়ি উইন, আইবি ২৯৯ এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল নে লিন তুন ও মেজর জাও লিন তুন এবং এলআইবি ৩৭৮ এর স্কোয়াড্রন অফিসার মেজর থেইন থিকে সো-কে আরাকান আর্মি বন্দী করেছে।

অস্ত্র-গোলাবারুদ ও একটি হেলিকপ্টার

গত চার মাসে জান্তার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের সময় আরাকান আর্মি বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদও জব্দ করেছে। এই বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারের মধ্যে পিস্তল থেকে ভারী রকেট লঞ্চার পর্যন্ত রয়েছে। জব্দ করা গোলাবারুদের মধ্যে ছোট ক্যালিবার বুলেট থেকে শুরু করে ১০০ মিলিমিটারের বেশি কামানের গোলাও রয়েছে। পালেতোয়ার ভয়াবহ লড়াইয়ের সময় আরাকান আর্মি একটি সামরিক পরিবহন হেলিকপ্টারও গুলি করে নামাতে সক্ষম হয়েছিল।

এই মুহূর্তে আরাকান আর্মি উত্তর রাখাইনের সম্পূর্ণ দখল ও নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করায় লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই সপ্তাহে বিশেষ করে মংডু, রাথেডং ও বুথিডংয়ে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। রামরি ও কিয়াউকফিউতেও তীব্র লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের আদমশুমারির সময়, রাখাইনের জনসংখ্যা ছিল ৩১ লাখ। ইউএনএইচসিআর-এর পরিসংখ্যান অনুসারে গত ৪ মার্চ পর্যন্ত রাখাইনে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ৫০ হাজার ৯০০ জন ছাড়িয়েছে।

তথ্যসূত্র: দ্য ইরাবতী

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত