বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় টানা ৭০ মিনিট ছিলেন বাবর আলী। এই সময় খুব কাছ থেকে দেখেছেন আকাশের বিশালত্ব। অনুভব করেছেন শুভ্র পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য। হিমশীতল আবহাওয়ায় উপভোগ করেছেন তুষারপাত।
বুধবার এভাবেই দুঃসাহসী অভিযানের গল্পের ডালি বাবর মেলে ধরেন চট্টগ্রামের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে। তার ভাষায়, “এভারেস্ট চূড়া থেকে দেখা নিসর্গ এ জীবনে ভোলা সম্ভব নয়।”
এক অভিযানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট এবং পাশে থাকা চতুর্থ উঁচু পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট লোৎসে জয়ের রেকর্ড নিয়ে মঙ্গলবার রাতে জন্মভূমি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় ফেরেন পর্বতারোহী ও চিকিৎসক বাবর।
অভিযানের অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পরদিন হাজির হন মিলনায়তনে। বলেন, “এভারেস্ট শীর্ষে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট অবস্থান করেছি। নেমে আসার সময় এক আহত পর্বতারোহীর জন্য দেড় ঘণ্টা আটকে ছিলাম। তখন সেই উন্মুক্ত এলাকায় শুরু হয় তুষারঝড়। সৌভাগ্যক্রমে বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাই।”
এভারেস্ট-লোৎসে অভিযানে চারপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য যেমন বাবরকে মুগ্ধ করেছে, তেমনি পর্বতশৃঙ্গে ওঠার সময় ও নামার সময় বরফের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে থাকা মানুষের মরদেহ তাকে বেদনাহত করেছে।
তিনি বলেন, “মৃত ব্যক্তিরা এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চেয়েছিলেন, পারেননি। অনেক মরদেহের অবস্থা বা তাদের হাতে থাকা সরঞ্জাম দেখে মনে হয়েছে, খুব বেশিদিন আগে তাদের মৃত্যু হয়নি। মরদেহগুলো আমাকে বিচলিত করে। তবে আমি মনোবল হারাইনি।”
এভারেস্টের চারদিকে গাছপালা সম্পর্কে বাবর বলেন, “এভারেস্টে ওঠার সময় দুই হাজার মিটার উচুঁতে গিয়ে দেখেছি, এক একটি গাছ ঝোপালো হয়ে গেছে। আবার এও দেখেছি, গাছ ছোট কিন্তু তাদের শেকড় অনেক মোটা এবং অনেক গভীরে।”
এভারেস্টের উচ্চতা বেশি হলেও পাশে থাকা লোৎসে চূড়ায় আরোহন তুলনামূলক কঠিন বলে মনে হয়েছে বাবরের।
“তবে ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে সুস্থভাবে ফিরে এসেছি এটিই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এই অভিযানে আমার ওজন কমেছে চার কেজির মতো,” বলেন তিনি।
১৯ মে এভারেস্ট জয়ের পর বাবর সেদিনই ক্যাম্প-৪-এ নেমে আসেন। ওই রাতে তার মাউন্ট লোৎসেতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ১৬ ঘণ্টা আরোহণে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি।
বাবরের গাইড তখন তাকে বিশ্রামের পরামর্শ দেন। পরদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাবর লোৎসে আরোহণ শুরু করেন এবং ভোর ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে চূড়ায় পৌঁছে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান।
মাউন্ট এভারেস্টে ওঠার সময় বেশ কিছু ক্যাম্প আছে। এর মধ্যে ক্যাম্প-৪ এর অবস্থান হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬ হাজার ফুট উচ্চতায়।
এই ক্যাম্পের স্থানকে ‘ডেড জোন’ বলা হয়। এই ক্যাম্প থেকে ওপরের দিকে উঠতে বাড়তি কৃত্রিম অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। এজন্য পর্বতারোহীরা অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করেন।
এই ‘ডেড জোনে’ একটি এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছেন বাবর। তিনি চেষ্টা করেন, যতটা সম্ভব কম কৃত্রিম অক্সিজেন ব্যবহার করতে।
ক্যাম্প ৪ এ তাই অক্সিজেন ছাড়াই ছিলেন বাবর। এভারেস্টের চূড়ায় উঠেও প্রায় পুরোটা সময় অক্সিজেন মাস্ক না পরেই থেকেছেন তিনি।
এই এক্সপেরিমেন্টের বিষয়ে বাবর বলেন, “অনেকে অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট অভিযানে নামেন। এটা কতটা কঠিন, তা বোঝার চেষ্টা করেছি।”
বাবরের স্বপ্ন, আগামীতে কৃত্রিম অক্সিজেনের সহায়তা ছাড়াই এভারেস্ট, লোৎসের মতো সাড়ে আট হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করবেন।
এভারেস্ট আরোহণের ক্ষেত্রে আবহাওয়া বড় ফ্যাক্টর উল্লেখ করে বাবর বলেন, “বাংলাদেশের একজন আবহাওয়াবিদ এ বিষয়ে আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন।”
এভারেস্ট-লোৎসে অভিযান সফল হওয়ার জন্য বাবর কৃতজ্ঞতা জানান নিজের পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সসহ পৃষ্ঠপোষক সংগঠন এবং ক্রাউড ফান্ডিয়ে অংশ নেওয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের।
এই অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান অভিযানের পেছনের গল্প সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরে বলেন, “পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা পেলে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের পর্বতারোহীরা আরও অনেক দুর্দান্ত কাজ করতে পারবে।”
বাবর আলীর অনন্য জয় উদযাপনে রবিবার বিকাল ৫ টায় চট্টগ্রামে শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।
এভারেস্ট ও লোৎসে অভিযানের জন্য ১ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে নেপালে যান বাবর। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষে ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে যান লুকলায়। আর এভারেস্টের বেসক্যাম্পে পৌঁছান ১০ এপ্রিল।
এরপর উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এবং নিজেকে প্রস্তুত করতে অনেকটা সময় নেন বাবর।
১৪ মে মাঝরাতে বেসক্যাম্প থেকে শীর্ষ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন বাবর। ১৫ মে সকালে পৌঁছে যান ক্যাম্প ২-এ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে দু’রাত কাটিয়ে বাবর উঠে যান ক্যাম্প ৩-এ। সেখান থেকে ১৮ মে পৌঁছান ক্যাম্প ৪-এ।
১৮ মে মাঝরাতে শুরু হয় বাবরের এভারেস্ট চূড়া অভিমুখী যাত্রা। ১৯ মে ভোরে ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা। এর মধ্য দিয়ে ৬ষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন বাবর।
এরপর বাবর নেমে আসেন ক্যাম্প ৪-এ। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে ২০ মে মধ্যরাতে লোৎসে চূড়ার উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেন। ২১ মে সকালে পৌঁছান সেখানে।