জেড পাথরের দেশ মিয়ানমারে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশটির মানুষ লড়াই করছে। এই লড়াইয়ে কমবেশি ২০টি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর নাম শোনা যায়। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা ও প্রভাবের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে আরাকান আর্মি (এএ)।
বিদ্রোহী এই দলটি মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এই রাজ্যটির সীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। বর্তমানে মিয়ানমারের অন্যান্য বিদ্রোহী দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। গত এক দশকে দলটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। তবে গত এক বছরে আরাকান আর্মির উন্নতি হয়েছে আগের যেকোনও সময়ের চেয়েও বেশি।
রাখাইন রাজ্যের আগের নাম ছিল আরাকান। এটি মূলত ছিল একটি পৃথক রাজ্য। ১৭৮৪ সালে মিয়ানমারের রাজা ওই রাজ্যটি দখল করেন। সেই থেকে আলাদা প্রদেশ হিসাবেই রয়েছে রাজ্যটি।
আরাকান আর্মি এখন তাদের ‘আরাকান ড্রিম’ বা স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। তারা আবার রাখাইন রাজ্যের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যাতে জনগণ তাদের নিজস্ব রাজনীতি, সরকার ও ভবিষ্যৎ পরিচালনার ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে। রাজ্যের জনসংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। এর ৬০ শতাংশ রাখাইন বৌদ্ধ এবং প্রায় ৩৫ শতাংশ মুসলিম রোহিঙ্গা।
আরাকান আর্মি মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বড়সড় জয় পাচ্ছে। এমন অবস্থায় তাদের পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে তারা রাখাইন রাজ্যের মুসলিম সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কী আচরণ করবে?
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগ আছে; যদিও দলটি তা অস্বীকার করেছে। এছাড়া চীনের অর্থনৈতিক আগ্রহের প্রতি তাদের অবস্থান কী হবে, তাও বিবেচনার বিষয়।
প্রতিষ্ঠাকাল
আরাকান আর্মির যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালে। মাত্র ২৫ জন সদস্য নিয়ে তখন এর নেতৃত্ব দেন সাবেক ছাত্র আন্দোলনকর্মী তোয়ান ম্রাত নাইন। দলের সদস্য সংগ্রহ ও আপৎকালীন আশ্রয় দিয়ে আরাকান আর্মিকে তখন সহায়তা করেছিল মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের বিদ্রোহী দল কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ)।
শুরুর দিকে এএ কাচিন রাজ্যের পান্না খনিতে কর্মরত রাখাইন পুরুষদের যোদ্ধা হিসেবে দলে টানে। এসময় দলটি কেআইএ এবং অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। এরপর ২০১৪ সালের দিকে দলটি শক্তি সঞ্চয় করে নিজেদের রাখাইন রাজ্যে ফিরে আসে।
২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাখাইন রাজ্যের চারটি পুলিশ স্টেশনে আক্রমণ চালিয়ে এএ তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়।
ওই সময় বেসামরিক সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন অং সান সু চি। তিনি সেনাবাহিনীকে ‘সন্ত্রাসী’ বাহিনী নির্মূলের নির্দেশ দেন। তবে পরে উভয় পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
আরাকান আর্মির উন্নতির ৪ কারণ
প্রথমত, আরাকান আর্মির নেতৃত্বে আছে একঝাঁক তরুণ ও শিক্ষিত সংগঠক। তাদের হাত ধরে সংগঠনটি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। দলের প্রধান দুই নেতা মেজর জেনারেল তোয়ান ম্রাত নাইন ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ন্যো তোয়ান আং উভয়ই রাখাইন বংশোদ্ভূত। তারা দক্ষিণ ও উত্তর রাখাইনে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ও প্রভাব রাখেন।
তোয়ান ম্রাত নাইনের জন্ম সিত্তে শহরে। ট্যুর গাইড হিসাবে তার কর্মজীবনের শুরু। এজন্য তার বিদেশি বন্ধুদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। ন্যো তোয়ান আং একজন চিকিৎসক। তিনি কিয়কপিউ শহরে জন্মগ্রহণ ও বড় হয়েছেন।
অতীতে অধিকাংশ রাখাইন রাজনৈতিক নেতা উত্তর রাখাইন থেকে আসত। ফলে দক্ষিণের অংশে প্রভাব বিস্তার করা কঠিন ছিল। তবে আরাকান আর্মির নেতৃত্ব এখন এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে।
এছাড়া রাখাইন বিপ্লবী আন্দোলনের পুরনো প্রজন্মের অভিজ্ঞতাও অন্তর্ভুক্ত করেছে এএ। সাবেক গেরিলা কর্নেল কিয়াও হান ও খাইং থু খা প্রতীকী নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অতীতে কোনও রাখাইন বিপ্লবী গোষ্ঠীর এমন সুশৃঙ্খল নেতৃত্ব কাঠামো ছিল না।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে দেখা হয় আরাকান আর্মির লক্ষ্যকে। দলটির নেতৃত্ব ২০১৭ সালে ‘আরাকান ড্রিম ২০২০’ ভিশন চালু করে। এতে রাখাইন জনগণকে রাজ্যের আরও স্বায়ত্তশাসন অর্জনের জন্য উৎসাহিত করা যায়। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের শাসনের জন্য রাখাইন পিপলস অথরিটি প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) ও এএ প্রধান তোয়ান ম্রাত নাইন রাখাইন জনগণের জন্য ‘কনফেডারেশন’ অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেন। পাশাপাশি ‘ওয়া সেল্ফ-অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিভিশনকে’ উদাহরণ হিসেবে দেখান। পরে ২০২০ সালের এপ্রিলে তিনি ‘আরাকান ড্রিম’কে ‘ওয়ে অব রাখিতা’ নীতির সঙ্গে যুক্ত করেন। একে তিনি ‘জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম এবং আরাকান জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার’ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন।
আরাকান আর্মির বৃদ্ধির তৃতীয় কারণ হলো রাখাইন জনগণের সীমিত রাজনৈতিক সুযোগ। এএ প্রতিষ্ঠার আগে, রাখাইন সম্প্রদায় মূলত নির্বাচনী দলের প্রভাবাধীন ছিল, যেমন ২০১০ ও ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে। তবে রাখাইন জনগণের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা, বিশেষ করে এএ, এনএলডির (ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি) মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
২০১৫ সালের নির্বাচনে আরাকান ন্যাশনাল পার্টি রাখাইন রাজ্যে বেশিরভাগ আসন জিতলেও এনএলডি তাদের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করতে দেয়নি। ২০১৮ সালে রাখাইন জনগণের সঙ্গে এনএলডি সরকারের উত্তেজনা বাড়ে। তখন সরকার ম্রাউক-উতে একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের আয়োজন বাতিল করে। এর প্রতিবাদে পুলিশ গুলি চালালে সাতজন নিহত ও অনেকে আহত হয়। এতে রাখাইন জনগণের অসন্তোষ বাড়ে এবং তারা এএকে সমর্থন দিতে শুরু করে।
২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এএ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই হয়। তখন এনএলডি সরকার ১৮ মাসের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, এএকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করে এবং সেনাবাহিনীকে দমন করতে আদেশ দেয়। তাতে এএ’র প্রতি রাখাইন জনগণের সমর্থন আরও বাড়ে।
২০২০ সালের এপ্রিলে, সু চি পশ্চিম সীমান্তে এএ’র বিরুদ্ধে লড়াই করা সেনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই পরিস্থিতিতে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কোনও পথ না পেয়ে আরও মানুষ এএ’র দিকে ঝোঁকে।
অন্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোট গঠন হলো আরাকান আর্মির উত্থানের চতুর্থ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বিশেষত, মিয়ানমার-চীন সীমান্তে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) সহযোগিতায় এএ গঠিত হওয়ায় তাদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়। ২০১১ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও কেআইএর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে এএ যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায়।
তবে ২০১২ সালে থেইন সেইন সরকার ও সেনা নেতৃত্বের উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে (এনসিএ) এএ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তারা চীনা সীমান্তের কোকাং, ওয়া ও কাচিন অঞ্চলের সহমতসম্পন্ন গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোট গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়।
এই জোট গঠনের ফলে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (টিএনএলএ) সঙ্গে উত্তর জোটে যোগ দেয় আরাকান আর্মি। এটি সম্ভব হয় ২০১৫ সালের কোকাং যুদ্ধের সময় এমএনডিএএর সঙ্গে এএর সহযোগিতার কারণে।
পরে এএ দেশের বৃহত্তম ও শক্তিশালী গোষ্ঠী ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ) নেতৃত্বাধীন ফেডারেল পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশন অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশন কমিটিতে যোগ দেয়। ইউডব্লিউএসএ এনসিএর বিকল্প পথ দাবি করে। এনসিএ প্রক্রিয়ায় এএকে সমান মর্যাদা না দেওয়ার ফলে এই রাজনৈতিক জোটে তাদের অংশগ্রহণ ঘটে।
ইউডব্লিউএসএর কাছ থেকে এএ নিয়মিত অস্ত্র ও সরঞ্জামসহ গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছে। অন্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সমর্থনে এএ তাদের কার্যক্রম বজায় ও প্রসারিত করতে পেরেছে।
লক্ষ্য কী
মিয়ানমারের সব বিদ্রোহী বাহিনীই সামরিক শাসনের অবসান চায়। তবে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ভিন্ন। অধিকাংশ জাতিগত সংখ্যালঘু বাহিনী এবং গণতন্ত্রপন্থী মিলিশিয়ারা (বর্মণ সম্প্রদায়ের) একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেল ইউনিয়ন চায়। তবে আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইন রাজ্যের জন্য একটি অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ‘কনফেডারেট স্ট্যাটাস’ দাবি করেছে।
আরাকান আর্মির নেতা তোয়ান ম্রাত নাইন ২০২২ সালে এশিয়া টাইমস পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের ফেডারেল ইউনিয়নে আমাদের আরাকানবাসীর জন্য চাওয়া কনফেডারেশনের জন্য রাজনৈতিক জায়গা থাকবে কি না, তা আমরা দেখব।”
২০২১ সালের অভ্যুত্থানে আরাকান আর্মির ভূমিকা
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চিকে আটক করে দেশে সেনাশাসন জারি করে। অন্য অনেক রাজনৈতিক দলের মতো তখন আরাকান আর্মিও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। কিন্তু দলটি তখনও জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়নি।
পরের দুই বছরে বারবার যুদ্ধবিরতির মধ্যেও এএ তার প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি তার রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অফ আরাকানের (ইউএলএ) মাধ্যমে তখন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রকল্পও হাতে নিয়েছিল।
২০২৩ সালের নভেম্বরে এএ শান রাজ্যের দুটি বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে জান্তা বাহিনীর উপর একটি বড় আক্রমণ চালায়। এটি ছিল ‘থ্রি ব্রাদারহুড’ জোটের অংশ হয়ে প্রথম আক্রমণ।
এরপর দ্রুতগতিতে একের পর এলাকা দখল করতে থাকে আরাকান আর্মি। প্রথমে উত্তর রাখাইন রাজ্য এবং পরে প্রতিবেশী চিন রাজ্যের দক্ষিণাংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। এসময় তারা সামরিক চৌকি, ঘাঁটি এবং শহর দখল করে। এছাড়া বড় পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদও জব্দ করে।
প্রতিরোধ বাহিনী, বিশেষ করে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পেয়ে এএ জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
২০২২ সালের এপ্রিলে তাদের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এএ প্রকাশ্যে অভ্যুত্থানবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। এ উপলক্ষে তারা সাগাইং, মাগওয়ে, চিন, আয়েয়ারওয়াদি এবং অন্যান্য অঞ্চলে অবস্থিত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী ও প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর কাছে বহু প্রচারপত্র বিলি করে।
এসব পত্রের মধ্যে অন্তত পাঁচটি প্রতিরোধ গোষ্ঠী উল্লেখ করেছে যে, তারা এএ থেকে সামরিক সহায়তা ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ পেয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ছিল বামার পিপলস লিবারেশন আর্মি (অধিকার কর্মী মং সাংখার নেতৃত্বে পরিচালিত), স্টুডেন্ট আর্মড ফোর্স (ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংঘ গঠন করেছে), পিপলস রেভল্যুশন অ্যালায়েন্স (মাগওয়ে), মারা ডিফেন্স ফোর্স ও চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ)।
একই মাসে মিন্দাত টাউনশিপের সিডিএফ শাখা এএ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরা সদস্যদের ফুটেজ প্রকাশ করে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এএর এক মুখপাত্র জানায় যে, তারা মিয়ানমারের অপ্রকাশিত কিছু অঞ্চলে স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিষয়ে সহায়তা দিয়েছে।
আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা
এএ দাবি করে, তাদের যোদ্ধার সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। যদিও স্বাধীন বিশ্লেষকদের মতে এই সংখ্যা ২০ হাজারের আশেপাশে।
দলটি রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে রাখাইনের ১০টি ও প্রতিবেশী চিন রাজ্যের একটি উপজেলাও রয়েছে। যেসব উপজেলায় তারা নিয়ন্ত্রণে নেই, সেগুলোতে তারা জান্তা বাহিনীর গতি সীমিত করে রেখেছে। এমন এলাকার মধ্যে রয়েছে রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে, আন শহর এবং কিয়কপিউ অর্থনৈতিক অঞ্চল।
সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এএ যোদ্ধারা।
রোহিঙ্গা ও এএ সম্পর্ক
রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। ফলে রাজ্যটি এএ’ই শাসন করবে, এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, আরাকান আর্মির শাসনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে। কারণ রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি আরাকান আর্মির মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে। তাদের অবস্থান প্রথমে সহিষ্ণু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মনে হলেও, এ বছর তারা গণহত্যার অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির কঠোর অবস্থানের পেছনে কারণ ছিল জান্তার একটি প্রচারণা। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জান্তা বাহিনী প্রায়ই রোহিঙ্গা পুরুষদের জোর করে মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করত।
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা রোহিঙ্গাদের ওপর আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর আক্রমণের প্রমাণ পেয়েছেন। গত ৫ আগস্ট মংডু শহর থেকে বাংলাদেশে পালাতে চাওয়া অনেক রোহিঙ্গাকে ড্রোন ও আর্টিলারি হামলায় হত্যা করা হয়। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই হামলা এএ চালিয়েছে। তবে এএ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
চীনের প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, সেনাবাহিনী থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দখল করার পাশাপাশি আরাকান আর্মি উত্তর-পূর্বের বিদ্রোহী মিত্রদের সাহায্য পেয়েছে। অর্থের জন্য তারা বিদেশে থাকা রাখাইন শ্রমিকদের কাছ থেকে কর ও দান নেয়। মিয়ানমারে মেথামফেটামিন উৎপাদকদের থেকে বাংলাদেশে বাজারে মাদকের প্রবাহের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করে এএ।
চীনের ভূমিকা মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। মিয়ানমারের দক্ষিণে চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক আগ্রহ রয়েছে। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যের কিয়কপিউতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের জন্য জ্বালানি ও অবকাঠামো কেন্দ্র রয়েছে। এখানে চীন একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে চায়।
কিয়কপিউ থেকে শুরু হয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল পাইপলাইনগুলো মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ চীন পর্যন্ত চলে। অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর মতো এএ চীনের স্বার্থে আক্রমণ করেনি। তবে তারা কিয়কপিউ শহরকে ঘিরে রেখেছে।
কিছু বিশ্লেষকের মতে, আরাকান আর্মি তার উত্তর-পূর্ব মিয়ানমারের সম্পর্কের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সংযুক্ত। তবে এখন পর্যন্ত চীনের পক্ষ থেকে এএ’কে জান্তার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাপ দেওয়ার কোনো প্রকাশ্য প্রমাণ নেই, যেমনটি তারা মিয়ানমারের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে করেছে।
তথ্যসূত্র : এশিয়া টাইমস, সিমসন, আরাকান আর্মি