সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি আদায়ে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের এখনকার আন্দোলন এগিয়ে নিতে সমন্বয়ক টিম পুনর্গঠন করেছে।
এই প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১৫৮ সদস্যের সমন্বয়ক টিম গঠনের কথা জানানো হয়েছে।
এই দলে ৪৯ জন রয়েছেন সমন্বয়কের দায়িত্বে। এছাড়া সহ সমন্বয়ক রয়েছেন ১০৯ জন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নির্মমভাবে চালানো গণহত্যার বিচার, গণহত্যায় দায়ীদের পদত্যাগ এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৫৮ সদস্য বিশিষ্ট সমন্বয়ক টিম গঠন করা হলো।”
হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে কথা বলে এই বিজ্ঞপ্তির সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে আন্দোলন কর্মসূচি ৭ দিনের জন্য স্থগিত করার যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ঘুরছে সোশাল মিডিয়ায়, তা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন হাসনাত।
এর আগে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা অবস্থায় ছয় সমন্বয়কের আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের যে ভিডিও বার্তা এসেছিল, তাও উড়িয়ে দিয়েছিলেন বাইরে থাকা সমন্বয়করা।
পরে ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়ে ছয় সমন্বয়ক বলেছিলেন, ওই বার্তা দিতে তাদের বাধ্য করা হয়েছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের ৯ দফা দাবিতে শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক এরই মধ্যে দিয়েছে। এরপর রবিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাকও দিয়েছে তারা।
আন্দোলনকারীদের মিছিল-স্লোগানে সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠলেও তাদের ৯ দফায় তা নেই।
৯ দফায় যা রয়েছে
>> ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে সরকার প্রধানকে।
>> আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসী কর্তৃক ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেশে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে পদত্যাগ করতে হবে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে ‘ড্রাগ এডিক্টেড’ বলে এবং আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতকে পদত্যাগ করতে হবে।
>> ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র-নাগরিক নিহত হয়েছে, সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে।
>> ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা হয়েছে, প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টরদেরকে পদত্যাগ করতে হবে।
>> যে পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ও সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করেছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগের যারা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা পরিচালনা করেছে এবং যেসব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে, তাদেরকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে।
>> দেশব্যাপী যেসকল ছাত্র-নাগরিক নিহত এবং আহত হয়েছে, তাদের পরিবারকে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
>> দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগসহ দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দ্রুততম সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ কার্যকর করতে হবে।
>> অবিলম্বে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলগুলো খুলে দিতে হবে। কারফিউ তুলে নিয়ে সারাদেশের সমস্ত ক্যাম্পাসে মোতায়েনকৃত পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াট এবং আর্মি তুলে নিতে হবে।
>> বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কোনও ধরনের হয়রানি করা হবে না- এই মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে। ছাত্র-নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে ও তাদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল করে গত জুন হাইকোর্টের রায়ের পর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে।
আন্দোলনের সূচনায় গত ৯ জুন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে প্রথম সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ব্যানার বদলে হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
শুরুতে আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র হয়ে সামনে আসতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম। তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি নামে একটি সংগঠনের সদস্য সচিব।
২০১৮ সালে যে আন্দোলনে চাকরিতে নিয়োগে কোটা বাতিল করেছিল সরকার, সেই আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরের সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে একটি অংশ বেরিয়ে এই সংঠনটি গড়ে তোলে।
নুর নেতৃত্বাধীন ডাকসুতে ছাত্র অধিকার পরিষদের আখতার হোসেন সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। আখতার পরে নুরের দল থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি গঠন করেন। তিনি হন সংগঠনের আহ্বায়ক। আখতারকে গত ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ সমন্বয়কদের আরেকজন আসিফ মাহমুদও ছাত্র শক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি।
শীর্ষ সমন্বয়কদের মধ্যে সারজিশ আলম এক সময় ছাত্রলীগে যুক্ত ছিলেন। তবে দুই বছর আগে সংগঠনটি থেকে বেরিয়ে আসেন বলে তিনি দাবি করে আসছেন।
আন্দোলনের শুরুতে নাহিদের মাধ্যমে কর্মসূচি এলেও পরে সমন্বয়ক টিমে সদস্য বাড়ানো হয়। এক পর্যায়ে ৬৫ জনের কথা জানানো হয়েছিল।
গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালালে তা সহিংসতায় গড়ায়।
পরদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়। ১৮ জুলাই সংঘাত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এরপর কয়েকদিনে দুই শতাধিক নিহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার।
এরই মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় সব ধরনের সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারর করে সরকার। ৫৬ শতাংশ থেকে কোটার অনুপাত নামিয়ে আনা হয় ৭ শতাংশে।
এরপর আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৯ দফা দাবি তুলে তা আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
তারই ধারাবাহিকতায় সমন্বয়ক টিম পুনর্গঠন করা হলো। এই সমন্বয়কদের মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজের তিন শিক্ষার্থী সমন্বয়ক হিসাবে রয়েছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকািরি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমন্বয়ক রয়েছে।
সহ সমন্বয়কদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। তবে এই ১০৯ জনের বেশিরভাগই ঢাকার।