ঢাকার বনশ্রীর সি ব্লকে ব্যাংক কর্মকর্তা স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন আতিক মোহাম্মদ শরীফ শামীম। সঙ্গে তাদের নয় বছরের ছেলে আয়াজ আল আমিন। তিনজনের এই পরিবার বনশ্রী এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে ভালোই ছিলেন। তবে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলন তাদের জীবন যেন পাল্টে দিয়েছে।
ঘরের ভেতরে থেকেই আতিক আর তার স্ত্রী দেখেছেন, আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা, নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, উড়ন্ত হেলিকপ্টারের আওয়াজ, যেখান থেকে ছোড়া হচ্ছে গুলি।
দিনরাত গোলাগুলি আর মানুষের চিৎকারের শব্দ শুনে কেবল এই দম্পতি নয়, তাদের নয় বছরের ছোট্ট আয়াজও বুঝতে পারে, বনশ্রী রীতিমতো একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
জীবনে প্রথম এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া আয়াজ তাই সারাক্ষণ আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকত। রাতে ঘুমাতে পারত না। তাকে সামলাতে হিমশিম খেতেন আতিক দম্পতি। ছেলেকে কখনও কোলে নিতেন তো কখনও বুকে জড়িয়ে ধরতেন। অভয় দিতেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
অভয় কেবল ছেলেকে নয়, কখনও কখনও তারা নিজেরাও নিজেদের দিতেন। পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়ে যে, ঘরের ভেতরে সামান্য শব্দে চমকে উঠতেন তারা। ছেলেকে তখন আরও বুকের কাছে জাপটে ধরতেন।
এরপর যখন একদিন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো, কারফিউ জারি করে সেনা নামানো হলো, তখন আতিক ও তার স্ত্রী আরও অসহায় হয়ে পড়েন। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তারা। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কোনও খবর না পাওয়ায় আরও যেন দিশেহারা দশা। ছেলেকে আর পরস্পরকে দেওয়া অভয়বাণী যেন জোর হারিয়ে ফেলছিল।
এভাবে চলতে চলতে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কারফিউ শিথিল করা হয়। ইন্টারনেটও চালু করা হয়। অফিস-আদালতও শুরু হয়।
তারপর আগস্টে শুরুতে সহিংসতা আবার বেড়ে গিয়ে সরকার পতনের পর জীবনযাত্রায় গতি ফিরলেও আয়াজের মনোজগতের ওপর সহিংসতার ছাপ পুরোপুরি কাটতে, আতঙ্ক থেকে একেবারে মুক্ত হতে যে আরও সময় লাগবে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
কেবল আয়াজ নয়, জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে ওঠা সহিংসতার শিকার হয় রাজধানী শহরের আরও অনেক শিশু। কারও জীবন ঘরে থেকেই কেড়ে নেয় গুলি। কেউ হয় আহত। আর যেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না, সেই মনের ওপর সহিংসতার প্রভাব পড়ে।
আয়াজের মতো অবস্থা মিরপুর-১৪ নম্বরের বাসিন্দা আহীয়ান আমীন রুহানেরও। বয়স ৮। তার মা ঐশী রহমান। তার ৬ বছরের আরেকটি ছেলে আছে, নাম আমীন নওহান।
ঐশী রহমান বলেন, “সহিংসতার সময় ছোট ছেলে ভয় পায়নি। তবে বড় ছেলে ভয়ে ভয়ে থাকত। আমার বাসার একেবারে সামনেই একদিন গোলাগুলি শুরু হয়। ঠিক তার একটু আগে জরুরি কাজে বের হতে হয়েছিল আমাদের। বাসায় ফিরতে ফিরতে ইব্রাহীমপুরে ঘরের মধ্যে একটা বাচ্চার গুলি লেগে মারা যাওয়ার খবর পাই। এতে শুধু শিশু কেন, সবাই তো ভয়ে ছিল সেসময়।”
সহিংসতায় শিশু-কিশোররাও মারা যাচ্ছে জেনে মায়ের কাছে একদিন রুহান প্রশ্ন করেছিল, “তাদের এভাবে মারছে কেন? তাহলে কি আমাদেরও মারবে?”
এমনই আরেক শিশু সাপ্পান খান। উত্তরায় ইংরেজি মাধ্যমের এক স্কুলে পড়ে সে।
সাপ্পান সেসময় কোনোভাবেই তার মাকে ঘরের বাইরে যেতে দিত না। কারণ শুরুর দিকে টেলিভিশনে সহিংসতার দৃশ্য দেখে তার মনে হতো, ঘরের বাইরে গেলেই তার মা-বাবাকে গুলি করা হবে।
এজন্য বাবা-মা কেউ বাইরে যাওয়ার কথা বললেই চিৎকার জুড়ে দিত। কান্নাকাটি করত। মায়ের আঁচল ধরে বসে থাকত। বাইরে যেতে দিত না।
সাপ্পান এখন ভালো আছে বলে জানান তার মা তানজিলা হক জেসি। বলেন, “ভয়ঙ্কর কয়েকটা দিন কাটিয়েছি সবাই। খুব আতঙ্কে ছিলাম। এখনও মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে।”
স্কুল খোলায় স্বস্তি
সহিংসতার সময় শিশুদের মনে গেড়ে বসা আতঙ্ক কাটতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত অনেকখানি ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তারা এখন স্কুলে যাচ্ছে। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছে। এতে করে সেইসব দিনরাত্রির স্মৃতি ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে তাদের মনোজগত থেকে।
যদিও স্কুল শুরুর দিকেও ছিল সেই আতঙ্ক। সংবাদমাধ্যমকর্মী সায়েদুল হক তার দুই মেয়ের প্রসঙ্গে বলেন, “স্কুল খুলে দেওয়ার খবর জানার পর আমার দুই মেয়ের একটাই প্রশ্ন, ‘বাবা, পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হয়েছে?’ শুরুতে তারা স্কুলে যেতেই চাইত না।”
চাইল্ড হেল্পলাইনের ভূমিকা
জুলাই-আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় সারাদেশে কমপক্ষে ৩২টি শিশু নিহত হয়েছে। এই তথ্য ইউনিসেফের।
শিশুরা সেসময়ের গণবিক্ষোভে কী পরিমাণ ভয়ে ছিল, তার সত্যতা মেলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের চাইল্ড হেল্পলাইনে আসা ফোনকলের সংখ্যায়।
চাইল্ড হেল্পলাইনের তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ে চাইল্ড হেল্পলাইনে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ শোর মতো ফোন আসে। সেই জায়গায় গত ১৯ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ১৭ দিনে কল আসে ৬২ হাজার ৪৮৪টি। এই কয়দিনে এত ফোনকল কেবল কোভিড মহামারির সময় ছাড়া আর আসেনি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মূলত ১৯ জুলাই থেকে ফোনকল বাড়তে থাকে। ৪ আগস্ট ছিল সর্বোচ্চ, ৪ হাজার ৬০০ টি। ঠিক তার পরদিনই শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছিল।
দুদিন পর অবশ্য ফোনকল আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
৪ আগস্ট অস্বাভাবিক ফোনকলের বিষয়ে চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ এর ব্যবস্থাপক চৌধুরী মো. মোহায়মেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একদিনে এত ফোনকল এর আগে তেমন একটা দেখা যায়নি।”
চাইল্ড হেল্পলাইনে কারা কল করতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কে করত না? শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই কল করত। অনেক অভিভাবকই ফোনকলে সন্তানদের কথা জানাতেন।”
অভিভাবকরা কী ধরনের প্রশ্ন বেশি করতেন-জানতে চাইলে চৌধুরী মো. মোহায়মেন বলেন, “ভয়, আতঙ্ক, একঘেয়েমিকেন্দ্রিক প্রশ্নই ছিল বেশি।
“উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা জানতে চাইত-পরীক্ষা হবে কি না; হলে কীভাবে হবে; পড়া ভুলে যাচ্ছে তারা; ভয় লাগছে; খেতে ইচ্ছে করছে না; ঘুম হচ্ছে না; নেট বন্ধ করে কী করছে সরকার; অনেক শিশু-কিশোর মারা গেছে-আর কত মারা যাবে; বাইরে বেরুলেই মারা যাবে কি না; যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের কী হবে; তারা ছাড়া পাবে কি না-এসব প্রশ্ন করা হতো।”
মোহায়মেন বলেন, “চাইল্ড হেল্পলাইন গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে-এমন ১৬-১৭ জনকে জামিনের ব্যবস্থা করেছে। বয়স বাড়িয়ে এসব কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমরা তাদের জামিনের আওতায় এনেছি।”
এসব ফোনকলের বিপরীতে কী ধরনের সমাধান দেওয়া হয়েছিল প্রশ্নে জানা গেল, শিশুসহ অভিভাবকদের জন্য চাইল্ড হেল্পলাইনের একটি গাইডলাইন রয়েছে। সেই গাইডলাইন অনুযায়ী পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে কেবল পরামর্শ দিয়েই সমস্যার সমাধান হবে না জানিয়ে চৌধুরী মো. মোহায়মেন বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে সব থেমে গেলেও অগোচরে অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে আমাদের।
“সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে-এমনটা মনে করছি আমরা। এটা ঠিক নয়। এই ২০-২৫ দিনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আছে। যেকোনোভাবেই হোক, শিশুদের এখান থেকে বের করে আনতে হবে। যা ঘটেছে, তার নীরব প্রভাব অনেকদিন রয়ে যাবে। এজন্য চাইল্ড হেল্পলাইনের পরামর্শ, টেলিকাউন্সেলিং সেবা অব্যাহত থাকবে।”
মোহায়মেন জানান, কর্মদক্ষতা বাড়াতে চাইল্ড হেল্পলাইনের পরামর্শদাতাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ যৌথ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
একই সঙ্গে গণবিক্ষোভ চলাকালে শিশু-কিশোরদের মনে যে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটাতেও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “শিশু-কিশোরসহ অভিভাবকদের ফোনকল এত বেশি ছিল যে, ওই সময় সরকারের অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও আমরা আমাদের সেবা যেকোনো মূল্যে চালু রেখেছিলাম। চাইল্ড হেল্পলাইন ২৪ ঘণ্টা চালু ছিল। একটা সেকেন্ডের জন্যও এটা বন্ধ হতে দিইনি আমরা।”
শিশুদের ট্রমা কাটাতে উদ্যোগ
টানা ৩২ দিন বন্ধ থাকার পর গত রবিবার খুলেছে স্কুল-কলেজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও সহিংসতায় সৃষ্ট ট্রমা থেকে শিশুরা বের হতে পারবে কি না, এই প্রশ্ন করা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কষ্ট হবে। এর জন্য বাবা-মা, পরিবারসহ বিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
“ভীষণ এক অস্থির সময়ের পর শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে। এসময় তাদের মধ্যে ভয়-অনিশ্চয়তা কাজ করবে। সেইসঙ্গে শিশুদের ঘুমের সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ, খেতে না চাওয়া, আগের মতো প্রাণোচ্ছ্বল না হওয়া এবং মনোযোগ হারানোর মতো সমস্যা দেখা দেবে। যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, সংক্ষেপে পিটিএসডি বলা হয়।”
ডা. হেলাল বলেন, “স্কুল খোলার পর অনেক শিক্ষার্থীই ক্লাসে ফিরে তাদের বন্ধুকে পাবে না। এসময়টা শিক্ষার্থীদের জন্য ভীষণ সংবেদনশীল। তারা অস্বাভাবিক যেকোনও কিছু করতে পারে।
“এজন্য শিক্ষকসহ অভিভাবকদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। তাকে তার বন্ধুর জন্য, সহপাঠীর জন্য শোক প্রকাশ করতে দিতে হবে। তার মতো করে সময় কাটাতে দিতে হবে।
“যেহেতু স্কুলেই বেশি সময় কাটায় শিশুরা, তাই স্কুল কর্তৃপক্ষকে শ্রেণিকক্ষকে আনন্দময় করে তুলতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবক বা স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের বলতে পারবে না-ভালো ফলাফল করতে হবে, স্কুল বন্ধ ছিল তাই বেশি করে পড়তে হবে, জিপিএ ফাইভ পেতে হবে।
“মনে রাখতে হবে, শিশুরা এমনিতেই পাহাড়সম চাপ নিয়ে আছে। তাদের কোনও অবস্থাতেই আরও চাপের মধ্যে ফেলা যাবে না।”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এই অধ্যাপক আরও বলেন, “শিশুদের ঘুমের রুটিন যেন ঠিক থাকে, মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের বাইরে যেন তারা থাকে, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ইন্টারনেটে ঢুকলেই তারা এখনও সহিংসতার সময়ের নানাকিছু পাবে।
“তাদের বরং সুযোগ থাকলে বাগান করতে দেওয়া, মাঠে খেলতে যেতে বলা, পোষা প্রাণী থাকলে তার সঙ্গে সময় কাটাতে দেওয়া, পরিবারের বয়স্কদের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ানোর দিকে জোর দিলে মানসিকভাবে তারা আরও ভালো থাকবে।”