Beta
বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৪

থানার সামনে ভ্যানে স্তূপীকৃত লাশ দিচ্ছে গুমের অভিযোগের ভিত্তি

ভিডিওতে এভাবে একটি ভ্যানে লাশ তুলতে দেখা যায়।
ভিডিওতে এভাবে একটি ভ্যানে লাশ তুলতে দেখা যায়।
Picture of আঞ্চলিক প্রতিবেদক, সাভার

আঞ্চলিক প্রতিবেদক, সাভার

একটি ভ্যানে স্তূপ রাখা কয়েকটি লাশ, সড়কে পড়ে থাকা আরও একটি লাশ তুলছে দুই পুলিশ সদস্য। এমন একটি ভিডিও ফেইসবুকে আসার পর সাম্প্রতিক আন্দোলনে লাশ গুমের অভিযোগ বড় ভিত্তি পাচ্ছে।

ভিডিওতে দেখা যাওয়া দেয়াল ও সেখানে লাগানো পোস্টার বোঝাচ্ছে, স্থানটি ঢাকার সাভারের আশুলিয়া থানা ফটকের কাছে।

ভিডিওটি দেখার পর শনিবার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে স্থানটি নিশ্চিত হওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, আশুলিয়া থানার বিপরীত পাশের ভবন থেকে কেউ মোবাইল ফোনে ভিডিওটি ধারণ করেছে। তবে কে ভিডিওটি ধারণ করেছে, কেইবা সোশাল মিডিয়ায় তা এখন দিল, তার হদিস মেলেনি।

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে সরকার কঠোর হওয়ার পর নিহতের সংখ্যা জুলাই মাসের ১৬ তারিখ থেকে বাড়তে থাকে। পরবর্তী কয়েকদিনে কয়েকশ মানুষ নিহত হয়।

এরপর প্রবল বিক্ষোভে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সেদিন জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করলে অনেক হতাহত হয়।

তার চার সপ্তাহ পর ফেইসবুকে ভাইরাল হওয়া ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যায়, দুজন পুলিশ সদস্যের একজন হাত ও একজন পা ধরে ভ্যানে লাশ তুলছে। সেই ভ্যানে আগেই তোলা লাশের স্তুপ করে কাপড় দিয়ে ঢাকা। সর্বশেষ লাশটি তুলে একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।

ভিডিওটির শেষের দিকে পুলিশ সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। সেখানে ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) ইনচার্জ (তদন্ত) আরাফাত হোসেনকে চিহ্নিত করা গেছে।

মাঝে ভিডিওটির ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে দেয়ালে স্থানীয় যুবলীগের ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী আবুল হোসেনের একটি পোস্টার দেখা যায়।

ভিডিওটি দেখে বোঝা যাচ্ছে, আশুলিয়া প্রেসক্লাবের পেছনের সড়ক ও নবীনগর চন্দ্রা মহাসড়কের থানা রোড দিয়ে থানার সামনের স্থান এটি।

এসবি অফিসের দিকে যাওয়ার সময় ডান পাশের দেয়ালে যুবলীগ নেতার ছবি সম্বলিত পোস্টারটি এখনও রয়েছে। থানা থেকে মহাসড়কের দিকে যেতে বাম পাশের দেয়ালের অবয়ব ভিডিওটির সঙ্গে মিলে যায়।

এছাড়া ভিডিওটিতে দেখা বালুর বস্তাগুলো এখন না থাকলেও ৬ আগস্ট সকাল পর্যন্ত ছিল বলে স্থানীয়রা জানায়।

সেখানে গিয়ে ধারণা করা যায়, থানার সামনের বাচ্চু মিয়ার মালিকানাধীন দ্বিতল বাড়ির কোনও একটি কক্ষের জানলা থেকে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে। তবে ওই বাড়ির একাধিক ভাড়াটিয়ার কাছে জিজ্ঞাসা করেও জানা যায়নি, কে ভিডিওটি ধারণ করেছিল।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি ও একটি মামলার বাদীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা থানায় হামলা করতে গেলে পুলিশ সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছিল।

সেদিন কয়েকজন আন্দোলনকারী মারা গেলেও খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদের। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে একটি পিকআপভ্যানে পুড়ে যাওয়া কয়েকজনের লাশ মিলেছিল। প্রায় পুরোটা পুড়ে যাওয়ায় কারও কারও লাশ শনাক্ত করা যায়নি। পুড়ে যাওয়া লাশগুলোর হাতে হ্যান্ডকাফও ছিল।

ভিডিওটি দেখার পর এখন স্থানীয়দের ধারণা, সেদিন লাশগুলো পুড়িয়ে দিতে পুলিশ ভ্যানে তুলেছিল।

সেই ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেন রাহেন জান্নাত ফেরদৌস। গত ৫ আগস্ট নিখোঁজ হয়েছিলেন তার ছেলে আস-সাবুর। পরদিন পুড়ে যাওয়া লাশের পকেটে থাকা মোবাইল সিমের সূত্র ধরে তার ছেলের পরিচয় নিশ্চিত হন তিনি।

ফেরদৌস বলেন, “আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যার পর গুম করার উদ্দেশ্যে পুলিশ সদস্যরা পুড়িয়ে ফেলে। যখন ছেলের লাশ আনতে যাই, তখন আরও কয়েকজনের পুড়ে যাওয়া লাশ দেখতে পেয়েছিলাম। যাদের চেহারা চেনার কোনও উপায় ছিল না।”

পুড়ে যাওয়া লাশের পাশে থাকা আইডি কার্ড দেখে শনাক্ত করা হয় সাজ্জাদ হোসেন সজলকে। তার মা শাহিন বেগম বলেন, ৬ আগস্ট সাজ্জাদের লাশ শনাক্ত করতে গিয়ে আরও ৬ থেকে ৭টি লাশ পড়ে থাকতে দেখেছলেন তিনি।

সেদিন নিহত তানজিল মাহমুদ সুজয়ের লাশ তার মামা মাজেদুল এবং বাইজিদির লাশ তার স্ত্রী রিনা আক্তার লাশ সনাক্ত করেন। তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এরা সবাই ৫ আগস্ট বিকাল থেকে সন্ধ্যায় নিখোঁজ হন। পরদিন লাশ পাওয়া যায়।

স্থানীয় এক দোকানি বলেন, গত ৫ আগস্ট সকাল থেকেই নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় জড়ো হতে থাকে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা। শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর আসার পর তারা থানার চারপাশ ঘিরে ফেলে। এসময় কিছু পুলিশ সদস্য আত্মসমর্পণ করে। এরপর আন্দোলনকারী থানার দিকে এগোলে পুলিশ গুলি চালাতে থাকে।

প্রাণ বাঁচাতে সেদিন ওই সময় দোকান বন্ধ করে চলে এসেছিলেন এই দোকানি; এরপরের ঘটনা তিনি আর দেখেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “ঘটনার দিন বিকাল ৪টার দিকে থানায় হামলার চেষ্টা করে আন্দোলনকারীরা। তখন পুলিশ ব্যাপক গুলি চালায়।”

আশুলিয়া থানার বিপরীতে পাশের বাড়ির মালিক রাশিদা বেগম বলেন, “দুপুর ৩টা ২০ মিনিটে গুলির শব্দ শুরু হয়। এখানে অনেক মানুষ এসেছিল। মানুষ মরে পড়ে থাকতে দেখছি। তবে কখন গোলাগুলি শেষ হয়েছে, বলতে পারব না।”

থানা ফটকের পাশে থাকা বাইপাইল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মোফাজ্জল হোসেন বলেন, সেদিন গোলাগুলি চলায় দুপুরের পর থেকে মসজিদে যেতে পারেননি তিনি। তবে রাতে এশার নামাজ পড়িয়েছিলেন। সকালে আগুনে পোড়া ছয়জনের জানাজা পড়ানো হয়েছিল।

এই লাশগুলোর বিষয়ে জানতে আশুলিয়া থানার একাধিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কেউ মুখ খুলতে চাননি।

ভিডিওতে দেখা যাওয়া ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আরাফাত হোসেনকেও পাওয়া যায়নি।

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি ভিডিওটি দেখেছেন।

“এটি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আপনারা যেহেতু মিডিয়ায় কাজ করেন, কোনও তথ্য কিংবা সূত্র পেলে আমাদের সহযোগিতা করার অনুরোধ করছি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত