স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন আজকাল। এর মধ্যে সবজি শুকিয়ে অর্থ্যাৎ ডিহাইড্রেটেড ভেজিটেবল চিপস অনেকের কাছে বিকল্প স্ন্যাকস হয়ে উঠছে।
সাধারণত চিপস বলতেই ডুবো তেলে মচমচে করে ভাজা আলুর চিপস চোখে ভাসে; তাতে আবার মুখরোচক লবণ ও মশলা ছড়িয়ে দেয়া হয়। এসব শুনে প্রিঙ্গলস, লেইস, আংকেল চিপস এবং ওয়েফার ব্র্যান্ড মনে করে সবার জিভে পানি চলে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
চিপস মানেই তো এমন মচমচে, কুড়মুড়ে মশলামাখা নোনতা স্বাদের খাবার; যা একবার খেলে বারবারই খেতে মন চাইবে।
একবার চিপসের প্যাকেট খুলে খাওয়া শুরু করলে টের পাওয়ার আগেই সব শেষ! তখন প্যাকেটের মুখ আরও একটু ছিঁড়ে নিশ্চিত হয়ে নেন সবাই ভেতরে দুয়েকটা চিপসের টুকরা রয়ে গেল কি না।
সচেতন লোকজনেরা অবশ্য একটু দ্বিধায় পড়ে যান। চিপসের স্বাদ ভালো লাগলেও উচ্চমাত্রায় সোডিয়াম থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে কপালে ভাঁজ পড়ে সবার।
এই সময়ই ডিহাইড্রেটেড ভেজিটেবল চিপস বা সবজির মচমচে চিপস নিয়ে কথা উঠছে।
ডুবো তেলে ভাজা চিপসের বদলে এখন ছোট থেকে বড় ব্র্যান্ডগুলো ঢেঁড়স, বিটরুট, কাঁঠাল, লাউ এবং গাজরের চিপস বানাচ্ছে ডিহাইড্রেশন ও ভ্যাকুয়াম ফ্রাই পদ্ধতিতে। বলা হচ্ছে আগের ক্ষতিকর চিপসের বিকল্প হচ্ছে নতুন পদ্ধতিতে বানানো সবজির এই চিপস।
এসব সবজিতেও যদিও স্বাদ বাড়াতে মশলা যোগ করা হচ্ছে।
সত্যিই কি এসব চিপস থেকে পুষ্টি মিলবে? না কি ক্রেতা টানতে এসব শুধুমাত্র বাণিজ্যিক কৌশল?
“ডিহাইড্রেটেড ভেজ চিপস আগের তেলে ভাজা চিপসের চেয়ে স্বাস্থ্যকর বিকল্প তো বটেই। তবে এই চিপস বানানোর প্রক্রিয়ার উপরই নির্ভর করছে ভালোমন্দ দিক,” ইন্ডিয়াটুডের কাছে এ কথা বললেন মোহিনী দ্রোংরে।
গুরুগ্রামের নারায়ণ হসপিটালের এই সিনিয়র ডায়েটিশিয়ান মনে করেন, “আগে চিপস মানেই ছিল তাতে আছে অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও ক্যালরি। ডিহাইড্রেটেড চিপসে সে তুলনায় অনেক কম ফ্যাট রয়েছে; তার উপর তেলেও ভাজা হয় না।
“ডিহাইড্রেশন পদ্ধতিতে চিপস বানানোর ফলে সবজির পুষ্টিগুণ নষ্ট হয় না তেমন। যেমন ফাইবার, কিছু ভিটামিন ঠিকই থাকে। এতে করে চিপসপ্রেমীরাও ডায়েটে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে।”
ডিহাইড্রেশন প্রক্রিয়ায় সবজির ভেতরের পানি শুকিয়ে নেয়া হয়। এতে করে সবজি টানা অনেকদিন ভালো থাকে। সবজির বাইরের রঙ অনেকখানি স্বাভাবিক দেখায় কোনো রকম কেমিকেল দেয়া ছাড়াই।
তবে এই পদ্ধতিতে বানানো চিপসে ভিটামিন সি ও বি কমে যেতে পারে বলে জানালেন ডায়েট এক্সপার্টস প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান ডায়েটিশিয়ান সিম্রাট কাঠুরিয়া।
“তবে ফাইবার অক্ষুণ্ণ থাকে। আবার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পলিফেনল সাধারণত অটুট থাকে।”
এরপরও হুঁশিয়ার করতে চান মোহিনী দ্রোংরে।
উচ্চ মাত্রায় সোডিয়াম ও কৃত্রিম রঙ মেশানো নিয়ে তিনি বলেন, “ডিহাইড্রেটেড চিপস বানাতে অনেকেই অত্যধিক লবণ, মশলা যোগ করছেন মুখরোচক করতে। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।”
আর এ ধরনের চিপসে চিনি মেশানো হয় কি না তা আসলে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
ভারতের অনেক ব্র্যান্ড দাবি করছে, কোনো রকম কৃত্রিম রঙে এবং রাসায়নিক মেশানো ছাড়াই চিপস বাজারজাত করছে তারা।
আর এমন হলে তা অবশ্যই ইতিবাচক, বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তবে শুধু চিপসের মোড়কের গায়ে এসব লিখে রাখলেই হবে না; পেছনে চিপস বানানোর প্রক্রিয়াতেও এসব নিয়ম মানতে হবে।
বাইশ বছর ধরে স্বাস্থ্যখাতে কাজ করছেন ডিম্পল গনেত্র। আহমেদাবাদের এই চিকিৎসক ২০২২ সালে নিজের ব্র্যান্ড ‘হেলদি গ্রাবজ’ চালু করেছেন; বাজারে এনেছেন ডিহাইড্রেটেড সবজির চিপস।
তিনি বললেন, “বছরের পর বছর অনেক রোগী দেখার পর আমার মনে হলো, মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রয়োজন রয়েছে।
“আমরা ডায়বেটিস ও হৃদযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত রোগী পাই প্রচুর। এসব দেখে আমি এক সময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম।”
“সবজিতে পুষ্টির মান ভালো ভাবেই রয়েছে। আর আমাদের আজকাল ফাইবার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এসবের সমাধান হিসাবে আমরা ডিহাইড্রেটেড সবজি নিয়ে কাজ শুরু করি।”
নিজস্ব কারখানায় যন্ত্রপাতি বসিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এখানে এয়ার-ফ্রাইং পদ্ধতিতে ঢেঁড়স, লাউ, গাজর, বিটরুট, আলুর মচমচে চিপস বানানো হয়।
এসব চিপস বানাতে তেলের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। শুধু ০.১ শতাংশ তেল ছিটিয়ে দেয়া হয়, যা উপকরণ তালিকায় বলা থাকে।
“আমাদের বানানো মচমচে ঢেঁড়শ টাটকা সবজির মতই পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে পারে”, জানালেন ডিম্পল।
তবুও মেপে খেতেই হবে
যতই পুষ্টিগুণ থাকুক না কেন, একটু মেপে খাওয়ার বিকল্প নেই।
পানি টেনে নিয়ে বানানো এসব মচমচে চিপস এক বসাতে অনেকগুলো খেয়ে ফেলা যায় সহজেই।
এ নিয়ে সিম্রাট কাঠুরিয়া বললেন, “কতটুকু খাচ্ছেন তা খেয়াল করা জরুরি।
“এখানেই সাধারণত ভুল করেন সবাই। বেশিরভাগ মনে করেন, যেহেতু স্বাস্থ্যকর বলা হচ্ছে তাহলে বেশি করে বুঝি খাওয়া যাবে এসব চিপস।”
একই ভাবে হুঁশিয়ার করে দ্রোংরে বলছেন, “পানি টেনে নিয়ে বানানো হয় বলে এসব চিপস বেশ হালকা নয়। আর এ কারণে একটু বেশি বেশি খেয়ে নেন অনেকেই।”
ভ্যাকুয়াম ফ্রায়েড চিপসও আজকাল একই রকম জনপ্রিয় হচ্ছে বাজারে। এসব চিপসও তেলে ভাজা চিপসের চেয়ে স্বাস্থ্যকর বলে প্রচারণা চলছে।
ভ্যাকুয়াম ফ্রাই মানে হলো কম তাপমাত্রা ও কম চাপে এসব সবজির চিপস বানানো হচ্ছে। উচ্চতাপে হলে পুষ্টিগুণ কমে যায়, সেখানে ভ্যাকুয়াম ফ্রাই পদ্ধতিতে বানানো চিপসে পুষ্টি অটুট থাকছে।
“১৬০-১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বদলে ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং পদ্ধতিতে সাধারণত ৮০-১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ভাজা হয়।”
“এভাবে বানানো চিপস তেল কম শোষণ করে। সুগন্ধ ঠিক থাকে। চর্বিও কম হয়”, বললেন স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস বানানোর দাবিদার ফ্যাবিটো ব্র্যান্ডের মার্কেটিং হেড অবিনাশ গুট্টা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরেকটু খোলাসা করে বলছেন, ডিহাইড্রেটেড বা ভ্যাকুয়াম ফ্রাইড ভেজিটেবল চিপস একেবারে তেল ছাড়া হয় না। তবে সাধারণ চিপস থেকে এতে তেলের পরিমাণ বেশ কমই লাগে।
গুট্টা বলেন, ভ্যাকুয়াম ফ্রায়েড চিপসের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাস্থ্যকর ভাবে বানিয়েও আগের বাণিজ্যিক চিপসের মতই মুখরোচক স্ল্যাকসের স্বাদ দেয়া।
“অবশ্য ডিহাইড্রেটেড চিপসের আবরণ খানিকটা শক্ত হয়, যা বাণিজ্যিক চিপসের মত মচমচে পাতলা হয় না।”
ডিম্পলের হেলদি গ্রাবজের মতো আরো কিছু ব্র্যান্ড ডিহাইড্রেশন ও এয়ার-ফ্রাইং পদ্ধতি মিলিয়ে চিপস বানাচ্ছে; চিপসের পুষ্টিও থাকে আবার খেতে কুড়মুড়ে হয়।
তবে ডিহাইড্রেটেড বা ভ্যাকুয়াম ফ্রায়েড সবজি চিপস কখনই বাজার ও অনলাইন থেকে খোলা কেনা ঠিক হবে না।
ব্যাঙ্গালুরুতে নারিশ উইথ সিম ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা ও পুষ্টিবিদ সিমরান চোপড়ার পরামর্শ হচ্ছে, দোকান থেকে চিপস কেনার চেয়ে একটি ডিহাইড্রেটর মেশিন কিনে বাড়িতে রাখাই ভালো।
কিন্তু এসব ডিহাইড্রেটেড চিপস কি টাটকা সবজির বিকল্প হতে পারে?
মনে রাখতে হবে, ভেজিটেবল চিপস কখনই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকা সবজির বিকল্প হতে পারে না।
“টাটকা ও রান্না করা সবজির পুষ্টিগুণ স্বাস্থ্যে আরো বড় ভূমিকা রাখে”, বললেন দ্রোংরে।
আর সিমরান চোপড়া বলছেন, “মাঝেমধ্যে ডিহাইড্রেটেড সবজির চিপস খাওয়া ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে এসব টাটকা সবজি খাওয়ার বিকল্প করা যাবে না।”