অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস এবং অন্যান্য অণুজীবদের প্রতি যত্নশীলতা আমাদের ভাবনা-চিন্তার গভীরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাতেও নতুন পথ দেখাতে পারে।
আমাদের অন্ত্র একটি ব্যস্ত ও জীবন্ত উপনিবেশ। এখানে লাখ লাখ অণুজীবের বাস, যারা আবার হাজার হাজার প্রজাতির। এই অণুজীবগুলোর অনেকগুলো, যেমন- ব্যাকটেরিয়া, আর্কিয়া এবং ইউকারিয়া, মানুষের আগ থেকেই পৃথিবীতে ছিল এবং আমাদের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে। এখন আমাদের শরীরে যত কোষ রয়েছে, অনুজীবের পরিমাণ সেই সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্ক- এর অ্যানাটমি ও নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক জন ক্রায়ান টেডএক্স টক- এর একটি পর্বে মজার ছলে বলেছিলেন: “যখন আপনি বাথরুমে যান এবং কিছু অণুজীব ত্যাগ করেন, মনে রাখবেন: আপনি তখন আরও বেশি মানুষ হচ্ছেন।”
এই অণুজীবদের সমষ্টিকে ‘মাইক্রোবায়োটা’ বলা হয়। এগুলো আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন- হজম, বিপাক এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি। এছাড়া, তারা এমন গুরুত্বপূর্ণ যৌগ তৈরি করে যা মানবদেহ নিজ থেকে উৎপাদন হয় না।
গত কয়েক দশকের গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটা শুধু মস্তিষ্ককে কার্যক্ষম রাখতেই সাহায্য করে না, বরং আমাদের চিন্তা এবং আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে। এসব গবেষণার ফল মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন- বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং স্কিজোফ্রেনিয়ার মতো অবস্থার নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির ধারণা দিতেও পারে।
এই বিষয়ে এখনো অনেক কিছু অজানা। তবে কোভিড-১৯ অতিমারি- যা অনেক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে বাজে প্রভাব ফেলেছে, এই রহস্য সমাধান করা আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এই গবেষণা ক্ষেত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গল্প শুরু হয়েছিল উত্তর আমেরিকার এক বন্য প্রান্তরে। ১৮২২ সালে অ্যালেক্সিস সেন্ট মার্টিন নামে এক যুবক মিশিগানের ম্যাকিন্যাক আইল্যান্ডে একটি ব্যবসা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ পাশেই থাকা একটি বন্দুক থেকে দুর্ঘটনাক্রমে একটি গুলি তার পেট ফুঁড়ে দেয়। মাত্র ৯১ সেন্টিমিটার দূর থেকে গুলি লাগায় আঘাত ছিল গুরুতর। সেন্ট মার্টিনের ফুসফুস, পাকস্থলির একটি অংশ এবং সেই দিনের সকালের নাস্তার কিছু অংশ ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসে। তার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত মনে হচ্ছিল। তবে, উইলিয়াম বোমন্ট নামে একজন সেনা সার্জন কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর প্রায় এক বছরের প্রচেষ্টায় তার জীবন বাঁচাতে সক্ষম হন।
অবশ্য বোমন্ট রোগীর শরীর ও পাকস্থলির গর্তটি মেরামত করতে পারেননি। এই ছিদ্রটি দুর্ঘটনার এক দুঃখজনক স্মারক হিসেবে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। অবশ্য এই সুযোগ কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন বোমন্ট। সেন্ট মার্টিনের পেটের ফুটো দিয়ে বোমন্ট মানব অন্ত্রের কার্যকলাপ বোঝার একটি অনন্য সুযোগ পেয়ে যান। তিনি কয়েক বছর ধরে হজম প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা চালান। তবে সেন্ট মার্টিন এই গবেষণায় কতটা স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেননা বোমন্ট তাকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং গবেষণার অংশ হিসেবে তার উপর পরীক্ষা চালান।
এই গবেষণায় বোমন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবিষ্কার করেন—সেন্ট মার্টিনের অন্ত্র তার আবেগ, যেমন রাগ, দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, বোমন্ট, যিনি পরে ‘গ্যাস্ট্রিক ফিজিওলজির জনক’ হিসেবে পরিচিত হন, একটি নতুন ধারণার জন্ম দেন—’গাট-ব্রেইন অ্যাক্সিস’ বা অন্ত্র-মস্তিষ্ক সম্পর্ক। তিনি দেখান যে অন্ত্র এবং মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ আলাদা নয়, বরং একে অপরকে প্রভাবিত করে। আজ আমরা জানি, অন্ত্রে থাকা লাখ লাখ অনুজীব এই বিষয়টির সঙ্গে বহুমাত্রিকতা যোগ করেছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস এর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বায়োলজি ও ফিজিওলজির অধ্যাপক ইলেইন সিয়াও বলেন, “বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অন্ত্রের অণুজীব মস্তিষ্ক এবং আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে।”
মানুষের মাইক্রোবায়োটা কীভাবে মনের ওপর প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে গবেষণা এখনো নতুন এবং দিন দিন বাড়ছে। তবে গত ২০ বছরে, বিশেষ করে প্রাণীদের ক্ষেত্রে, এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়েছে। ধীরে ধীরে এটি পরিষ্কার হচ্ছে যে অণুজীব শুধু আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য নয়, মানসিক এবং আবেগগত স্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য।
নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক জন ক্রায়ান বলেন, “চিকিৎসাশাস্ত্রে আমরা শরীরকে আলাদা আলাদা অংশে ভাগ করে দেখি। যেমন, মস্তিষ্কের সমস্যা নিয়ে কথা বললে আমরা সাধারণত গলা থেকে উপরের অংশকেই মনে করি। কিন্তু আমাদের বিষয়গুলো বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, অণুজীব মানুষের আগেই ছিল, এবং আমরা এদের সঙ্গে ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটস’ হিসেবে বিবর্তিত হয়েছি। এমন কোনো সময় ছিল না যখন মস্তিষ্ক অণুজীব থেকে আসা সংকেত ছাড়া কাজ করেছে।”
“যদি এই সংকেতগুলো আমাদের অনুভূতি, আচরণ এবং কার্যকলাপ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাহলে কী হবে? আর যদি আমরা থেরাপিউটিক উপায়ে এই অণুজীবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে কি চিন্তা, আচরণ এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত করা সম্ভব হবে?”
ইলেইন সিয়াও এই ক্ষেত্রের অন্যতম অগ্রণী গবেষক। তার ল্যাব ইউসিএল-এ গবেষণা করেছে যে এই অণুজীবগুলো কীভাবে ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশ, জ্ঞানীয় ক্ষমতা এবং মৃগী বা বিষণ্ণতার মতো স্নায়ুবিক সমস্যায় ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি এটাও খুঁজে দেখেছেন যে, এই অণুজীবগুলো কীভাবে আমাদের মস্তিষ্ক এবং চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে।
তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট অন্ত্রের অণুজীব ইমিউন সিস্টেমকে এমনভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যা মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, এগুলো এমন কিছু মলিকিউল তৈরি করতে পারে, যা সরাসরি স্নায়ুকোষের (নিউরন) সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা দেখেছি, অন্ত্রের অণুজীব স্নায়ুকোষের প্রাথমিক বিকাশকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা দীর্ঘস্থায়ীভাবে মস্তিষ্কের সার্কিট এবং আচরণে প্রভাব ফেলে। আবার স্বল্প সময়ের মধ্যেও, এগুলো সেরোটোনিনের মতো বায়োরাসায়নিক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা সক্রিয়ভাবে স্নায়ুকোষের কার্যকলাপ উদ্দীপিত করে।”
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আমাদের অন্ত্রের অণুজীবগুলো বিভিন্ন পথের মাধ্যমে মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে—যেমন ইমিউন সিস্টেম এবং বায়োরাসায়নিকের মাধ্যমে। আরেকটি সম্ভাব্য মাধ্যম হলো ভ্যাগাস নার্ভ, যা মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রসহ অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর মধ্যে দ্রুতগতির ‘ইন্টারনেট সংযোগ’ হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, Lactobacillus rhamnosus JB1 নামের একটি ব্যাকটেরিয়া উদ্বিগ্ন এবং বিষণ্ণ অবস্থার মধ্যে থাকা ইঁদুরের মনোভাব উন্নত করতে পারে। তবে ভ্যাগাস নার্ভের মাধ্যমে সংকেত যাওয়া বন্ধ করে দিলে এই উপকারী প্রভাবও বন্ধ হয়ে যায়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় এই ব্যাকটেরিয়া যোগাযোগের জন্য ভ্যাগাস নার্ভ ব্যবহার করতে পারে।
এই ক্ষেত্রে গবেষণার বেশিরভাগ অংশ ইঁদুর এবং অন্যান্য ছোট প্রাণীর ওপর চালানো হয়। তবে ইঁদুর তো আর মানুষ নয়। তবুও, মানুষের চিন্তা-ভাবনা এবং আচরণের সঙ্গে অণুজীবের সংকেতের কার্যকারিতা প্রমাণ করা অত্যন্ত জটিল হওয়ায়, প্রাণীর ওপর চালানো গবেষণাগুলো ব্যাকটেরিয়া এবং মস্তিষ্কের অদ্ভুত সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে যে ‘জার্ম-ফ্রি’ ইঁদুর এবং ইঁদুরছানা (যাদের জীবাণুমুক্ত পরিবেশে বড় করা হয়েছে এবং যাদের অন্ত্রে কোনো মাইক্রোবায়োটা নেই) বেশি উদ্বিগ্ন এবং কম সামাজিক হয়, তাদের তুলনায় যাদের অন্ত্রে সুস্থ মাইক্রোবায়োটা থাকে। গবেষণার ফল এও বলছে, ‘জার্ম-ফ্রি’ ইঁদুর এবং অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া ইঁদুরগুলোকে বেশি অস্থির, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ প্রবণ এবং কম শিখতে ও মনে রাখতে সক্ষম। প্রাণীর অন্ত্রে মাইক্রোবায়োটার পরিমাণ কমিয়ে দেয় অ্যান্টিবায়োটিক। এটি জেব্রাফিশের ‘শোলিং বিহেভিয়ার’ বা দলবদ্ধ থাকার আচরণকে হ্রাস করে। অন্যদিকে, প্রোবায়োটিক এই আচরণকে বাড়ায়।
মানুষের মস্তিষ্ক অবশ্যই ইঁদুর বা মাছের চেয়ে অনেক বেশি জটিল, তবে কিছু মিল রয়েছে এবং সেগুলো থেকে সূত্র পাওয়া সম্ভব। আমাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকার এবং বংশবৃদ্ধি করার জন্য আমাদের শরীরের উপর নির্ভর করে। তাই তারা এমনভাবে আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে, যা তাদের নিজের উপকারে আসে। উদাহরণস্বরূপ, তারা আমাদের আরও সামাজিক বা অন্য মানুষের সঙ্গে মিশতে উৎসাহিত করতে পারে, যাতে তারা নতুন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে (যেমন স্পর্শ বা শেয়ার করা পরিবেশের মাধ্যমে)। এটি বোঝায় যে, ব্যাকটেরিয়াগুলো সম্ভবত এমন কিছু প্রক্রিয়া বা উপায় তৈরি করেছে, যা আমাদের আবেগ বা আচরণকে সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করে তাদের বেঁচে থাকার পরিবেশকে আরও ভালো রাখে। তবে এটি এখনও গবেষণার একটি প্রাথমিক বিষয় এবং পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তাহলে, যোগাযোগক্ষম অণুজীব, জেব্রাফিশের দলবদ্ধ আচরণ বা বন্ধুসুলভ ইঁদুরের আচরণ কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ? গবেষকরা আশা করছেন, হ্যাঁ। এই প্রক্রিয়াগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যার জন্য যুগান্তকারী নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার সম্ভব হতে পারে।
“আমরা মাইক্রোবায়োটার ভিত্তিতে মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার জন্য ‘সাইকোবায়োটিকস’ শব্দটি তৈরি করেছি”, বলেন ক্রায়ান। “এবং সাইকোবায়োটিক পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে।”
তবে কিছু সতর্কতা অবশ্যই রয়েছে। যদিও কিছু ব্যাকটেরিয়া মানুষের মানসিক অবস্থার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, অনেকগুলো তেমন করে না। কেন এবং কীভাবে এগুলো কাজ করে, তা এখনো গবেষকরা পুরোপুরি প্রমাণ করতে পারেননি। এর সঙ্গে মানুষের চিন্তা-ভাবনা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে জিনগত বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশসহ অসংখ্য বিষয় প্রভাব ফেলে।
“আমাদের অনেক বড় আকারের মানব গবেষণা প্রয়োজন, যাতে এই ব্যক্তিগত পার্থক্যগুলো বিবেচনায় নেওয়া যায়,” বলেন ক্রায়ান। “সম্ভবত, প্রতিটি মানুষ একটি নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার ওপর একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, কারণ সবার মাইক্রোবায়োটার ভিত্তি একটু ভিন্ন হবে।”
তবুও, গবেষণা আমাদের নতুন আশা দিতে পারে। “ভালো খবর হলো, আপনি আপনার মাইক্রোবায়োটা পরিবর্তন করতে পারেন, যেখানে আপনার জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করার মতো বেশি কিছু করার সুযোগ নেই—পিতামাতা বা পূর্বপুরুষদের দোষ দেওয়া ছাড়া,” যোগ করেন ক্রায়ান। “মাইক্রোবায়োটা পরিবর্তনের মাধ্যমে আপনি সম্ভবত আপনার নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে একটি ভূমিকা রাখতে পারেন।” প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট, বেশি ফাইবার এবং ফারমেন্টেড খাবার খাওয়া, এমনকি সম্ভবত ধ্যানের মাধ্যমেও, মাইক্রোবায়োটা এমনভাবে পরিবর্তন করা যায় যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফিলিপ বার্নেট উল্লেখ করেন, অনেক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে মাইক্রোবায়োটার পরিবর্তনের যোগসূত্র রয়েছে। এই ভারসাম্যহীনতা বা ‘ডিসবায়োসিস’ সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ হ্রাস দ্বারা চিহ্নিত হয়, বিশেষত যেগুলো অন্ত্রে ফাইবার ভেঙে শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি করে (যেমন বুটাইরেট, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে বলে বিশ্বাস করা হয়)।
২০১৯ সালে কেয়ু লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট মিরেইয়া ভালেস-কোলোমার এবং তার সহকর্মীরা একটি গবেষণায় প্রমাণ করেন যে, বুটাইরেট উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, “বুটাইরেট উৎপাদনকারী Faecalibacterium এবং Coprococcus ব্যাকটেরিয়া উচ্চ জীবনমান সূচকের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। Dialister এবং Coprococcus spp. বিষণ্ণতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে হ্রাস পেয়েছে, এমনকি অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের প্রভাব বাদ দেওয়ার পরও।”
গবেষণাগুলোয় অন্ত্র, মস্তিষ্ক এবং মাইক্রোবায়োটার মধ্যে যোগাযোগ নিয়ে মানবিক গবেষণা এখনো তুলনামূলকভাবে সীমিত। বার্নেট সতর্ক করেন, “এখনো জানা যায়নি, অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার পরিবর্তিত স্তরগুলো মন খারাপের কারণ কিনা, নাকি বিষণ্ণ মানুষদের খাদ্যাভ্যাস বা কম খাওয়ার কারণে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা পরিবর্তিত হয়।”
তবুও, বার্নেট প্রিবায়োটিক (যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি উৎসাহিত করে) এবং প্রোবায়োটিক (জীবিত ব্যাকটেরিয়া) কীভাবে ভবিষ্যতে ‘সাইকোবায়োটিকস’ হিসেবে কাজ করতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। এর মাধ্যমে ‘উপকারী’ ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা করা সম্ভব হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় বার্নেট, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী রিটা বাইও এবং তাদের সহকর্মীরা একটি গবেষণার চালান।
গবেষণায় মৃদু থেকে মাঝারি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একটি প্রোবায়োটিকের প্রভাব পরীক্ষা করা হয়। একইসঙ্গে, পরীক্ষার আগে ও পরে তাদের মানসিক অবস্থাও মনিটর করা হয় Patient Health Questionnaire-9 (PHQ-9)– এর মাধ্যমে, যা বিষণ্ণতার তীব্রতা পরিমাপ করে।
অংশগ্রহণকারীদের (যারা অন্য কোনো ওষুধ গ্রহণ করছিলেন না) চার সপ্তাহ ধরে হয় প্ল্যাসেবো বা একটি বাণিজ্যিকভাবে প্রাপ্ত প্রোবায়োটিক দেওয়া হয়, যাতে ১৪টি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া (যেমন: Bacillus subtilis, Bifidobacterium bifidum, Bifidobacterium breve, এবং Bifidobacterium infantis) অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্ল্যাসেবো হলো, এমন একটি জিনিস যা দেখতে বা স্বাদে আসল ওষুধের মতো হলেও, আসলে ওষুধের কোন উপাদান থাকেনা। মূলত এটি ব্যবহার করা হয় ওষুধের নানা প্রতিক্রিয়া দেখতে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা প্ল্যাসেবো সেবনের পর মানসিকভাবে এটা মনে করেন যে তাদের ওষুধ দেয়া হয়েছে।
সে যাই হোক, ওই গবেষণার ফলাফল বেশ আশ্চর্যজনক ছিল। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা প্রোবায়োটিক নিয়েছেন তারা প্ল্যাসেবো গ্রহণকারীদের তুলনায় তাদের মেজাজে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করেন এবং PHQ-9 অনুযায়ী বিষণ্ণতা হ্রাস পায়। তবে তাদের উদ্বেগের স্তরে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
গবেষণাটি ছিল ছোট (৭১ জন অংশগ্রহণকারী) এবং স্বল্পমেয়াদী। কারণ-প্রভাব সম্পর্ক প্রমাণের জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন। তবে এটি একটি প্রাথমিক ইঙ্গিত দেয় যে ‘সাইকোবায়োটিকস’ একদিন বিষণ্ণতা মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে, বিশেষ করে তাদের জন্য যারা চিকিৎসা নিতে বা প্রচলিত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক।
বার্নেট বলেন, “সাইকোবায়োটিকস প্রচলিত চিকিৎসার বিকল্প নয়, বরং একটি সম্পূরক হিসেবে কাজ করতে পারে।”
সাইকোবায়োটিকসের সম্ভাবনা ইতিমধ্যেই অনেকের কল্পনাকে প্রভাবিত করেছে।
বার্নেট মন্তব্য করেন, “আমরা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক আগ্রহ পেয়েছি। মানুষ প্রাকৃতিক পরিপূরক গ্রহণের মাধ্যমে নিজের স্বাস্থ্য এবং মনের সুস্থতা বজায় রাখতে খুবই আগ্রহী। উপকারী ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের ধারণাটি মানুষের কল্পনাকে আকর্ষণ করেছে, বিশেষ করে মহামারির কারণে যখন অনেকেই উদ্বেগ ও হতাশায় ভুগছেন।”
বার্নেট ও চিয়া-চিং কাও পরিচালিত একটি ডাবল-ব্লাইন্ড, প্লাসিবো-কন্ট্রোলড ক্রসওভার গবেষণায় প্রিবায়োটিকের সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাবের ইঙ্গিত মেলে। বার্নেট বলেন, “আমরা দেখেছি যে প্রিবায়োটিক সাইকোসিস রোগীদের কগনিটিভ ফাংশন উন্নত করেছে, যা ক্লিনিক্যাল স্কেলে পরিমাপ করা হয়।”
গবেষণাটি সাইকোসিসের কারণে হওয়া মানসিক দুর্বলতা (যেমন স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতায় ঘাটতি) প্রিবায়োটিকসের প্রভাব পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। অংশগ্রহণকারীরা সাইকোসিস নিয়ন্ত্রণে ওষুধ সেবন করলেও মানসিক দুর্বলতা অনুভব করছিলেন।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। এক দলকে ১২ সপ্তাহ ধরে প্রিবায়োটিকস দেওয়া হয়, যা উপকারী গাট ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি উৎসাহিত করে। অন্য দলকে প্ল্যাসেবো দেওয়া হয়, যা দেখতে প্রিবায়োটিকসের মতো হলেও এতে কোনো সক্রিয় উপাদান ছিল না। এই সময়কালে, তাদের মেটাবলিজম, ইমিউন সিস্টেম এবং মানসিক দুর্বলতার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণার শেষে, দলগুলোর মধ্যে ভূমিকা বদল করা হয়। যারা প্রাথমিকভাবে প্রিবায়োটিকস পেয়েছিল, তারা প্ল্যাসেবো পায়, এবং যারা প্ল্যাসেবো পেয়েছিল, তারা প্রিবায়োটিকস পায়। এই ক্রসওভার ডিজাইন নিশ্চিত করে যে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী প্রিবায়োটিকস এবং প্ল্যাসেবো উভয়ের প্রভাব সমান সময় ধরে অনুভব করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রিবায়োটিকের প্রভাব তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ। এটি কগনিটিভ ফাংশন, বিশেষ করে মনোযোগ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা উন্নত করেছে। গবেষকদের মতে, এই উন্নতি সামাজিক এবং মানসিক সুস্থতায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বা বিপাকে কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। কীভাবে প্রিবায়োটিক এই প্রভাব তৈরি করেছে সেটিও এখনও স্পষ্ট নয়।.
সাইকোসিস মানসিক বিভ্রম, মিথ্যা বিশ্বাস এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতার মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা অনেকেই জানেন। তবে, সাইকোসিস রোগীরা প্রায়ই মনোযোগ, স্মৃতি এবং সমস্যা সমাধানের মতো কগনিটিভ কার্যক্রমে সমস্যার মুখোমুখি হন, যা তাদের চাকরি এবং সম্পর্ক ধরে রাখতে প্রভাব ফেলে। বিভ্রম ও মিথ্যা বিশ্বাস চিকিৎসায় ওষুধ কার্যকর হলেও কগনিটিভ সমস্যার উন্নতিতে বিশেষ অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এছাড়াও, মাইক্রোবায়োটার প্রভাব কগনিটিভ দক্ষতার উপর আরও বিস্তৃত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অ্যান্টিবায়োটিক অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটাকে প্রভাবিত করে, কিন্তু তা কি আমাদের কগনিশনেও প্রভাব ফেলে? এক সাম্প্রতিক গবেষণায় ১৪,৫৪২ জন নার্সের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা হয়, যারা ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কাজ করছিলেন। দেখা যায়, যারা দীর্ঘ সময় ধরে (দুই মাসের বেশি) অ্যান্টিবায়োটিক নিয়েছিলেন, তারা কগনিটিভ টেস্টে (যেমন: শেখা, ওয়ার্কিং মেমোরি ও মনোযোগ) তুলনামূলক কম স্কোর করেছেন। এমনকি সাত বছর পরে দেখা যায়, এই নারীদের কগনিশন সামান্য হলেও দুর্বল হয়েছে। যদিও এটি একটি পারস্পরিক সম্পর্ক মাত্র, গবেষকদের ধারণা অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা অন্ত্রের পরিবর্তনের কারণেই এটি হতে পারে।
তবে এই ক্ষেত্রে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এটি এক অত্যন্ত জটিল ও মনোমুগ্ধকর ক্ষেত্র, যা গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন প্রয়োজন। তবে এর সম্ভাব্য পুরস্কার হতে পারে বিশাল।
“এখন পর্যন্ত কয়েকটি নির্দিষ্ট মাইক্রোব নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে”, বলেন হসিয়াও। “অবশ্যই তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে নয়, বরং আমরা বিজ্ঞানীরা এখনও অনেক কিছু শিখতে চাই, বিশেষ করে অন্ত্রের মাইক্রোবের বৈচিত্র্য এবং সেগুলোর পৃথকভাবে ও সমষ্টিগত কার্যক্রম সম্পর্কে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এবং আমাদের মাইক্রোবিয়াল সঙ্গীরা একত্রে কাজ করে স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং রোগ প্রতিরোধ করার কৌশল বের করার ব্যাপারেই আমি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী।”
এরই মধ্যে, আমাদের মাইক্রোবায়োটার প্রতি একটু বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। উচ্চমাত্রায় ফাইবারযুক্ত ভূমধ্যসাগরীয় ডায়েট (বিশেষ করে শাকসবজির মাধ্যমে) শুরু করার জন্য ভালো বিকল্প হতে পারে। এছাড়া, ফারমেন্টেড ফুড, যেমন কিমচি ও কেফির (এক ধরনের ফারমেন্টেড দুধের পানীয়) উপকারী হতে পারে। এক ছোট গবেষণায় (৪৫ জন অংশগ্রহণকারী), ক্রায়ান ও তার সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে, যারা উচ্চ ফাইবার, প্রিবায়োটিক এবং ফারমেন্টেড ফুড (যেমন: পেঁয়াজ, দই, কেফির, সওয়ারক্রাউট) অন্তর্ভুক্ত ডায়েট গ্রহণ করেছিলেন, তারা খাদ্যতালিকায় এসব অন্তভুক্ত না করাদের তুলনায় কম স্ট্রেস অনুভব করেছেন।
ক্রায়ান বলেন, “ফারমেন্টেড ফুডের বিষয়ে আমি সবচেয়ে বেশি যা পছন্দ করি তা হলো এটি বিজ্ঞানের গণতন্ত্রীকরণ ঘটায়। এর জন্য খুব বেশি খরচ হয় না এবং কোনো বিলাসবহুল দোকান থেকে এটি কিনতে হয় না। আপনি নিজেই এটি তৈরি করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে, আমরা এমন সমাধান দিতে চাই যা সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্তরের মানুষের জন্য প্রযোজ্য।”
“আমাদের মাইক্রোবায়োটার সঙ্গে সম্পর্কটি ‘একটি ফেডারেশনের মতো”, যোগ করেন ক্রায়ান। “এই মাইক্রোবগুলো আমাদের সহযাত্রী।”
এটি মনে রাখা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ – আমাদের শারীরিকের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের স্বার্থেও।
(বিবিসি অবলম্বনে)