তখন কেবল স্বাধীন হয়েছে বাংলার ভূমি। দেশব্যাপী চলা তাণ্ডবে অনাথ হয়ে পড়েছে অনেক শিশু, জন্ম হয়েছে যুদ্ধশিশুদেরও। বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যায়, অনেক শিশুকে দত্তক দেওয়া হয় নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্কে। সেই সময়ে দত্তকের আড়ালে অনেক শিশু পাচারের শিকার হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। পঞ্চাশ বছর পরে সেসব ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। ডেনমার্কে বেড়ে ওঠা আশার মনে শঙ্কা, হয়তো এসব শিশুর একজন তিনিও।
বাংলাদেশের মেয়ে আশাকে ১৯৭৬ সালে দত্তক নেয় ডেনমার্কের একটি পরিবার। সেখানে তার নতুন নাম হয় আশা ওয়েলস। ‘বাবা-মার খোঁজে ডেনমার্ক থেকে আসছেন আশা’ শিরোনামে গত ২৫ জানুয়ারি একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় সকাল সন্ধ্যায়। সংবাদটি প্রকাশের পর বিভিন্ন সময়ে আশার সঙ্গে আলাপ হয় সকাল সন্ধ্যার। আশা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, দত্তকের নামে তিনিও পাচারের শিকার হতে পারেন। সেজন্য পুরো বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করতে আবার আসছেন বাংলাদেশে।
আশা ওয়েলসের কাহিনী
জন্মের পরপরই আশার ঠাঁই হয়েছিল খুলনার সোনাডাঙ্গার এক অনাথ আশ্রমে। এর কয়েকদিন পরই তার জায়গা হয় ঢাকার আরেক এতিমখানায়। সেখান থেকে ১৯৭৬ সালে তাকে দত্তক নেয় ডেনমার্কের একটি পরিবার।
এরপর থেকে ডেনমার্কেই কাটছে আশার জীবন। মাঝে একবার বাংলাদেশে এসেও স্বজনদের সন্ধান না পেয়ে ফিরে যান। সঙ্গী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে এখন তার সংসার। কিন্তু জানেন না নিজের নামটা কে রেখেছিলেন সেকথাও। বছরের পর বছর এই কষ্ট চাপা দিয়ে রাখলেও এখন আর পারছেন না। তাই নিজের ইতিহাস সন্ধানে মার্চে আবারও বাংলাদেশে আসছেন তিনি।
আশা সকাল সন্ধ্যাকে জানান, ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসেন। খুলনার মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে যান। তখন তার সঙ্গে ড্যানিশ টিভির একজন প্রতিনিধি ছিলেন। সেখানে গিয়ে আশা তার নামে সংরক্ষিত কাগজপত্র দেখতে চান। একজন নান বেজমেন্ট থেকে কিছু ডকুমেন্ট নিয়ে আসেন। সেসব দেখে তারা আশাকে বলেন, খুলনার রেললাইনের কাছে তাকে কুড়িয়ে পাওয়া যায়। একজন ক্যাথলিক নারী তাকে খুঁজে পান। সেই নারী কয়েক দিনের জন্য আশাকে তার বাড়িতে নিয়ে রাখেন। পরে তিনিই তাকে খুলনার মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে নিয়ে যান।
কিন্তু সেই নান তখন তাকে কোনও কাগজপত্র হস্তান্তর করতে চাননি। তারা আশাকে জানান, সাধারণ শিশুদের দত্তক দেওয়ার আগে বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় পাঠানো হয়। শিশু ভবন ইসলামপুর থেকে চূড়ান্তভাবে দত্তক দেওয়ার জন্য ১৯৭৬ সালের ১ জুলাই আশাকে টেরি ডেস হোমসে পাঠানো হয়।
পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করার প্রসঙ্গে আশা বলেন, “অবৈধ দত্তকের বিষয়ে আমি অনেক কথা শুনেছি। এজন্য আমি জানতে চাই- আমাকে বাবা-মা ইচ্ছাকৃত দত্তক দিয়েছিলেন, নাকি আমি পাচারের শিকার। নিজের পরিবারের সন্ধান পেতে বেশ কয়েক বছর ধরে আমি চেষ্টা করছি। নেদারল্যান্ডের ‘শাপলা কমিউনিটি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমার ডিএনএ টেস্ট করিয়ে ‘ফ্যামিলি ট্রি’ তৈরি করিয়েছি, যাতে পরিস্কার হয়েছে আমার উৎস বাংলাদেশেই।”
ডেনমার্কে স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে কাজ করেন আশা। অক্ষম মানুষদের দেখাশোনা করাই তার কাজ। দুই সন্তানের মধ্যে ছেলের বয়স ২০ বছর, মেয়ের বয়স ১৭। তবুও নিজের পরিবার খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশায় আশা ঢাকা আসবেন ৯ মার্চ, আর খুলনায় যাবেন ১৩ মার্চ।
আশার ভাষ্যমতে, তার জন্ম খুলনায়, সম্ভবত ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাসে। সেই হিসাবে তার বর্তমান বয়স প্রায় ৫০ বছর। কেউ একজন তার নাম রেখেছিলেন আশা। লোকমুখে শুনেছেন, ১৯৭৪ বা ৭৫ সালের মে মাসে তাকে সোনাডাঙ্গা মেইন রোডের এক এতিমখানায় রেখে আসা হয়। সেখান থেকে তাকে ঢাকার ইসলামপুর রোডের আমপট্টি এলাকার এক এতিমখানায় নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে আশাকে দত্তক নেয় ডেনমার্কের পরিবারটি। ১৯৭৬ সালের ১৮ অক্টোবর ওই পরিবারের সঙ্গে ডেনমার্কে চলে যান তিনি। সেই থেকে আশা ওয়েলস নামে ডেনমার্কেই বাস করছেন।
বাবা-মার খোঁজে ডেনমার্ক থেকে আসছেন আশা
পুলিশের তদন্ত
১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে যেসব শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়, তাদের অনেকে পাচারের শিকার বলে যে অভিযোগ রয়েছে সে বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ পুলিশের ডিপ্লোম্যাটিক অ্যান্ড প্রোটোকল উইং অব দ্য স্পেশাল ব্রাঞ্চ। কয়েক মাস আগে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নথি পাঠানো হয়।
এসব বিষয়ে বাহিনীটির স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট তাহসিন মাসরুফ হোসেন মাসফি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরাও এরকম একটি অভিযোগ তদন্ত করছি। ঘটনাটি অনেক পুরনো। প্রায় ৫০ বছর আগের। এত পুরনো জিনিস নতুন করে খুঁড়ে বের করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তারপরও আমরা চেষ্টা করব, যাতে তদন্ত কাজটা ভালোভাবে করা যায়। আইনের মধ্যে থেকে এই ঘটনার একটি ভালো ফলাফল আনার জন্য আমাদের সবরকম চেষ্টা থাকবে।”
তদন্তের স্বার্থে সব তথ্য এখন প্রকাশ করার সুযোগ নেই উল্লেখ করে মাসরুফ হোসেন বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় তাদের বিদেশে নেওয়া হয়েছিল, এখানে একটা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা আছে। সেটিই আমরা খতিয়ে দেখছি। তদন্ত কাজ শেষ হলে আমরা আরও বিস্তারিত বলতে পারব।”
তদন্তের স্বার্থে আশার সঙ্গেও কথা বলবেন বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।