সিলেটের বাহুবল উপজেলার পরিষদ নির্বাচনে শক্তিশালী সব প্রার্থীর ভিড়ে কারও নজরই ছিল না ভোটের রাজনীতিতে নবাগত মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইনের দিকে। অথচ ভোট শেষে দেখা গেল এই ব্যবসায়ী জিতে চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছেন।
মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আনোয়ার হোসাইন দোয়াত-কলম প্রতীকে ১৮ হাজার ৬৮২ ভোট পেয়ে বাজিমাত করেছেন। তার এই বিজয় ঘিরে এলাকায় চলছে তুমুল আলোচনা।
এই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা। তাদের তিনজন আবার সাবেক চেয়ারম্যান। দুজন ছিলেন আবার সংসদ সদস্যের স্বজন।
তাদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আবদুল হাই টেলিভিশন প্রতীকে পেয়েছেন ১২ হাজার ৭৮৪ ভোট।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আবদুল কাদির চৌধুরী কৈ মাছ প্রতীকে পেয়েছেন ৭ হাজার ৭০৩ ভোট।
হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর বড় ভাই রাজন চৌধুরী কাপ-পিরিচ প্রতীকে পেয়েছেন ১২ হাজার ৭৯ ভোট।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও হবিগঞ্জ -৩ আসনের সংসদ সদস্য আবু জাহিরের স্ত্রীর বড় ভাই আখতারুজ্জামান আনারস প্রতীকে পেয়েছেন ৫ হাজার ৮৪ ভোট।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক শেখ মো. ফিরোজ আলী মিয়া মোটরসাইকেল প্রতীকে পেয়েছেন ৪৭৩ ভোট।
বিদায়ী উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ খলিলুর রহমান ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন মাত্র ২৬৯ ভোট।
এই সব প্রার্থীর ভিড়ে পেছনেই ছিলেন আনোয়ার। নাজাত ট্রাভেলস নামে এজেন্সির মালিক আনোয়ার শর্ষিনার মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন বলে তার ফেইসবুক পাতায় দেখা যায়। তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায়ও পড়াশোনা করেন।
এলাকায় সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক কোনও কাজে আনোয়ারকে কখনও দেখা যায়নি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। মাত্র তিন মাস আগে তিনি সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে প্রথম রঙিন পোস্টার লাগালে মানুষ তাকে চিনতে শুরু করে।
ফলে তার জয় দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। তেমনই একজন বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট ইউনিয়নের গাংধার গ্রামের যুবক মিটু চন্দ্র।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কালো টাকার কাছে ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের পরাজয়ে মানুষ মর্মাহত।”
বাহুবল উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফিরুজ আলী মিয়াও একই কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আনোয়ার হোসাইন ট্রাভেলস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলেও তাকে নিয়ে মানব পাচার ও সোনা চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে। তিনি প্রচুর কালো টাকা ছড়িয়ে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করেছেন। মসজিদ মাদ্রাসায় লাখ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছেন। এতে করে আজীবন মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করা মানুষগুলোকে তার কাছে ধরাশায়ী হতে হয়েছে।”
বর্তমান চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান হতাশার প্রকাশ করে বলেন, “দেশে তো এখন আর রাজনীতি নাই, নির্বাচন নাই। শুধু টাকার খেলা। মানুষ কালো টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দেখে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
আনোয়ারকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “যিনি একজন আদম ব্যবসায়ী ও নারী পাচারকারী হিসেবে অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন। এলাকায়ও থাকেন না। ঢাকায় থাকেন। হঠাৎ টাকার জোরে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন! এটা আমাদের জন্য লজ্জার।”
আনোয়ারের কাছে হেরে যাওয়া আব্দুল হাই বলেন, “একজন অপরিচিত মানুষ, জীবনে মানুষের জন্য কিছু করেনি, শুনেছি তিনি স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে জড়িত, সেই ব্যক্তি টাকার জোরে নির্বাচনে জিতে গেলেন!”
নিজের দলের অবস্থান নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাইয়ের।
তিনি বলেন, “দলের সিদ্ধান্ত ছিল এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন নির্বাচন করতে পারবেন না। অথচ আমাদের উপজেলায় স্থানীয় এমপির ভাই নির্বাচন করলেন, সদর আসনের এমপির সম্বন্ধী (স্ত্রীর ভাই) নির্বাচন করলেন। দল কোনও ব্যবস্থা নিল না।”
দলীয় নেতা-কর্মীদের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, “কী আর বলব, বিজয়ী প্রার্থী অনেক জায়গায় আমার এজেন্টদের পর্যন্ত কিনে ফেলেছিল। বিশেষ করে মীরপুর ইউনিয়নে প্রশাসনের যোগসাজশে কেন্দ্রগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে ভোট প্রদান করা হয়েছে।”
তবে নির্বাচনে কোনও ধরনের অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন বাহুবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মনজুর আহসান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফলাফল নিয়ে কোনও অভিযোগ পাইনি।”
এদিকে বিজয়ী আনোয়ার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি ভোটারদের নির্বাচনমুখী করতে পেরেছি। আমি প্রার্থী না হলে এখানে নির্বাচনই জমত না।
“দল-মতের উর্ধ্বে উঠে মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। এখন মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করতে চাই।”
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “নির্বাচনে তো টাকা খরচ হবেই। আইনের ভেতরেই সবকিছু করেছি।”