ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোই এখন সুদের হার নির্ধারণ করে। এর ফলে ঋণের সুদের হার বেড়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।
তারপরও দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেশ খানিকটা বেড়ে দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে উঠেছে।
তবে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তার প্রভাবে বেসরকারি খাতে ঋণের অঙ্ক বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ।
মার্চ মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা ছিল নয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তার আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ; জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ।
গত ৯ মে সুদহার নির্ধারণের সব ধরনের কলাকৌশল তুলে দিয়ে তা ‘বাজারভিত্তিক’ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে নিজেদের সুবিধামতো সুদহার নির্ধারণের অধিকার ফিরে পেয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে সব ধরনের ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে গেছে।
ঋণের সুদহার ‘সম্পূর্ণরূপে বাজারভিত্তিক’ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণের সর্বশেষ পদ্ধতি ‘স্মার্ট’ বিলুপ্ত হয়েছে। ৯ মাস চালু ছিল স্মার্ট বা ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ ভিত্তিক সুদ নির্ধারণ।
একই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয় ডলারের দামও। ১১০ টাকা থেকে এক লাফে ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১১৮ টাকা।
২০২০ সালের এপ্রিলের আগেও ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক ছিল। তবে এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এই হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছিল।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মে মাসে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি যেটা বেড়েছে সেটা আসলে ডলারের দাম এক দিনের ব্যবধানে ৭ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির কারণে হয়েছে।
“ডলারের দাম বাড়ায় পণ্য আমদানির জন্য যে ডলারের প্রয়োজন হয়, সেই ডলারের জন্য বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়েছে। যার কারণে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হয়েছে। সে কারণেই ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।”
একই কথা বলেছেন, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বেশ কিছুদিন আমদানি ব্যয় কম ছিল। কিন্তু রোজা ও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আমদানি বেশ খানিকটা বেড়েছে। সে কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।”
ডলারের দর বৃদ্ধি ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ার একটি কারণ বলে জানান এই ব্যাংকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে ৬৭৫ কোটি ৩০ লাখ (৬.৭৫ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে ১৬ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
গত বছরের এপ্রিলে ৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। যা ছিল আগের বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৩২ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম।
এপ্রিলের মত গত মে মাসেও পণ্য আমদানিতে খরচ বেড়েছে বেড়েছে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
২১ মাস পর ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে, ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমে আসে। আগস্টে তা আরও কমে নামে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে আরও খানিকটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে নামে।
পরের মাস অক্টোবরে এই সূচক বেড়ে দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে, ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ উঠেছিল। নভেম্বরে তা ফের এক অঙ্কের ঘরে, ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ নেমে আসে। ডিসেম্বরে ফের দুই অঙ্কের ঘরে, ১০ দশমিক ১৩ শতাংশে ওঠে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
লক্ষ্যের অনেক পেছনে থাকায় গত বছরের ১৮ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, তাতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে ১১ দশমিক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
তবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত ১৭ জানুয়ারি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়।
মে মাসে সেই লক্ষ্যের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
২০২২ সালের আগস্টে প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।
২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
মহামারীর ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।