Beta
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

স্কুলে যাওয়া বন্ধ; আফগান মেয়েদের কাছে মাদরাসাই বিকল্প

Madrasa
[publishpress_authors_box]

আমিনার ১২ বছর বয়সে হঠাৎ করে এক মুহূর্তে বদলে যায় তার শৈশব। তাকে জানানো হলো, ছেলেদের মতো সে আর স্কুলে যেতে পারবে না। ওই মুহূর্তটিকে কখনও ভুলতে পারবে না আমিনা।

আফগানিস্তানে নতুন শিক্ষাবর্ষ গত শনিবার শুরু হয়েছে। কিন্তু টানা চার বছর ধরে ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ।

তাইতো আমিনার আবেগি কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, “আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেল।”

আমিনার বয়স এখন ১৫। সে চেয়েছিল ডাক্তার হতে। শৈশবে হৃদরোগের কারণে তাকে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল। যে নারী সার্জন তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন, সেই দৃশ্য তার মনে আজও গেঁথে আছে। সেটাই তাকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে অনুপ্রাণিত করে।

কিন্তু ২০২১ সালে, তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেওয়ার পর আমিনার স্বপ্ন থমকে যায়।

আমিনা বিবিসির সাংবাদিককে বলছিলেন, “বাবা যখন বললেন, স্কুল বন্ধ। তখন আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। এটি ছিল খুবই খারাপ অনুভূতি। আমি পড়াশোনা করতে চেয়েছিলাম, যাতে ডাক্তার হতে পারি।”

আমিনা।

জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, তালেবানের আরোপিত এই শিক্ষা নিষেধাজ্ঞার ফলে ১০ লাখেরও বেশি আফগান কিশোরী শিক্ষার সুযোগ হারিয়েছে।

আফগানিস্তানে এখন অনেক নারী ও কিশোরীর জন্য মাদরাসাই একমাত্র শিক্ষার পথ। এসব শিক্ষা কেন্দ্র শুধু ইসলামিক শিক্ষা দেয়। তবে যেসব পরিবার বেসরকারি টিউশনের খরচ বহন করতে পারে, তাদের সন্তানরা গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষার মতো বিষয়গুলো পড়ার সুযোগ পায়।

কেউ কেউ মনে করেন, মাদরাসা কিছুটা হলেও মেয়েদের জন্য শিক্ষার বিকল্প হতে পারে। তবে অনেকের মতে, এটি মূলধারার শিক্ষার বিকল্প নয় এবং কিছু ক্ষেত্রে মগজ ধোলাইয়ের আশঙ্কাও রয়েছে।

আমিনার সঙ্গে কাবুলের আল-হাদিস মাদরাসার স্যাঁতস্যাঁতে নিচতলায় দেখা হয় সাংবাদিক মাহজুবা নওরোজির। মাদরাসাটির বয়স বেশিদিন না। সেখানে প্রায় ২৮০ জন মেয়ের বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে।

নিচতলা ঠাণ্ডা, দেয়ালগুলো কার্ডবোর্ডের এবং হিম শীতল বাতাস ঢুকে পড়ে। প্রায় ১০ মিনিট কথা বলার পর ঠাণ্ডায় আর বসে থাকতে পারছিলেন না ওই সাংবাদিক। তার পা দুটো আড়ষ্ট হয়ে আসছিল।

আল-হাদিস মাদ্রাসা এক বছর আগে আমিনার ভাই হামিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তার বোনের ওপর শিক্ষার নিষেধাজ্ঞার প্রভাব দেখার পর এটি করতে বাধ্য হন।

হামিদ বলেন, “মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হলে আমার বোনের হৃদরোগের সার্জন হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায়। এই ঘটনা ওর মানসিক অবস্থাকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করেছিল। স্কুলে ফিরে যাওয়ার সুযোগ এবং মায়েদের সাহায্য ও প্রাথমিক চিকিৎসা শেখার মাধ্যমে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে মনোভাব অনেক ভালো হয়েছে।”

আফগানিস্তান একমাত্র দেশ যেখানে নারীদের এবং মেয়ে শিশুদের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

তালেবান সরকার প্রথমে বলেছিল, এই নিষেধাজ্ঞা অস্থায়ী হবে এবং কিছু শর্ত পূরণের পর তা তুলে নেওয়া হবে, যেমন একটি ‘ইসলামিক’ পাঠ্যক্রম। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে বড় মেয়েদের জন্য স্কুল খোলার কোনও অগ্রগতি হয়নি।

গত জানুয়ারিতে আফগানিস্তান মানবাধিকার কেন্দ্র একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, মাদরাসাগুলো তালেবানের আদর্শিক লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, মাদরাসাগুলোর পাঠ্যক্রমে “চরমপন্থী” বিষয়বস্তু যুক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটি বলছে, তালেবান যে পাঠ্যবইগুলো প্রবর্তন করেছে, তা তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমের পক্ষে সমর্থন করে। পুরুষ ও নারীদের মেলামেশা নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করার পক্ষে।

আফগানিস্তান মানবাধিকার কেন্দ্র এই নিষেধাজ্ঞাকে “প্রণালীবদ্ধ ও লক্ষ্যভিত্তিক লঙ্ঘন” হিসেবে অভিহিত করেছে। এর ফলে মেয়েদের মানসম্পন্ন শিক্ষার অধিকার হরণ হয়েছে বলেও মনে করে কেন্দ্রটি।

তালেবানের আগমনের আগে নিবন্ধিত মাদরাসার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার ছিল। এই মাদরাসাগুলো ধর্মীয় শিক্ষার ওপর  জোর দিত। এর মধ্যে কোরআন, হাদিস, শরীয়া আইন ও আরবি ভাষা পাঠ্য ছিল।

কিন্তু মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ হওয়ার পর কিছু মাদ্রাসা অন্যান্য বিষয় যেমন রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত, ভূগোল, এবং দারি, পশতু, ইংরেজি ভাষা পড়ানো শুরু করেছে। কিছু মাদরাসা প্রসব ও প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছিল। তবে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে তালেবান মহিলাদের জন্য চিকিৎসা প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ করে।

হামিদ।

হামিদ জানিয়েছিলেন, তিনি মাধ্যমিক স্কুল বয়সী মেয়েদের জন্য ধর্মীয় এবং অন্যান্য একাডেমিক বিষয়গুলোর সংমিশ্রিত শিক্ষা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

নিজের বোনের কথা চিন্তা করে তিনি বলেন, “অন্য মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করে আমার বোন অনেক খুশি হয়েছে।”

কাবুলে একটি স্বাধীনভাবে পরিচালিত মাদরাসা শেখ আবদুল কাদের জিলানি মাদরাসা। এতে ৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ১ হাজার ৮০০ এর বেশি মেয়ে ও নারী পড়াশোনা করে। ক্লাসগুলো বয়সের পরিবর্তে শিক্ষার্থীর দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে আয়োজন করা হয়।

আল-হাদিস মাদ্রাসার মতো এখানেও তীব্র ঠাণ্ডা। তিনতলা ভবনটিতে কোনও হিটার নেই। কিছু শ্রেণীকক্ষে দরজা বা জানালা নেই। একটি বড় কক্ষে দুটি কোরআন ক্লাস এবং একটি সেলাই ক্লাস একত্রে চলছে। এক দল মেয়ে হিজাব ও মুখে ঢেকে কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে।

বিদ্যালয়ে একমাত্র তাপের উৎস হলো পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বারাকজাইয়ের দ্বিতীয় তলার অফিসে রাখা একটি ছোট বৈদ্যুতিক রেডিয়েটর।

বারাকজাই জানান, একাডেমিক বিষয়গুলো ধর্মীয় বিষয়গুলোর পাশাপাশি পড়ানো হয়। কিন্তু যখন প্রমাণ চাওয়া হয়, তখন স্টাফরা কিছু সময় খোঁজাখুঁজির পর কিছু পুরনো গণিত ও বিজ্ঞান বই বের করেন। অন্যদিকে শ্রেণীকক্ষে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো ভালোভাবে সজ্জিত রয়েছে।

মাদরাসাটি দুটি অংশে বিভক্ত: আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক। আনুষ্ঠানিক অংশে ভাষা, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও ইসলামিক শিক্ষা পড়ানো হয়। অনানুষ্ঠানিক অংশে কোরআন শিক্ষা, হাদিস, ইসলামিক আইন ও প্রাত্যহিক দক্ষতা যেমন সেলাই শেখানো হয়।

মজার বিষয় অনানুষ্ঠানিক অংশের গ্র্যাজুয়েটরা আনুষ্ঠানিক অংশের গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় ১০ গুণ বেশি।

২০ বছর বয়সী হাদিয়া সম্প্রতি মাদরাসা থেকে স্নাতক হয়েছেন। তিনি গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং ভূগোলসহ বিস্তৃত বিষয়ের পাঠ নিয়েছিলেন। তিনি রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা নিয়ে আবেগপূর্ণভাবে বলেন, “আমি বিজ্ঞান ভালোবাসি। এটি সবকিছু সম্পর্কিত—ম্যাটার এবং এই ধারণাগুলো কীভাবে আমার চারপাশের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কিত।”

এখন হাদিয়া মাদরাসায় কোরআন পড়ান। কারণ তিনি জানান, তার পছন্দের বিষয়গুলোর জন্য তেমন চাহিদা ছিল না।

আরেক ২০ বছর বয়সী সাফিয়া আল-হাদিথ মাদরাসায় পশতু ভাষা পড়ান। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ধর্মীয় কেন্দ্রগুলিতে মেয়েদের তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন বাড়ানো উচিত।

তিনি ফিকাহতে (ইসলামিক আইন) মনোযোগ দেন। এটি দৈনন্দিন মুসলিম কার্যক্রমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “ফিকাহ মূলধারার স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। একজন মুসলিম নারী হিসেবে, ফিকাহ পড়াশোনা করা নারীদের উন্নতির জন্য জরুরি। ঘুসল (অবলুশন), নামাজে লম্বা শয্যার মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য এবং নামাজের পূর্বশর্তগুলো বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

তবে তিনি মনে করেন, মাদরাসাগুলো মূলধারার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প হতে পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমাদের সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আফগানিস্তানে জ্ঞান ধীরে ধীরে কমে যাবে।

শেখ আবদুল কাদের জিলানি মাদরাসায় পড়াশোনা করেন ১৩ বছরের তাওকা। তিনি একটি ধার্মিক পরিবারের সদস্য এবং তার বড় বোনের সঙ্গে ক্লাসে যান।

তিনি বলেন, “ধর্মীয় বিষয়গুলো আমার প্রিয়। একজন নারীকে কী ধরনের হিজাব পরা উচিৎ, তাকে তার পরিবারের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, তার ভাই এবং স্বামীকে কীভাবে ভালোভাবে আচরণ করতে হবে এবং কখনও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা উচিৎ নয়, আমি এসব শিখতে পছন্দ করি।

“আমি একজন ধর্মীয় মিশনারি হতে চাই এবং বিশ্বের মানুষের সঙ্গে আমার বিশ্বাস শেয়ার করতে চাই।”

আফগানিস্তানে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি রিচার্ড বেনেট তালেবানের সীমাবদ্ধ মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির ওপরের মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুযোগ এবং নারীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পুনঃস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।

বেনেট সতর্ক করে বলেছেন, সীমিত শিক্ষা, উচ্চ বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘ভ্রষ্ট উগ্র মতবাদ তৈরি হতে পারে। ঘরোয়া সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়তে পারে। আর এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে।”

তালেবান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, আফগানিস্তানে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী এই ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ভর্তি রয়েছে। তারা কিছু শর্তের অধীনে মেয়েদের স্কুল পুনরায় খুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।

তবে সব চ্যালেঞ্জ, স্বাস্থ্য সমস্যা ও শিক্ষার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আমিনা আশাবাদী। তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন তালেবান স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেবে। আর তার হৃদরোগ সার্জন হওয়ার স্বপ্নও পূরণ হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত