Beta
বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

দুর্গম গিরি যেভাবে ধরা দিল বাবর আলীর কাছে

রবিবার সকালে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান বাবর আলী।
রবিবার সকালে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান বাবর আলী।
[publishpress_authors_box]

হেঁটে বেরিয়েছেন বাংলাদেশের ৬৪ জেলা, ভারতের কাশ্মীর থেকে কন্যা কুমারি পাড়ি দিয়েছেন সাইকেলে। এরপর পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানটিতে পদচিহ্ন এঁকে দিলেন বাবর আলী।

ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসাবে রবিবার সকালে সফলভাবে হিমালয়ে এভারেস্টের চূড়ায় লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন তিনি।

‘পেশায় ডাক্তার, নেশায় পাহাড়ি’ বাবরের আগে চার বাংলাদেশি হিমালয় চূড়ায় ওঠার কৃতিত্ব দেখান। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বিন্দু স্পর্শ করেছিলেন মুসা ইব্রাহীম।

এরপর টানা তিন বছর অর্থাৎ ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল এভারেস্ট অভিযানে সফল হন এম এ মুহিত, নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরীন। এর বাইরে ২০১৩ সালে এভারেস্ট জয় করেছিলেন আরেক বাংলাদেশি সজল খালেদ। তবে চূড়া থেকে নামার সময় অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি।

৩৩ বছর বয়সী বাবর আলীর সঙ্গে ওই পাঁচ পর্বতারোহীর পার্থক্য আছে। বাবর আলী কেবল বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গই নয়, একই সঙ্গে চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট লোৎসেও জয় করতে চান এবং তা এক অভিযানেই।

বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম কোনও পর্বতারোহী এক অভিযানে মাউন্ট এভারেস্ট আর লোৎসে আরোহণের চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন।

এজন্য গত ১৪ বছর ধরে নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ছেলে বাবর আলী। এভারেস্ট অভিযানের আগে অনেক অভিযান সফলভাবে পরিচালনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে নেপালের আমা দাবলাম পর্বত।

গত এপ্রিলে এবারের অভিযান শুরুর আগে বাবর আলী বলেছিলেন, এভারেস্ট-লোৎসে অভিযানে তার সময় লাগবে প্রায় দুই মাস।

নেপালের স্নোয়ি হরাইজন নামের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অভিযানে বাবরের সঙ্গে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু, পর্বতারোহণের গাইড বীর বাহাদুর তামাং।

বাবর আলীর অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এভারেস্ট জয়ের পর অবশ্যই বাবর আলীর মনোবল আরও বেড়ে যাবে। ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষ চূড়া থেকে তিনি রবিবারই ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৪ এ নেমে আসবেন।

“সেখান থেকেই লোৎসে জয়ের যাত্রা শুরু করবেন। সব অনুকূল থাকলে সোমবার ভোরেই লোৎসে চূড়ায় পৌঁছবেন বাবর আলী।”

ফরহান বলেন, “এর আগে কোনও বাংলাদেশি লোৎসে চূড়ায় আরোহণ করেননি। আবার কোনও বাংলাদেশি একই অভিযানে মাউন্ট এভারেস্ট এবং লোৎসে চূড়ায় চড়েননি। ফলে লক্ষ্য অর্জিত হলে তিনিই হবেন প্রথম বংলাদেশি।”

চট্টগ্রামের পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে  বলা হয়েছে, “বাবরের এই সাফল্য শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়। পুরো বাংলাদেশের অর্জন এবং বাংলাদেশের গর্বের বিষয়।

“এই অর্জন তরুণদের আরও বড় স্বপ্ন দেখার এবং সেটি অর্জন করার অনুপ্রেরণা জোগাবে।”

অভিযানের রোজনামচা

১ এপ্রিল ২৯ হাজার ২৮ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্ট ও ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট উচ্চতার লোৎসে জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে পৌঁছান বাবর। সেখানে তিনি পর্বতারোহণে প্রয়োজনীয় অনুমতি নেন। সরঞ্জাম কেনেন।

প্রস্তুতিমূলক কাজ সেরে ৪ এপ্রিল বাবর আলী কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর লুকলাতে। লুকলা থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেন এভারেস্টের উদ্দেশে। ১০ এপ্রিল এভারেস্টের বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছান বাবর আলী।

২৬ এপ্রিল সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে এভারেস্ট ক্যাম্প-২ এ পৌঁছালেও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ফিরে আসেন তিনি।

এরপর এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার মতো উপযুক্ত আবহাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়েছে বাবরকে। শেষ পর্যন্ত যাত্রা শুরু হয় ১৪ মে। এদিন তিনি দ্বিতীয় ক্যাম্পে, ১৮ মে তৃতীয় ক্যাম্পে এবং ১৯ মে ভোরে ক্যাম্প ফোরে পৌঁছান।

এই দেড় মাসে বাবর আলীকে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। পেরোতে হয় একের এক বাধা। এমনকি বেইজ ক্যাম্পে কনকনে ঠাণ্ডায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। দেখতে হয়েছে মৃত্যুও।       

চট্টগ্রামের ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স তাদের ফেইসবুক পাতায় বাবর আলীর নিজের লেখা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছে। তিনি এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

২৭ এপ্রিল

নিজের পা ফেলার জায়গাটুকু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমাদের দলের সবার সামনে থুলো ফূর্বা, তারপরে ঊষাদি, আমি এবং শেষে হাভিয়ের। 

খুম্বুর আইস পিনাকলগুলো এড়িয়ে আর বরফের চাঙড় মাড়িয়ে পথচলা। ক্রাম্পনের আঘাতে চৌচির হচ্ছে বরফের চাইগুলো। শক্ত বরফ পরিণত হচ্ছে নরম তুষারে। পায়ের নিচে সেই খচরমচর চেনা শব্দ।

পেছনে ফিরে একবার তাকাতেই দূরের বেসক্যাম্পের মিটিমিটি আলো চোখে পড়ল। সোলার প্যানেলের আলো জ্বলছে খুম্বুর পাদদেশে। দুই-তিনজন শেরপা অতিক্রম করে গেল আমাদের।

চলছি আর ভাবছি প্রথমদিকের এভারেস্ট অভিযানগুলোর কথা। ১৯৫০ সালে প্রথম এই উপত্যকায় বিদেশিদের পা পড়ার পরপরই এদিক দিয়ে এভারেস্ট আরোহণের সম্ভাবনায় ব্রিটিশ আর সুইসরা ছুটে এসেছে। তখন না ছিল এখনের মতো পরিকাঠামো, না ছিল পর্বতারোহণ সরঞ্জামের এমন রমরমা।

খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে যে জুমারের সাহায্য পাচ্ছি আমরা, জুইসি এবং মার্টিন নামের দুই পক্ষী পর্যবেক্ষক জুমার আবিষ্কার করেছেন সেই ১৯৫০ সালেই। যুগের আর বিজ্ঞানের কত সুবিধা পাচ্ছি আমরা। সে তুলনায় সে যুগের অভিযাত্রীরা সরঞ্জামের দিক থেকে ছিলেন নিতান্তই অপ্রস্তুত। তবে ‘স্পিরিট অব অ্যাডভেঞ্চার’ এ পুরোপুরি বলীয়ান ছিলেন তারা।

পথের বর্ণনা একটু দেই। হরেক রকমের বরফের ভাষ্কর্য। কোনোটা গম্বুজাকৃতি, কোনোটা চোখা পিনাকল। মাথায় টুপি নিয়ে মাশরুমের আকৃতি নিয়েছে কোনও বরফ। আবার কোনোটার সঙ্গে আমার চেনা জাগতিক কোনোকিছুর সাদৃশ্য নেই। কোনও দৈববলে উপস্থিত হয়েছে এই বরফ প্রপাতে। তবে বরফের আকৃতি যেমনই হোক, একটা জিনিস খুব কমন। বরফ প্রপাতজুড়ে হাজারো ফাটল। কোনোটা লম্বালম্বি, কোনোটা দিগন্ত অভিমুখী।

২৮ এপ্রিল

সকাল সাড়ে ছয়টায় ক্যাম্প-২ এর উদ্দেশে বেরোনোর পরিকল্পনা ছিল। ফুর্বা দাই পাশের তাঁবু থেকে বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে বহু কষ্টে জানালেন, এই তাণ্ডব কিছুটা কমলে যাত্রা করব আমরা। আমরা অবশ্য তাঁবুর ভেতর নিস্পন্দ, নিথর হয়ে বসে আছি। বাংলা ফোক গান আর স্প্যানিশ পাংক গানই যা একটু দোলা দিতে পারছে আমাদের!

হাঁটা শুরু আটটা চল্লিশ নাগাদ। ঊষাদি ততক্ষণে শুভ্র বরফের রাজ্যে কালো ক্ষুদ্র বিন্দু হয়ে গেছে। আমার পিছু পিছু হাভিয়ের রওনা হলো। সবার শেষে ফুর্বা দাই। আমার সামনে সাতোরির বেশ কয়েকজন। ওদের আর ঊষাদিকে অতিক্রম করে আমার গতিতে চলতে শুরু করলাম।

ক্যাম্প-১ থেকে ৩০০ মিটার অধিক উচ্চতায় অবস্থিত ক্যাম্প-২। এভারেস্ট অভিযানে বেসক্যাম্পের পর ক্যাম্প-১ থেকে ক্যাম্প-২ এর রাস্তা অপেক্ষাকৃত সহজ। চারপাশে বিশাল সব পাহাড় দিয়ে ঘেরা জায়গাটা অনেকটা অনেকগুলো ফুটবল মাঠের মতো। এভারেস্টের বিশালাকার গাত্র, নুপৎসের গাত্র আর সম্মুখে লোৎসে ফেস।

বিশাল বরফের মাঠের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়েছে রাস্তা। বেঁকেছে মূলত তুষার ফাটলগুলোকে এড়াতেই। এরপরও কিছু কিছু ক্রেভাস আছে পথে। সেগুলো অবশ্য লাফিয়েই পেরোনো যায়। কিছুর উপরে আছে আবার স্নো ব্রিজ।

শেষ বিকালে তিন নম্বর ক্যাম্পের দিকে খানিক হেঁটে এলাম আমি আর ঊষাদি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টাতেই রাতের খাবার খেয়ে তাঁবুতে।

২৯ এপ্রিল

মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহনীয় ঘুমথলি ছাড়াও ডাউন জ্যাকেট, ফ্লিস, মেরিনো উল পরা সত্ত্বেও ঠাণ্ডাকে কাবু করা যাচ্ছে না। উল্টো আমরাই কাবু হয়ে যাচ্ছি। হাত দুটো সকাল থেকেই অসাড়। সাড়ে সাতটায় ক্যাম্প-৩ এর উদ্দেশে বেরোনোর কথা।

অসাড় হাত দুটোতে সাড় আনার জন্য গ্লাভসে গ্লাভসে ঘষাঘষি করতেই অনেক ক্যালরি ব্যয় হয়ে গেল। পরিজ খেয়ে ক্যালরির ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে নিয়ে হারনেস-বুট পরে পথে। আমাদের আগেই আরও অনেকে রওনা হয়েছে।

ক্যাম্প-২ থেকে ক্যাম্প-৩ অবধি রাস্তা লোৎসে ফেইসের গোড়া অবধি ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে উঠে গেছে। একদম টানা চড়াই ভাঙতে হয় না ফেইসের আগে অবধি।

ফেইসের গোড়া থেকে ক্যাম্প-৩ অবধি একেবারে টানা চড়াই। চনমনে রোদ উঠতেই লোৎসে ফেইসের শক্ত ও স্বচ্ছ বরফের দেওয়ালটুকু রোদে চকচক করছে। দূর থেকে দেখেই ধারণা করা যায়, ফ্রন্ট পয়েন্টিং ব্যতীত এখানে আর কোনও উপায় নেই।

ফ্রন্ট পয়েন্টিং করেও পা ওই ঢালে আটকানো যাবে কি না ঘোরতর সন্দেহ। এই লোৎসে ফেইস কঠিন পরীক্ষাই নেবে নিঃসন্দেহে। ঢালের দিকে চোখ রেখেই এগোচ্ছি। তুষারপাতে পথের দিশা যাতে মুছে না যায়, তাই কিছুদূর পরপর বাঁশের কঞ্চির আগায় লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করা।

ঊষাদির গতি সম্ভবত আরও কমে গেছে। নিচে তাকালে বিহঙ্গের দৃষ্টিতে থুলো ফুর্বা আর দিদিকে দেখতে পাচ্ছি। হাভিয়ের বেশ ভালো গতিতে এসে পড়েছে। আমার অবস্থান থেকে মিনিট ত্রিশেক হয়তো পেছনে আছে ও।

রোপে সেইফটি লাগিয়ে নানান রকম আর নকশার তুষার ফাটল পেরিয়ে লোৎসে ফেইসের পাদদেশে পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে ক্যাম্প-৩ অবধি পথ উঠে গেছে খাড়া। রোদ পড়ে লোৎসের বরফের স্বচ্ছ প্রাচীর স্বেদবিন্দুর মতো চকচক করছে। এখান থেকেই লম্বা একটা জুমারিং সেকশন শুরু। লোৎসের চূড়ার ঠিক উপরেই আকাশ। মনে হচ্ছে, কত নিচুতে নেমে এসেছে আকাশ।

বিকালছোঁয়া দুপুরে ফের এল হেলিকপ্টার। ক্যাম্প-২ এ সাধারণত হেলিকপ্টার খুব একটা আসে না। বিকালে তো আরও নয়। জরুরি প্রয়োজনেই এসেছে যান্ত্রিক ফড়িং। সাতোরি অ্যাডভেঞ্চারের একজন আমেরিকান ক্লাইম্বারের অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেমে গেছে ৩৫ শতাংশে। আর কিছুক্ষণ এই উচ্চতায় থাকলে যেকোনো কিছু হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।

৩০ এপ্রিল

সকাল ছয়টায় বেরিয়ে পড়ার পরিকল্পনা। সে অনুযায়ী পাঁচটায় উঠে ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ নাশতা। আজ শীত গতদিনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম। হাড়ে করাত চালানো ঠাণ্ডাটা নেই দেখে বেশ স্বস্তি।

শক্ত বরফের ওপর ক্রাম্পনের খোঁচার খচরমচর ছাড়া চারিদিকে একেবারে নগ্ন নৈঃশব্দ্য। এই খচরমচরকে সঙ্গী করেই পৌঁছে গেলাম এক নম্বর ক্যাম্পে। সবে তখন এক নম্বর ক্যাম্পে রোদ এসে আস্তানা গেঁড়েছে।

সোজা গেলে যে জায়গায় মিনিট দুয়েকে পৌঁছানো যেত, সেটাই এই গোলকধাঁধায় অতিক্রম করতে লাগে মিনিট কুড়ির বেশি। কখনও সামনে, কখনও পেছনে, কখনও উত্তরে কিংবা দক্ষিণে-নিচের দিকে নামছি, কিন্তু এগোচ্ছি কই? মনে হচ্ছে ওই এক জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছি।

ছোটো ছোটো ক্রেভাসগুলো পেরোচ্ছি লাফিয়ে। অন্য সময় সেইফটি বেঁধে নিজেকে ঝুলিয়ে রাখছি ফিক্সড রোপে। পথে বারদুয়েক থামা হল পানি পানের জন্য। গরম পানি একসঙ্গে বেশি পান করা যায় না। পানি পান শেষে চলতে শুরু করতেই ফের শুকিয়ে আসে গলা।

সোয়া ছয়টায় যাত্রা শুরু করে সাড়ে বারোটায় পৌঁছলাম বেসক্যাম্পে। জায়গাটাকে মনে হচ্ছে বড্ড আপন। অনেকটা বাড়ি ফেরার অনুভূতির মতো। আমার মিনিট বিশেক বাদে চলে এল হাভিয়ের। দুটোর কিছু আগে ঊষাদি এলে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজ নিজ তাঁবুতে।

১ মে

‘হ্যালো বেইজ ক্যাম্প, হ্যালো বেইজ ক্যাম্প। স্নোয়ি হরাইজন বেইজক্যাম্প’- সকালে ঘুম ভাঙল পাশের তাঁবু থেকে আসা ওয়াকিটকির আওয়াজে। পাঙ্খা দাই ক্যাম্প-২ থেকে বারেবারে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। অবশ্য যাকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে, সেই থুলো ফুর্বা চোখে ঠুলি লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে কুম্ভকর্ণের মতো।

শুনে যা বুঝলাম, ২ নম্বর ক্যাম্পে প্রচণ্ড হাওয়া বইছে। বেইজ ক্যাম্পেই আজ প্রচণ্ড হাওয়ার তাণ্ডব। সেখানে ১১০০ মিটার বেশি উচ্চতার দুই নম্বর ক্যাম্পে অবস্থা সঙ্গিন হওয়াই স্বাভাবিক।

বেইজ ক্যাম্পের কিচেনে পেম্বা দাই আজ একা। ছেলে ধর্মা রীতিমতো শয্যাশায়ী। জ্বর, কাশিতে ভুগছে।

২ মে

হাওয়ার তাণ্ডব কমলেও শীতের কামড় বেড়েছে আজ। সকালে উঠে দেখি আমার ফোনের উপরে তুষারের আস্তরণ। বেইজ ক্যাম্পে এতদিন হয়ে গেল, এমনটা হয়নি কখনও।

রোদ উঠতেই এভারেস্টের পশ্চিম গাত্র থেকে কামানের গোলার মতো গর্জন তুলে খসে পড়ল তুষার আর বরফের একটা বড়ো খণ্ড।

৩ মে

অ্যান্ড্রুর বাড়ি ফেরার যাত্রা আজ শুরু। গোলার্ধের অপর প্রান্তের অস্ট্রেলিয়ায় ফিরবে ও। ঊষালগ্নেই উঠে পড়লাম এজন্য। ঊষাদি অবশ্য সবসময়ই নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেন। আজও এর ব্যতিক্রম নয়।

একটা জিনিস খেয়াল করলাম, পুরো বেসক্যাম্পে লোকের কোলাহল বেশ কমে গেছে। নৈমিত্তিক ব্যস্ততাও কম। নিস্তব্ধতার পাতলা একটা চাদর টানা চারপাশে।

বেইজ ক্যাম্পের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরতে বেরানো মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। বেড়েছে বাতাস কেটে আসা হেলিকপ্টারের আনাগোনা। রেসকিউ ছাড়াও ক্লাইম্বারদের একটা বড়ো অংশ হেলিকপ্টারে চেপে ফিরছে নিচের জনপদে। বিপুল বিত্ত যাদের আছে, তারাই মূলত এই সুযোগ নিচ্ছে।

বিকাল থেকে ক্যাম্পে ব্যস্ততা। বীরে, সানো ফুর্বা (অংডি) ও থুলো ফুর্বা আজ রাতে যাত্রা শুরু করবে শীর্ষারোহণ শিবিরের উদ্দেশে। প্র‍য়োজনীয় রসদ রেখে আসবে সেখানে। তারই গোছগাছ চলছে ক্যাম্পে। ওদের ফিরতে দিন তিন-চারেক লাগবে।

আমরা ওই ব্যস্ততাই দেখছি। সন্ধ্যা থেকে দিদির কাছ থেকে ধার করা লঙ্কার রাজকুমারী বইয়ে ডুবে রইলাম। পাতলা ফিনফিনে সান্ধ্য আঁধারের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে ফের গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে হিমালয়ের দীর্ঘ রাত্রি।

৪ মে

শচীন কুমারের ফোনে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখলাম। পরশু থেকে অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয় বলেই মনে হল। বেসক্যাম্পেই ভারী তুষারপাতের পূর্বাভাস। শচীন বারবার বলছে, ‘দাঁত কামড়ে পড়ে থাকাটাই আগামী কয়েকদিনের মনস্তাত্ত্বিক গেম।’

কথায় কথায় বেরিয়ে এল, এই ক্যাম্পেও একজন চিলির বাসিন্দা আছেন। শচীন একটু বাদে ছোটোখাটো গড়নের স্বর্ণকেশী পাওলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বিনা অক্সিজেনে লোৎসে আরোহণ করবে সে।

বিকালে হঠাৎ করেই চারপাশ আঁধার হয়ে এল। রীতিমতো হোয়াইট আউট। দশ ফুট দূরের জিনিস ঠাহর করা যায় না। সঙ্গে গুঁড়ো তুষারের অবিরাম বর্ষণ। তাঁবু থেকে বেরোবার জো নেই। তাঁবুর বাইরে চোখ মেললে মনে হয়, ঘষা কাচের ভেতর দিয়ে দুনিয়া দেখছি।

৫ মে

পুরো বেইজ ক্যাম্প জুড়েই কাশির প্রকোপ। দিনতিনেক কাশিতে ভুগে আমি গতকাল থেকে বেশ ভালো।

আজ মাথার উপরে ঠাণ্ডা, বিবর্ণ আকাশ। কোন অকূল অসীম থেকে ভেসে আসছে একের পর এক শীতল হাওয়ার তরঙ্গ। আছড়ে পড়ছে ডাইনিং টেন্টের ওপর। সঙ্গে শুরু হয়েছে তুষারপাত।

৬ মে

পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ সকালেও আবহাওয়া খারাপ থাকার কথা। তুষারপাতের সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে বেরিয়েছি তাঁবু থেকে। বেরিয়ে দেখি ঝকঝকে রোদ উঠেছে।

কতক্ষণ থাকে এই ঝকঝকে রোদ, সেটাই কথা। অবশ্য খুম্বু আইসফলের বরফগলা জলের যে ধারা বেসক্যাম্পের পাশ ঘেঁষে বয়ে যায়, তার কলোচ্ছ্বাস আজ পুরোপুরি থেমে গেছে।

জলের ধারা আজ জমাট শক্ত বরফে পরিণত। সকাল থেকে পেম্বা দাইকে বলছিলাম, শীর্ষারোহণ শিবির স্থাপন করতে বেরোনো দলের খোঁজ নিতে। ক্যাম্প-৪ থেকে ফিরছে ওরা, ওয়াকিতে এটুকু জানা গেল। এর মধ্যে পেম্বা মারফত জানলাম, আগামী পরশু বেসক্যাম্পে একটা বিয়ে আছে। আমরা আনন্দে রীতিমতো উদ্বেল। আধা ঘণ্টা বাদেই এল দুঃসংবাদ।

ক্যাম্প-৩ থেকে নিচে নামার সময় বরফের চাঁই আঘাত হেনেছে ফুর্বা অংডির পায়ে। বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ও নাকি পা ফেলতেই পারছে না। ক্যাম্প-২ এ অবস্থান করা পাঙ্খা দাই থেকে জানা গেল এ তথ্য।

পেম্বা দাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন হেলিকপ্টার রেসকিউ-এর ব্যবস্থা করতে। ক্যাম্প-২ থেকে সরাসরি কাঠমান্ডু নিতে হবে ফুর্বাকে। সবাই বিমর্ষ এই খবর শুনে। অবশ্য পর্বতে এরকম অসংখ্য ব্যাপার ঘটে, যেগুলোতে আমাদের কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

বিকাল অবধি ফুর্বা অংডিকে উদ্ধার করা যায়নি। অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে উপরের ক্যাম্পে হেলিকপ্টার পৌঁছাতে পারেনি। কাল সকালের হেলিকপ্টারই ভরসা।

এর মধ্যে খারাপ আবহাওয়ার জন্য বিকাল থেকে ওয়াকিটকিতেও ভালোমতো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ওপাশের শব্দ আসছে না ঠিকঠাক।

৭ মে

সকালে উঠে মনে হল, সেই কোনকালে শেষবার গাছ দেখেছি! তরুলতাশূন্য এক হিমবাহের প্রান্তরের পাশে আবাস গেড়েছি আজ কতদিন!

হিমালয়ের গহন এই গিরি কন্দরে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি বিশাল, বিস্তীর্ণ খুম্বু হিমবাহের উপর সূর্যরশ্মির প্রথম কিরণ পড়েছে। চকমকে রুপোর পাতের মতো ঝিকিমিকি করছে খুম্বু। সকাল একটু গড়াতেই খবর পাওয়া গেল ফুর্বা অংডি রেসকিউ হয়ে গেছে। কাঠমান্ডুর হাসপাতালে পৌঁছে গেছে ফুর্বা দাই। হাঁটুর নিচে শিন বোনে লেগেছে।

পূর্বাভাস অনুযায়ী এগারোটার পর থেকে আবহাওয়া বিগড়ে যাবার সম্ভাবনা। ততক্ষণ অবধি আবহাওয়াটাকে উপভোগ করা।

দুপুর থেকে ফের জোরেশোরে শুরু হলো তুষারপাত। থামে আর শুরু হয়। এই চক্রের বুঝি শেষ নেই। রাতের খাবারের পরে সোজা তাঁবুতে। এই আবহাওয়ায় ডাইনিং-এও নেই পর্যাপ্ত উষ্ণতা।

৮ মে

আমার ঘুম ভাঙলেও আমাকে বেষ্টন করে রাখা পর্বতের ঘুম ভাঙেনি। সূর্যের পরশ ছাড়া এই মহাধ্যানীর ঘুম ভাঙবেই বা কীভাবে? রবির কিরণ তার শুভ্র গাত্রে লাগলে তবেই না জাগবে পাহাড় আর জব্দ হবে শীত।

অবশ্য সে আশা আজ নেই বলেই মনে হচ্ছে। তাঁবুর উপরে পুরু বরফ। তুষারের গুঁড়ো অবিরাম ঝরেই যাচ্ছে।

সকালে মাকালু অ্যাডভেঞ্চার-এর তাঁবুতে যাবার পরিকল্পনা থাকলেও তুষারকাদা পেরিয়ে বিয়ের বর-কনে চলে আসায় সে পরিকল্পনায় মুলতবি। বেসক্যাম্পে বিয়ে তো আর রোজ রোজ হয় না! কী পরব এটা নিয়ে খানিক দোটানায় ভুগছিলাম।

লাদাখিদের টেকনিক অবলম্বন করব কি না ভাবছিলাম। লাদাখ অঞ্চলে খুব শীত পড়ে বলে লাদাখিরা কয়েক পরতের জামা পরে। সবচেয়ে ভালো জামাটা ওরা সাধারণত সবার ভেতরেই নাকি পরে আর খারাপ জামাটা পরে বাইরে। আর কোন পার্বণ হলে উলটে দেয় ক্রম।

তুষারপাতের তীব্রতায় অবশ্য বেশ অনেকগুলো জামা পরে আছি। ওলট-পালটের ঝামেলায় আর গেলাম না।

৯ মে

বক্ষপিঞ্জর থেকে ফুসফুস দুটো বেরিয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে কনের। রাতে যখনই ঘুম ভেঙেছে, সদ্য বিবাহিতার কাশি শোনা গেছেই। উঁচু পর্বতে কাশি এমনিতে সজাগতার চিহ্ন বলেই পরিগণিত হয়, এই বেইজ ক্যাম্পে কনের কাশি নিশ্চয়ই সেটা নয়।

মেয়েটার জন্য আমার মায়াই হতে লাগল। ওদের দ্রুত নিচে নামা দরকার। সকালের জলযোগ সেরে ওরা বেরিয়ে পড়ল।

‘ও বাবর। বাহার আজা’- আমাদের নাশতার মাঝখানে শচীনের ডাক। মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে আমি আর ঊষাদি বেরোলাম। হাভিয়ের আজ কাপড় কাঁচবে। ওর যাবার ইচ্ছে নেই।

আমরা এগোলাম বেসক্যাম্পের অন্তের দিকে। ফোরটিন পিকস এর তাঁবুর কাছে সর্দারজী মুলকিয়ত সিংকে পেলাম। ঊষাদি আর রাকেশ বসে গেল ওদের ডাইনিং-এ। ওরা আর এগোবে না। আমরা পাইওনিয়ার হয়ে বেসক্যাম্পের শেষ মাথায় এক্সপিডিশন হিমালয়ার কাছে এসে সবিতার দেখা পেলাম।

রোটেশন সেরে সবে পরশু এসেছে। এটা-সেটা নিয়ে গপ্পো করে আগে বাড়লাম।  কোনও এক এজেন্সির শেরপা আমাদের এগোতে দেখে বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইল, ওদিকে যাচ্ছি কেন। ওদিকে তো বরফ বাদে কিচ্ছু নেই। খুম্বু আইসফলের রাস্তাও ওটা নয়।

ঘটনা হলো, শচীন শুনেছে ওদিকে একটা ডেডবডি কদিন আগেই বরফ গলে ভেসে উঠেছে। আমরা যাচ্ছি ওদিকেই।

খুব সম্ভবত ২০১৪ কিংবা ২০১৫ সালের দুর্ঘটনার মৃতদেহ এটি। নইলে পর্বতের এত নিচে সাধারণত মৃতদেহ দেখা যায় না খুব একটা।

বছর দশেক আগের অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য মহাকালের সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে উঠে এসেছে আমাদের সামনে। শরীরের মাংসল অংশটুকু খুব সম্ভবত হিমালয়ের গোরাকের পেটে গিয়েছে।

শচীন মৃতের উদ্দেশে বেশ খানিকক্ষণ প্রার্থনা করল। জায়গাটা দুজনেই ভালোমতো চিনে নিলাম নানান ল্যান্ডমার্ক দেখে। দেহ উদ্ধারে কেউ আগ্রহী হলে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারব অন্তত। অদ্ভুত এক বেদনায় আক্রান্ত হলাম দুজনেই। ফেরার পথে পাইওনিয়ার অ্যাডভেঞ্চারের তাঁবুতে থামলাম।

১০ মে

অনেকদিন বাদে ঝকমকে রোদে তুষার-ঢাকা পাহাড়গুলো চকমক করছে। গত কয়েকদিনের মধ্যে আজকের আবহাওয়া বেশ ভালো। লোৎসের রুট ওপেন হলেও এভারেস্টের রাস্তা খোলেনি এখন।

ক্যাম্প-৩ এর নিচ থেকে রোটেশন সেরে ফিরে এসেছি আজ দশদিন। টানা দশদিন কিছু না করে উপরের রুট আর আবহাওয়ার সুদৃষ্টির পানে চাতকের মতো চেয়ে আছি। অবশ্য একদম কিছু করছি না বললে ব্যাপারটা অতিকথনের পর্যায়ে পড়বে। এই ক্যাম্প, ওই ক্যাম্পে ঘুরতে যাই পায়ের জং সারানোর উদ্দেশ্য নিয়ে।

১১ মে

অপেক্ষা আর আশা–এই দুই-ই আপাতত সম্বল। অবশ্য প্রকৃতির ক্রীড়নক মানুষ আশা করে, আর তাতে বাদ সাধে প্রকৃতি। কবে ভালো আবহাওয়া পাওয়া যাবে, সামিট পুশ করা যাবে, সেই নিয়ে আশায় বুক বাঁধা ছাড়া উপায় কী!

চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন আজ। আকাশে হেলিকপ্টারের ওড়াউড়ির অন্ত নেই। কাঠমান্ডু কিংবা নিচের জনপদে যাওয়া ক্লাইম্বারেরা ফিরছে।

ঊষাদি পড়েছে বিপদে। তিনখানা হার্ডকপি বই এনেছিল আসার সময়। তিনখানাই পড়া শেষ। সময় আর কাটছে না। আমি পিডিএফ সরবরাহ করার আশ্বাস দিলেও উনি পিডিএফ পড়তে পারেন না।

অন্যদিকে হাভিয়ের বই পড়ে নিদ্রার সঙ্গী হিসেবে! বই হাতে নিলে ওর ঘুম আসে। আমার অবশ্য বই জাগরণের সঙ্গী।

১২ মে

আবহাওয়ার পূর্বাভাস গত কয়েকদিন ধরেই আমাদের সঙ্গে নানাবিধ ছলনা করে যাচ্ছে। ১৫/১৬ তারিখ বাতাসের গতিবেগ বেশি দেখে এ দুদিন উপরে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা আগ্রহ দেখাইনি।

পরে দেখা গেল, ১৭ তারিখের আবহাওয়াও বিগড়ানো। এই বিভ্রান্তির ঘূর্ণাবর্ত থেকে মুক্তি মেলাটা জরুরি হয়ে গেছে। সকালে গোরাকশেপের দিকে নামার পরিকল্পনা ছিল আমার, রাকেশ আর ঊষাদির। কিন্তু প্রকৃতির পরিকল্পনা অন্য। ভোর থেকেই তুষারপাত। ডাইনিং-এ বসেই রাজা-উজির মারছি আর আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে খবরাখবর নিচ্ছি।

দুপুরের পর থেকে তুষারপাত বাড়ল আরও। তাঁবুতেও মন টেকে না। পাড়া বেড়ানোর স্বভাব হয়ে মুশকিলে পড়েছি। নিভন্ত দুপুরে সাতোরির দিকে ঘুরে এলাম। চেনা মুখ কাউকে অবশ্য চোখে পড়ল না। দুপুরকালীন সিয়েস্তায় মগ্ন সবাই। বিকাল হতেই দিদির ফোনে বসে বসে মুভি দেখা। ওয়াকিটকিতে খবর এল, হাভিয়ের ক্যাম্প-২ পৌঁছে গেছে।

১৩ মে

প্রভাতের মৃদু পরশ তাঁবুর উপর পড়তেই ঘুম ভাঙল। ঘুমথলিতে শুয়েই নানা আকাশ-পাতাল ভাবি। কল্পনা খরচা করি আবহাওয়া নিয়ে। উচ্চতর পর্বতের আবহাওয়া নামক অতিকায় হাতিটাকে হাতের ঠেলায় সরানো গেলে কত্ত ভালো হতো!

এত প্রতীক্ষা আর প্রাণে সয় না। আবার এটাও জানি, প্রকৃতির খেয়াল নামক জিনিসটা দোপেয়ে প্রজাতিদের নিয়ন্ত্রণের অনেকটাই বাইরে।

১৪ মে

সকাল সকাল ওয়াকিটকিতে খবর পাওয়া গেল, ঊষাদি পৌঁছে গেছে ক্যাম্প-১ এ। থুলো ফুর্বা থেকে ওয়াকি নিয়ে দিদি আমাকে খুব উৎফুল্ল গলায় বললেন খবরটা।

আমি অবশ্য দিদিকে আগেই বলেছিলাম, এবার ওনার সময় অনেক কম লাগবে। দিদি তাও ধরে নিয়েছে, এবারও ঠিক ১০ ঘণ্টাই লাগবে। কিন্তু পৌঁছে গেছেন সাড়ে আট ঘণ্টাতেই। উচ্চতায় খাপ খাওয়ানোর এই তো সুবিধা।

এর একটু বাদেই ফের ওয়াকিতে আমার তলব। হাভিয়ের চাইছে আমাকে। কাল 8K-এর পাবলোর কাছে দিয়ে আসা আইফোনের কেবল ওর কাছে পৌঁছায়নি।

8K-এর অ্যালেক্স বেন কাল ক্যাম্প-২ যায়নি। এখন হাভিয়ের চায়, ওটা পাবলোর কাছ থেকে আমার জিম্মায় এনে যাতে আমি ক্যাম্প-২ তে ওটা নিয়ে যাই। চিলিয়ানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে একটু-আধটু মরিচ তো খেতেই হবে!

একবার ক্যাম্প-২ পৌঁছে নিই, ওই কেবল দিয়ে বেঁধেই ওরে সাইজ করতে হবে! ফের যাও চড়াই ভেঙে 8K-এর তাঁবুতে। এবার পাবলোকে ডাইনিং-এ পাওয়া গেল না। তাঁবু থেকে খুঁজে বের করা লাগল। কেবল নিয়ে এসে মাউন্টেনিয়ারিং বুট নিয়ে লাগলাম। এর থার্মাল ইনসোল প্রযুক্তি আমি আগে ব্যবহার করিনি। ভালোমতো ম্যানুয়াল পড়ে খুঁটিনাটি জেনে নিলাম।

পুরোদিন ধরেই একটু একটু করে ব্যাগপত্তর গোছাচ্ছি।

অবশেষে এভারেস্টে বাবর

১৪ মে এর পর বাবর আর কিছু লেখেননি। রবিবার সকালে ভার্টিকেল ড্রিমার্স তাদের ফেইসবুক পাতায় লিখেছে, “অবশেষে!!

পৃথিবীর শীর্ষ এভারেস্ট ছুঁয়েছি আমরা!!! ১১ বছর প্রতীক্ষার পর আজ তৃতীয় মেরুতে উড়েছে লাল-সবুজ!! ঠিক শুনছেন। আমাদের স্বপ্ন সারথি বাবর আলী আজ সকাল স্থানীয় সময় ০৮:৩০ (বাংলাদেশের সময় ০৮:৪৫ এ) আকাশ ছুঁয়েছে।

“সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং লাখো শুভাকাঙ্ক্ষীদের দোয়ায় প্রকৃতি মাতা বাবরকে ক্ষণিকের জন্য স্থান দিয়েছেন নিজের চূড়ায়। খানিক আগে বেসক্যাম্প ম্যানেজার এবং আউটফিট মালিক আমাদের এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এখন বাবর আছে ক্যাম্প-৪ এ নামার পথে। ওই ডেথ জোনে যোগাযোগ সম্ভব নয়।  আমরা ভীষণ আনন্দিত। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের মূল লক্ষ্য কিন্তু শুধু এভারেস্ট নয়, লোৎসেও। তাই দোয়াতে থাকুক বাবর আলী।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত