ঢাকার বংশালের মিরনজুল্লাহ হরিজন কলোনি উচ্ছেদে ছিল এক মাসের স্থিতাবস্থা। নতুন করে উচ্ছেদ উদ্যোগের বিরুদ্ধে করা আবেদনের শুনানি নিয়ে বুধবার এই অভিযানের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আদালত বলেছে, এ নিয়ে শুনানি হবে বৃহস্পতিবার।
তবে এর আগেই এদিন দুপুরে কলোনিটির হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা হয়েছে। যারা এই হামলা চালিয়েছে তারা স্থানীয় কাউন্সিল আউয়াল হোসেনের লোকজন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কলোনিতে হামলা
বুধবার দুপুর ১২টার দিকে মিরনজুল্লাহ কলোনির ৬০ জন হরিজন ও ৬ জন মুসলিম পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে ঘর বুঝিয়ে দিতে এসেছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান। তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলার আউয়াল হোসেন ও তার লোকজন।
কিন্তু এসব বাসা নিতে রাজি ছিলেন না হরিজন কলোনির লোকজন। তারা বাধা দিলে তাদের ওপর দিয়ে হামলা চালানো হয়। এরপর হরিজনরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে কলোনি থেকে কাউন্সিলার ও তার লোকজন বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপরও বেশ কিছুক্ষণ পাল্টা-পাল্টি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলে। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।
এ হামলায় আহত অর্ধশতাধিক লোককে পুলিশ পাহারা দিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়।
আহত হরিজনদের অভিযোগ, তাদের ওপর হামলা চালায় কাউন্সিলার আউয়াল হোসেনের লোকজন। তারা কলোনির ভিতরে মন্দিরও ভাঙচুর করে।
এই হামলার সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা হরিজনদের সহযোগিতায় নিরাপদে একটি বাসার মধ্যে আশ্রয় নেন। আর হরিজনরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে কলোনি থেকে কাউন্সিলার ও তার লোকজন বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে এরপরও বেশ কিছুক্ষণ পাল্টা-পাল্টি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলে।
পরবর্তী সময়ে বংশাল থানা থেকে পুলিশ এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। সেসময় ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানকে নিরাপদে পুলিশ প্রহরায় বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বের হয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের উদ্দেশে বলেন, “এখানে কী হয়েছে আমি দেখেছি। এখানকার লোকজন আমার স্টাফ। তাদের নিরাপত্তা আগে, তারপর সব।”
তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর বংশাল থানার ওসি মাইনুল ইসলাম কলোনি পরিদর্শন করেন। তিনি মন্দির পরিদর্শন করে স্থানীয়দের উদ্দেশে বলেন, “আজকের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত। আমাদের ফোর্স পাঠাতে বলা হয়নি। বললে আমরা আসতাম। তাতে এই ঘটনা ঘটত না। আমরা কমিউনিটির নেতাদের সাথে বসব, এই পুরো ঘটনা তদন্ত হবে। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এই হামলার ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন হরিজন পক্ষের হাইকোর্টে রিটকারী আইনজীবী আইনুননাহার সিদ্দিকা লিপি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখানে কী ঘটেছে তা আপনারা দেখেছেন। সিটি করপোরেশনের আজকে যে কর্মসূচি নিয়ে এখানে এসেছে তা অবৈধ। এরই মধ্যে আমরা হাইকোর্টে এপ্লিকেশন করেছি। আজই (বুধবার) শুনানি হবে। যারা আজকে এই হামলা করেছে কাউন্সিলারসহ তাদের বিরুদ্ধে আমি আইনি লড়াই লড়ব।”
কেন ডিএসসিসির ঘরে উঠবে না হরিজনরা
সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ দেওয়া ঘর উঠতে চান না কলোনির হরিজনরা। তারা বলছেন, ২০১৭ সালে যাদের বাড়ি ভেঙ্গে নতুন ঘর পাওয়ার কথা ছিল, তারা এখনও পাননি। আর কিছুদিন আগে যে উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের কোনও উদ্যোগ নেই।
কলোনির লোকজনের আশঙ্কা, এই ঘরগুলো বুঝিয়ে দিয়ে তা কোর্টকে দেখিয়ে পুনরায় উচ্ছেদ চালাবে সিটি করপোরেশন।
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০১৭ সালে ৫ তলা একটা পুরানো বিল্ডিং ভেঙে ফেলেছিল। সেখানে ৫০ পরিবার ছিল। ওই ৫০ পরিবারের কয়েকজনকে রাস্তায় টিনশেড বানিয়ে দেয়। বাকিরা বিল্ডিংয়ের ছাদে টিনশেডের বাসা বানিয়ে থাকছে। এদের মধ্যে এত বছর পর ১৬-১৭ জনকে বাসা দিচ্ছে।
“আর বাকিগুলো তো মানুষ অনেক সময় দরখাস্ত করছে, তাদের দিচ্ছে। এদের মধ্যে শুধু সাচিবিক নিয়োগ যাদের তাদের দিচ্ছে।”
“এখন এটি দেখিয়ে কোর্ট থেকে আবার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আসতে পারে। তাই আমরা চাই সবার এক সাথে পুনর্বাসন হবে। তার আগে উচ্ছেদ করা যাবে না,” যোগ করেন কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ।
উচ্ছেদে স্থিতাবস্থা, বৃহস্পতিবার শুনানি
এক মাসের স্থিতাবস্থার পর নতুন করে মিরনজুল্লাহ কলোনিতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার ওপর বুধবার (১০ জুলাই) স্থিতাবস্থা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
ডিএসসিসি নতুন করে অভিযান পরিচালনার উদ্যোগের বিরুদ্ধে করা আবেদনের শুনানি নিয়ে এদিন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ আদেশ দেয়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অনীক আর হক ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী উৎপল বিশ্বাস।
আদেশের পর অনীক আর হক বলেন, বংশালের মিরনজুল্লাহ হরিজন কলোনিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। এজন্য হরিজন কলোনিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ মোতায়েন করতে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সিটি করপোরেশন চিঠি দেয়। পাশাপাশি স্থানীয় কাউন্সিলকে এ বিষয়ে সহায়তা করতে বলা হয়।
এরপর মঙ্গলবার হরিজন কলোনিতে আবার অভিযান শুরুর উদ্যোগ নিলে সেখানে বসবাসরত হরিজনদের পক্ষে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয় বলে জানান আইনজীবী অনীক আর হক।
তিনি বলেন, “শুনানি শেষে আপিল বিভাগ সিটি করপোরেশনের অভিযানের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। একই সঙ্গে আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন।”
মিরনজুল্লাহ হরিজন কলোনিতে উচ্ছেদ অভিযানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ১৩ জুন উচ্ছেদ অভিযানের ওপর এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেছিল হাইকোর্ট। পাশাপাশি বসবাসের বিকল্প ব্যবস্থা না করে হরিজনদের উচ্ছেদ না করতে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষকে এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।