Beta
শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

কমরেড হায়দার আকবর খান রনোকে যেভাবে দেখেছি

কমরেড হায়দার আকবর খান রনো। গ্রাফিক্স: সকাল সন্ধ্যা ক্রিয়েটিভ টিম।

কমরেড হায়দার আকবর খান রনো প্রয়াত হলেন। দেশের সকল ধরনের মিডিয়াতেই তাঁকে নিয়ে বহু আলোচনা হচ্ছে। খুবই সংগত কারণে এটা হবে। তিনি জীবনের শেষ কয়েকটি বছর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ছিলেন।

এ দেশের কমিউনিস্ট ধারার যে পার্টি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি হিসেবে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ে, বামপন্থী আন্দোলনের ধারায় কাজ করছে, সেই ধারা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার তিনি একজন অন্যতম মূল কারিগর ছিলেন, অবশ্য সেই ধারার সঙ্গে তিনি শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। এ সম্পর্কে তাঁর আজীবন সহযোদ্ধা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় উল্লেখ করেছেন। কমরেড মেনন ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু, রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, কিছুটা হলেও একই পরিবারের সহোদরের মতো। ফলে তাঁর উপলব্ধি, আবেগ, বিশ্লেষণ অন্যদের থেকে পৃথক হবে সেটাই স্বাভাবিক।

এ দেশের কমিউনিস্ট ধারার যে পার্টি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি হিসেবে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ে, বামপন্থী আন্দোলনের ধারায় কাজ করছে, সেই ধারা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার তিনি একজন অন্যতম মূল কারিগর ছিলেন, অবশ্য সেই ধারার সঙ্গে তিনি শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। এ সম্পর্কে তাঁর আজীবন সহযোদ্ধা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় উল্লেখ করেছেন।

আমি ছিলাম তাঁর দলের একজন কর্মী। ১৯৭২ সালের আগে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবার কোনও সুযোগ ছিল না। আমি এক অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা মানুষ। তিনি মূলতঃ শহুরে উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। বয়সের পার্থক্য প্রায় ১০ বছর, যা এক প্রজন্ম নির্ধারণ করে। ১৯৭২ সালে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। স্বাধীনতা পরবর্তী  সময়ে, ছাত্রলীগের ব্যাপক আধিপত্যের সময়কালে তথাকথিত ‘পিকিং পন্থী’ বলে পরিচিত একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলা দুরূহ কাজ ছিল সন্দেহ নেই। সেই সুবাদে আমি বরং কমরেড রনোর অনুজ কমরেড জুনোকেই প্রথম দেখি। তাঁর সাবেক সহধর্মিনী হাজেরা আপা, যিনি প্রায় আমাদের সমবয়সী, তাঁর সংগেও পরিচয় হয়।

বক্তৃতারত কমরেড হায়দার আকবর খান রনো, আশির দশকের এক জনসভায়।

কমরেড রনো তখন সদ্য গড়ে ওঠা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (লেনিনবাদী) তরুণ নেতা। পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড অমল সেন, অন্যান্য নেতাদের মধ্যে কমরেড নজরুল ইসলাম, কমরেড নাসিম আলী, কমরেড শামসুল হুদা প্রমুখের সঙ্গে একটু আলাদা ঘনিষ্টতা হয়েছিল, কারণ প্রথম দিকে তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। মূলত আমার নিজের কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি আকর্ষণ থেকেই। তারপর এক প্রশিক্ষণ বৈঠকে কমরেড রনোর সঙ্গে পরিচয়। প্রথম দিনই মার্ক্সবাদের তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর সহজ সরল ব্যাখ্যা করার তাঁর সহজাত ক্ষমতার প্রতি এমন এক আকর্ষণ অনুভব করি, যা সারাজীবন অক্ষুণ্ন ছিল।

আর একটি বিষয় আমাদের কাছাকাছি করে তা হলো, আমি নিজে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ডিগ্রি শেষ করতে পারেননি রাজনৈতিক কারণে। তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইতে তা বলেছেন। কমরেড মেননও তাঁর নিজের বইতে তা উল্লেখ করেছেন। এটা এজন্য বললাম যে ষাটের দশকে একটা সময়ে বহু মেধাবী ছাত্র তাঁদের সকল ধরনের তথাকথিত ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে রাজনীতি করেছেন। ১৯৭১ সালে জাতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই আত্মত্যাগ আর আত্মাহূতির চুড়ান্ত অভিষেক সম্পন্ন হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর সেই ধারা কমতে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে তথাকথিত মেধাবী তকমা থাকার ফলে আমার রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে এক ধরণের মিশ্র ধারণা নেতাদের মধ্যেও ছিল যে আমি আদৌ এই রাজনীতিতে কতদিন টিকে থাকব। অন্যরা এটা উল্লেখ করতেন না কিন্তু রনো ভাই আমাকে সরাসরি বলেছিলেন, আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? তখন তরুণ  মনে একটু কষ্ট লাগলেও, পরে বুঝেছি, তিনি সততার সঙ্গেই বিষয়টি আমাকে বলেছিলেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য কোনও চাকরিতে যোগদান না করে পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে গেলে রনো ভাই অনেকবার একথা উল্লেখ করেছেন। তারপর বিশ বছর পর যখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি, তখন পার্টির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলেও রনো ভাই এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলেন, কারণ আমি কোনওদিনই পার্টির দায়িত্ব ছেড়ে যাইনি। এ বিষয়েও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী আমার কাছে অন্যদের থেকে আলাদা মনে হয়েছে।

শৈশবে বাবা মার সঙ্গে রনো ও জুনো দুই ভাই।

এখন আসা যাক তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হিসেবে আমার দেখা কমরেড রনোকে। আমি ১৯৭৬ সালে লেনিনবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই। তারপর কমরেড রনো পার্টি ছেড়ে যাবার সময় পর্যন্ত দীর্ঘ তিন দশক আমরা একই ফোরামে কাজ করেছি। রাজনৈতিক মতামতের ঐক্য ও অনৈক্য হয়েছে। সাংগঠনিক বিষয়েও একই কথা। কিন্তু রনো ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের তিক্ততা কখনও হয়নি।

সত্তরের দশকে প্রধান যে রাজনৈতিক বিষয় তৎকালীন বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে প্রাধান্যে ছিল তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়ন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক কৌশল, বাকশাল হবার পর বাকশাল সম্পর্কে মূল্যায়ন, পরবর্তীকালে ’৭৫ এর পটপরিবর্তন, ৭ নভেম্বর-এর তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের মূল্যায়ন, এরপর জেনারেল জিয়ার ক্ষমতায় আসা আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত পার্টি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনা পার্টির ভূমিকা, আফগানিস্তানে বামপন্থীদের ক্ষমতা গ্রহণ এবং সোভিয়েত হস্তক্ষেপ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেশে কমিউনিস্ট ঐক্যের প্রক্রিয়ার এগিয়ে নেওয়া।

এই স্বল্প পরিসরে এসব বিষয়ের বিস্তৃত আলোচনা করা যাবে না, কিন্তু বিষয়গুলো এজন্যেই তুললাম যে, এ দেশের বাম আন্দোলনে এই বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং যার ফলশ্রুতিতে বিভক্তি বা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আর নেতা হিসেবে কমরেড রনোর প্রত্যেকটি বিষয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্য ছিল এবং তাঁর ভিত্তিতে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকা ছিল। দেশের পত্র পত্রিকা আলোচনা সব ক্ষেত্রে তাঁকে একজন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, আসলে তিনি মার্ক্সীয় সাহিত্যে অনেকের চেয়ে গভীর পড়াশুনা করেছেন, সেটা অনেকেই করতে পারেন, অনেকে করেনও। কিন্তু তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ এক্টিভিস্ট। মার্ক্সের যে বিখ্যাত উক্তি, “এ যাবতকাল দার্শনিকরা পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসলে কাজটা হলো তাকে পরিবর্তন করা’। সেটা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন।

মার্ক্সীয় মতাদর্শের মৌলিক ভিত্তি হলো অনুশীলন। সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ। আমার দৃষ্টিতে মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক হিসেবে, অন্যদের থেকে তাঁর পার্থক্য হলো, তিনি প্রায়োগিক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক। তাঁর সঙ্গে আমার অন্ততঃ ঐক্য আর পার্থক্যের ভিত্তি ছিল তাই। অনেক বাস্তব বিষয় তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে লড়াই করেছি, অনেক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে ভিন্ন রাজনৈতিক পথ নিয়েছি। সেখানে ভাবাবেগ প্রশ্রয় পায়নি। ব্যক্তিগতভাবে কমরেড হায়দার আকবর রনোর সঙ্গে আমার সম্পর্কের ভিত্তি ছিল এটাই। তা নাহলে, সামাজিক কোনও ভিত্তিতে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের কোনও সুযোগ ছিল না। আমি আগেই বলেছি তিনি ছিলেন শহরের উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা মানুষ আর আমি একেবারে অজপাড়াগাঁ থাকে আসা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলে। মার্ক্সবাদ আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করেছে, তাঁর সঙ্গে ঐক্য তৈরি করেছে, অনৈক্য তৈরি করেছে। কিন্তু দুজনের স্বপ্ন ছিল এক আর তা হলো এক বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়া এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজে উন্নীত হওয়া।

কমরেড রনো গোটা জীবন দিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর ঠিক-বেঠিক সবই পরবর্তী প্রজন্মকে রাস্তা দেখাবে। তিনি ছিলেন এই লড়াইয়ের সৎ সৈনিক এবং সেনাপতি। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে আমরা শোকেগ্রস্ত হয়েছি, কিন্তু তাকে নিয়ে এদেশের প্রগতিশীল মানুষদের, সংগ্রামী মানুষদের গর্ব ছাড়া, লজ্জার কিছু নেই। তাঁর পরিণত জীবন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অনপনীয় কালিতে লেখা থাকবে।

দেশীয় পুঁজিবাদ তা যে স্তরেরই হোক এবং তাঁর বৈশ্বিক প্রভু সাম্রাজ্যবাদ যে সকল সংকটের উৎস তা নিয়ে বোধহয় আমাদের অমিল ছিল না। আর আজকে যে দক্ষিণপন্থী শক্তির দেশে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রসার হচ্ছে সেটাও যে বৈশ্বিক পুঁজিবাদের নয়া উদারনীতিবাদের উপজাত এ বিষয়েও বোধহয় খুব পার্থক্য ছিল না। হয়ত এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইটা কি কৌশলে করতে হবে সেটাই অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে।

কমরেড রনো গোটা জীবন দিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর ঠিক-বেঠিক সবই পরবর্তী প্রজন্মকে রাস্তা দেখাবে। তিনি ছিলেন এই লড়াইয়ের সৎ সৈনিক এবং সেনাপতি। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে আমরা শোকেগ্রস্ত হয়েছি, কিন্তু তাকে নিয়ে এদেশের প্রগতিশীল মানুষদের, সংগ্রামী মানুষদের গর্ব ছাড়া, লজ্জার কিছু নেই। তাঁর পরিণত জীবন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অনপনীয় কালিতে লেখা থাকবে। তাঁর বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার প্রতি লাল সালাম। এ লড়াই অব্যাহত থাকবে।

লেখক: পলিটব্যুরোর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত