বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নবীন শিক্ষার্থী নাহিয়ান আমিন বৃহস্পতিবার ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেলেন- “চার বছর পর এই দিনটাকে আমি আবার ফিরে দেখবো?” কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর আর কোনোদিন পাওয়া যাবে না।
ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে বৃহস্পতিবার রাতের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছে বুয়েটের এই শিক্ষার্থীর। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী বন্ধু লামিশা ইসলাম। দুজনে একসঙ্গেই ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন।
চার বছর পরপর আসা লিপইয়ারের দিনটাকে ফের দেখতে পাবেন কিনা প্রশ্ন রেখে সমাাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে পোস্ট করেছিলেন নাহিয়ান। দেখা আর হলো না। বাবা, মা আর একমাত্র বোনসহ বন্ধু-স্বজনদের কাঁদিয়ে অকালে মৃত্যু হলো তার।
বরিশাল নগরীর পলিটেকনিক রোডের বাসিন্দা রিয়াজুল কবিরের ছেলে নাহিয়ান। শুরুতে ছেলের মৃত্যুর খবর না জানলেও নাহিয়ানের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর তারা জানতে পারেন। দুই ভাই বোনের মধ্যে নাহিয়ান ছিলেন ছোট।
নাহিয়ানের বন্ধু আবির শাহরিয়ার জানিয়েছেন, তারা দুজন দুজনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতেন। বন্ধুর চলে যাওয়াতে কে এখন তার সব সমস্যার সমাধান করবেন, কার সঙ্গে সব খুনসুটি করবেন, বলে হাহাকার প্রকাশ করেন আবির।
আবির শাহরিয়ার জানান, নাহিয়ানের সঙ্গে ‘এসো প্রবলেম সলভ করি’ গ্রুপ থেকে পরিচয়। এরপর থেকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কতো যে কথা। একে অপরের প্রবলেম সলভ করে দেওয়া। তারপর একসঙ্গে ভর্তি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া।
এরপর দুজনেরই বুয়েটে ভর্তির সুযোগ হলো জানিয়ে শাহরিয়ার বলেন, দুজনই ছিলেন ট্রিপল-ই অর্থ্যাৎ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শিক্ষার্থী, তাও আবার একই সেকশনে। নাহিয়ান সব সময় তার পেছনের সিটেই বসতেন।
নাহিয়ানের মৃত্যুর কয়েকদিন আগে সবশেষ তারা একসঙ্গে ক্যান্টিনে বসে গ্রিল খেয়েছেন জানিয়ে আবির বলেন, “এই গ্রিল এই জীবনে মুখে তুলতে পারবো না আর। এত বড় হয়ে গেলাম কখনও চোখের সামনে মৃত্যু দেখি নাই। দেখলাম তো দেখলাম, নিজের বন্ধুরটাই!”
আবির বলেন, “গতরাত (বৃহস্পতিবার) পৌনে ১২টার দিকে নিজেদের গ্রুপে আরেক বন্ধু নাহিয়ানের খোঁজ নিচ্ছিলেন। শুরুতে ভাবলাম এমনিই খুঁজছে হয়ত। পরে যখন জানলাম নাহিয়ান আর লামিশা দুজনই নিখোঁজ, টনক নড়ল। ১২টার দিকে সবাই বেরিয়ে পড়লাম।
“আমি আর উচ্ছ্বাস সোজা ডিএমসি জরুরি বিভাগে। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানলাম সবাইকে নেওয়া হচ্ছে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে। দৌঁড়ে সেখানে গেলাম। ভেতরে গিয়ে ঘুরে এসে উচ্ছ্বাস কনফার্ম করল- লামিশা ভেতরেই আছে। সবাইকে জানালাম। রাত ঠিক ১২টা ২১মিনিট তখন। নিজে গিয়ে আবার ডাবল চেক করে আসলাম। কিন্তু তখনও নাহিয়ানের কোনও খোঁজ নেই।”
এরপর আবির বলেন, “এর মাঝে খবর পেলাম নাহিয়ানের ফোনের লাস্ট লোকেশন সিদ্ধেশ্বরী লেনে। সবাই চারদিকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম। আমি আর উচ্ছ্বাস ভাবলাম শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটেই থাকি। একজন একজন করে আহতদের আনা হচ্ছে; তাদের মাঝে নিজের বন্ধুকে খুঁজছি।
“এর চেয়ে ‘পেইনফুল’ কিছু হয়ত এই জীবনে ‘এক্সপেরিয়েন্স’ করা সম্ভব না। ঠিক ১২টা ৪৭ মিনিটে একটা বডি ঢোকানো হচ্ছিল। আমি আর উচ্ছ্বাস একজন আরেকজনের কাঁধে হাত দিয়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের বন্ধু নাহিয়ান!”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবির বলেন, “দেখেই বুঝতে পারলাম, অবস্থা ভালো না, সবাইকে জানালাম। ভেতরে গিয়ে কয়েকবার দেখেও আসলাম। ঠিক ১০ মিনিট পরেই জানানো হলো, নাহিয়ান আর নেই। চোখের সামনে মৃত্যু এটাই প্রথম! নাহিয়ানের বড় আপুকে ফোনে জানালাম, নাহিয়ান আর নেই। এমন নিউজ কীভাবে দিতে হয়, আমার জানা ছিল না।”
প্রিয় বন্ধু ক্লাসে আর পেছনের সিটে বসবে না- এই আক্ষেপ জানিয়ে আবির বলেন, “আর আমার খবর নিবে না। একসঙ্গে আর গ্রিল খাওয়াও হবে না। জীবন কেমন জানি বিষাদময় লাগছে। ইসির ৯২১ নাম্বার রুমের সেই চেয়ার খালিই থাকবে। আমি থাকতে কাউকে বসতে দিচ্ছি না ওখানে। ঢাকা শহরের প্রতি যত মায়া ছিল, আর নাই। জাদুর শহরের সব জাদু আজ বৃথা।”
নাহিয়ানের সঙ্গে মারা যাওয়া তার বন্ধু বুয়েটের শিক্ষার্থী লামিশা ইসলাম ছিলেন পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নাসিরুল ইসলামের মেয়ে।
জানা যায়, নাসিরুল ইসলামের দুই মেয়ের মধ্যে লামিসা ছিলেন বড়। ২০১৮ সালে অসুস্থতার কারণে তার স্ত্রী মারা যান। এর পর থেকে দুই সন্তানকে একাই লালন-পালন করছিলেন তিনি।
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের। তাদের মধ্যে ৪১ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে, স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৩৮ জনকে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আছেন ১০ জন। তবে তারা কেউ শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।