Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

পর্যটকদের ওপর হামলা, কাশ্মীরের অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা

kashmir
[publishpress_authors_box]

দক্ষিণ কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর জম্মু ও কাশ্মীরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পর্যটকরা দ্রুত ওই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আর যাদের নিকট ভবিষ্যতে ভ্রমণের পরিকল্পনা ছিল, তাদের অনেকেই ভ্রমণের টিকেট বাতিল করতে শুরু করেছেন।

মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দক্ষিণ কাশ্মীরের প্রধান পর্যটনস্থল পহেলগামের একটি রিসোর্টে কমপক্ষে চারজন সন্ত্রাসী দর্শনার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। নিহতদের অধিকাংশই পর্যটক। তাদের মধ্যে দুইজন বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। 

এই সন্ত্রাসী হামলা গোটা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। আর এই নৃশংস ঘটনার কারণে জম্মু ও কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বুকিং বাতিলের হিড়িক

জম্মু ও কাশ্মীরে ভ্রমণের ইচ্ছা ছিল এমন অনেকেই পহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার পর তাদের পরিকল্পনা বাতিল করছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, হামলাটি ঘটেছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির পর্যটন মৌসুমের একেবারে চূড়ান্ত সময়ে। 

পর্যটকরা এখন তাদের ট্রাভেল এজেন্টদের ফোন করে হোটেল ও ফ্লাইটের বুকিং বাতিল করছেন।

কন্নত প্লেসের স্কাইলিংক প্রাইভেট লিমিটেডের অপারেটর আশীষ শর্মা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, আগামী ১০ দিনের সব ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, “এই সময়ে বছরের বেশিরভাগ বুকিং আসে উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য, গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে। এমন হামলা ঘটার পর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই ফোন করে তাদের হোটেল ও অন্যান্য বুকিং বাতিল করেছে।”

আশীষ শর্মা আরও বলেন, “যারা সড়কপথে ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, তারা সবাই ট্রিপ বাতিল করেছেন। যারা বিমানে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন, তারা টিকেট বাতিল করতে ফোন করেছেন। বাকিরা অনলাইনে বাতিল করার চেষ্টা করছেন।”

মানিকন্ট্রোলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাভেল এজেন্ট ও লে ট্রাভেল ওয়ার্ল্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সঞ্জয় দাং বলেন, “যারা কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, তারা তা স্থগিত করছেন। আর যারা ইতোমধ্যে ফ্লাইট টিকেট ও হোটেল বুকিং করেছেন, তারা পুনর্বিবেচনা করছেন।”

তিনি বলেন, “এটি কাশ্মীরে পর্যটনের চূড়ান্ত সময়। এই সময়েই মানুষ ভ্রমণের জন্য বুকিং করে। কাশ্মীরে একসময় সন্ত্রাসের সমস্যা ছিল, এটা মানুষ ভুলে গিয়েছিল। পরিস্থিতিও অনেক উন্নত হয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে কাশ্মীরে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল।

“গত বছর এপ্রিল-জুলাই মাস কাশ্মীরের জন্য ভালো সময় ছিল। গত বছরের এই সময়ে হোটেল রুম বুক করা চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ পর্যটকের ভিড় ছিল অনেক বেশি। শ্রীনগরে অনেক নতুন হোটেল খুলেছে। আরও হোটেল ও অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এমন ঘটনার কারণে যাদের বিকল্প আছে, তারা তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করবে।”

শিল্প সংশ্লিষ্টরা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, পহেলগামের এই সন্ত্রাসী হামলার কারণে জম্মু ও কাশ্মীরের পর্যটন খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।

কাশ্মীর ট্রাভেল এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রউফ ট্রাম্বু এই হামলাকে ‘বড় ধাক্কা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন, গত কয়েক বছরে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে পর্যটন খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল।

রউফ ট্রাম্বু বলেন, “ইতোমধ্যেই আমরা ব্যবসায়িক অংশীদার ও ভোক্তাদের কাছ থেকে বুকিং বাতিলের অনুরোধ পাচ্ছি।”

ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘটনার প্রভাব সমগ্র উপত্যকায় পড়বে। সেখানকার পর্যটননির্ভর স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকাকে প্রভাবিত করবে। এই সন্ত্রাসী হামলা আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যাকেও প্রভাবিত করতে পারে।

সঞ্জয় দাং মানিকন্ট্রোলকে বলেন, “বছরের এই সময়ে মূলত দেশীয় পর্যটকরা কাশ্মীর ভ্রমণ করে থাকেন। বিদেশি পর্যটকরা সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে কাশ্মীর আসেন। কিন্তু এমন ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলে তা বিশ্বজুড়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আগামী দিনগুলোতে আরও বুকিং বাতিল হতে পারে। এই হামলা সরাসরি পর্যটকদের লক্ষ্য করে করা হয়েছে।”

ট্যুর অপারেটররা পূর্বাভাস দিয়েছেন, এই ঘটনায় বছর জুড়ে পর্যটন খাত প্রভাবিত হবে।

মালবিয়া নগরে অবস্থিত একটি কাশ্মীর-বিশেষায়িত ট্রাভেল এজেন্সির এক কর্মকর্তা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, “আমাদের আগামীকাল সকালে শ্রীনগর, গুলমার্গ, সোনমার্গ ও পহেলগামে নয়জনের ট্যুর ছিল। হামলার খবর পাওয়ার পরই তারা ট্রিপ বাতিল করে দিয়েছে। জুন মাস পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে বুকিং করা লোকেরা ফোন করছে।”

তিনি আরও বলেন, “মে ও জুনের প্রথম সপ্তাহ আমাদের ব্যস্ততম সময়। গত চার বছরে কাশ্মীরে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি আমরা দিনে ৪০ জন পর্যটককে হ্যান্ডল করতাম। এখন ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আমার মনে হয় না, এই বছর আমাদের হাতেগোনা কয়েকজন পর্যটক থাকবে।”

শিল্প সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করতে পারছেন না, এর আগে সন্ত্রাসীরা কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের পর্যটকদের খোলাখুলিভাবে আক্রমণ করেছিল কি না। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অপারেটরসের নাসির শাহ বলেন, “আমরা বুকিং বাতিলের জন্য প্রচুর কল পাচ্ছি।”

পর্যটকদের জম্মু-কাশ্মীর ত্যাগে তাড়াহুড়ো

পহেলগামে হামলার ঘটনায় বিপুল সংখ্যক পর্যটক জম্মু ও কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

কয়েকটি ভারতীয় এয়ারলাইন্স কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে মানুষদের ফিরিয়ে আনতে অতিরিক্ত ফ্লাইট চালু করেছে। এয়ার ইন্ডিয়া বুধবার একটি ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি জারি করে জানিয়েছে, তারা শ্রীনগর থেকে দিল্লি ও মুম্বাইয়ের জন্য দুটি অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করবে।

সংস্থাটি সোশাল মিডিয়া এক্সে জানায়, “শ্রীনগর থেকে আমাদের অন্যান্য সব ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে পরিচালিত হবে। এয়ার ইন্ডিয়া ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই সেক্টরে কনফার্মড বুকিংধারী যাত্রীদের জন্য সম্পূর্ণ রিফান্ডের সুবিধা দিচ্ছে।”

এয়ার ইন্ডিয়া প্রতিদিন দিল্লি ও মুম্বাই থেকে শ্রীনগরে পাঁচটি ফ্লাইট পরিচালনা করে। ইন্ডিগোও শ্রীনগর থেকে দিল্লি ও মুম্বাইয়ের জন্য দুটি অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করবে বলে একজন এয়ারলাইন্স কর্মকর্তা পিটিআইকে জানিয়েছেন। 

টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলার পর জম্মু-কাশ্মীরে আটকেপড়া মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের পর্যটকরা দ্রুত ফিরে যেতে চাইছেন।

পুনের আইনজীবী বিজয়সিংহ তোম্বারে বলেন, “রাস্তাগুলো এখন ফাঁকা। সবখানে সেনা মোতায়েন আছে। আমরা নিরাপদে আছি। কিন্তু অন্যরা আর একদিনও থাকতে চাইছে না। সবাই কীভাবে ফেরার ফ্লাইট পাবে, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।”

জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ উপত্যকা থেকে পর্যটকদের চলে যাওয়া দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি বলেন, “মানুষ কেন চলে যেতে চাইছে তা আমরা বুঝতে পারি।”

এক্স পোস্টে তিনি জানান, শ্রীনগর ও জম্মুর মধ্যে এনএইচ-৪৪ একমুখী ট্রাফিকের জন্য পুনরায় চালু করা হয়েছে।

সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যটনমন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত বলেছেন, তার মন্ত্রণালয় জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটন খাতে এই আঘাত কমিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটন

গত কয়েক বছরে জম্মু ও কাশ্মীরে পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত মাসে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ জানিয়েছিলেন, ২০২৪ সালে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২ কোটি ৩০ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেছেন।

গত জুলাই মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (এমএইচএ) রাজ্যসভায় জানায়, ২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর এই অঞ্চলে পর্যটন অভূতপূর্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। 

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীরে ১ কোটি ৮ লাখ পর্যটক এসেছেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ কোটি ১১ লাখ, যা সে সময়ের সর্বোচ্চ। 

২০২২ সালে এই অঞ্চলে ১ কোটি ৮০ লাখ, ২০২১ সালে ১ কোটি ১৩ লাখ এবং ২০২০ সালে ৩৪ লাখ ৭০ হাজার ৮৩৪ জন পর্যটক ভ্রমণ করেছিলেন।

নিত্যানন্দ রাই গত বছর রাজ্যসভায় বলেন, “গত তিন বছরে পর্যটন খাতে বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ১৩ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে।”

৩৭০ ধারা বাতিলের আগে ২০১৮ সালে জম্মু-কাশ্মীরে ১ কোটি ৬০ লাখ পর্যটক এসেছিলেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এদের মধ্যে ৮ লাখ ৩০ হাজার পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলেন। 

কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটনকে উৎসাহিত করে চলেছে। এটিকে এই অঞ্চলে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফিরে আসার লক্ষণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সরকার কাশ্মীরকে বৈশ্বিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই উদ্দেশ্যে গত কয়েক বছরে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পর্যটন উন্নয়নের জন্য নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে। 

এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে কাশ্মীরে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনকে উৎসাহিত করা এবং জম্মু-কাশ্মীরে চলচ্চিত্র শুটিংকে প্রমোট করা। ২০২৩ সালের মে মাসে শ্রীনগরে তৃতীয় জি২০ ট্যুরিজম ওয়ার্কিং গ্রুপ মিটিং হয়েছিল। এতে কমপক্ষে ৬০ জন বিদেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। 

লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা পূর্বে পর্যটন সংখ্যা বৃদ্ধিকে শান্তির “প্রধান সূচক” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, “জম্মু-কাশ্মীরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পর্যটনই একমাত্র মাধ্যম।” 

তৃতীয় প্রজন্মের শিকারা (এক ধরনের কাঠের নৌকা) চালক শাবির আহমেদ ২০২৪ সালে সিএনবিসি টিভি১৮কে বলেছিলেন, গত তিন বছর তার ব্যবসার জন্য ভালো গেছে। তিনি বলেন, “পর্যটন ভালো থাকায় আয়ও ভালো হয়েছে। এই বছর কায়াকিং ও কার রেসিংয়ের মতো বিভিন্ন উৎসবের কারণে পর্যটন বৃদ্ধি পেয়েছে।” 

এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পহেলগামের সন্ত্রাসী হামলা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ভয় বাড়িয়ে দিতে পারে। পর্যটন কমে গেলে তাদের জীবিকার উপায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত