৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্বে জড়িয়ে এই বাড়ি; ৭১ এর অগ্নিগর্ভ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উঠেছিল এই বাড়িতেই; এই বাড়ি থেকেই এসেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের উল্টোযাত্রার ইতিহাসেও জড়িয়ে এই বাড়ি, এখানেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ককে। তারপর গণতন্ত্র ফেরার লড়াইয়ের সাক্ষী হয়েও থেকেছে এই বাড়ি।
বাংলাদেশের ইতিহাসের কোনও পর্বে বিচ্ছিন্ন ছিল না এই বাড়ি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আগুনে পুড়ে নতুন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বলা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’রও অংশ হয়ে গেল বাড়িটি।
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের কালের সাক্ষী এই বাড়ি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তার এই দোতলা বাড়ি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অধীনে জাদুঘর হয়েই ইতিহাস জানাচ্ছিল সবাইকে।
আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর ক্ষোভের আগুনে আওয়ামী লীগের কার্যালয়, দলটির বিভিন্ন নেতার বাড়ির পাশাপাশি পুড়তে হয়েছে ৩২ নম্বরের বাড়িটিকেও।
তার এক সপ্তাহ পর এই বাড়ির সামনে গেলে বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল এক ব্যক্তিকে। পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, তার নাম মো. আলমগীর। তিনি মিরপুরের শাহ আলী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
গত ৫ আগস্ট এই বাড়িতে হামলার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন তিনি।
“এসে দেখি সব দাউ দাউ করে জ্বলছে। চোখের সামনে সব পুড়ে গেলেও কিছুই করতে পারিনি আমি। সারা জীবন এই কষ্ট বয়ে বেড়াতে হবে আমাকে।”
আক্ষেপ প্রকাশ করে করে আলমগীর বলেন, “যে বাড়িতে থেকে বঙ্গবন্ধু এই দেশটা স্বাধীন করেছেন, যে বাড়িতে তিনি প্রাণ দিয়েছেন, সেই বাড়ি এভাবে ধ্বংস করা হবে কল্পনাও করিনি। বাড়িটির বর্তমান অবস্থা দেখে রাতে ঘুমাতে পারি না। তাই প্রতিদিন সকাল হলেই ছুটে আসি।”
বাড়িটির সামনের সড়কে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে এখন শিক্ষার্থীরা। কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ঢোকা গেল। তবে পুড়ে যাওয়া ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিল শিক্ষার্থীরা।
ব্যরিকেড পার হওয়ার পর চোখে পড়তে শুরু করে ধ্বংসের চিত্র। বাড়ির সামনের সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে পুড়ে যাওয়া বাঁশ-কাঠ। বাড়ির আশপাশের সব গাছপালাও পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে লেকের পাড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
যে প্রতিকৃতি এক সময় ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকত, তার সামনে দেখা গেল একটিমাত্র ফুলের তোড়া। কে কখন এটি রেখেছে, তা বলতে পারলেন না কেউ।
ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বাড়ির নিচতলায় চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি প্রতিকৃতি। এটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভবনের বাইরেও সবখানেই পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন। আগুনের তাপে বিভিন্ন স্থানে খসে পড়েছে দেয়ালের আস্তর।
ভবনের ভেতরে সবখানেই ছাইয়ের স্তুপ, ভাঙা কাচ, পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্র নানা কিছু। যে সিঁড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেই সিঁড়িতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাচের টুকরা আর ছাই। তবে সিঁড়ির দেয়ালে এখনও রয়ে গেছে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বুলেটের চিহ্ন।
রক্ষা পায়নি বাড়ির পেছনে থাকা কবুতরের খোপ ও গ্যারেজে রাখা কোনও গাড়ি। সবকিছুই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের পাশের অবস্থিত তার কার্যালয়ও রক্ষা পায়নি লুটপাট, ভাঙচুর আর অগ্নিকাণ্ড থেকে।
‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে’ এখন প্রায় ৭০ জন নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবী নিরাপত্তা দেওয়া ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। এছাড়া আর প্রায় ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী অনিয়মিতভাবে তাদের সহায়তা করছেন। তারা সবাই শিক্ষার্থী।
নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সৈয়দ তন্ময় তানসেন স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে গত ৬ দিন ধরে বাড়িটির নিরাপত্তায় কাজ করছেন।
তিনি জানান, গত ৫ আগস্ট একদল লোক বাড়িটিতে হামলা চালিয়ে লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলার সময়ও তারা কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে ঐতিহাসিক বাড়িটি রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় কম হওয়ায় হামলাকারীদের আটকাতে পারেননি।
ভবনের লিফটও লুট হওয়ার তথ্যটি জানিয়ে তন্ময় বলেন, “লিফটের মতো এত বড় একটা জিনিস কীভাবে খুলে নিয়ে যায়! সেটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না।
“শুধু লিফট না, লুটপাটকারীরা যা পেরেছে সবই নিয়ে গেছে, যা নিতে পারেনি পুড়িয়ে দিয়েছে। সারা বাড়িতে শুধু কাঠের একটা ওয়ার্ডরোব ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।”
বাড়ির ভেতরে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছিলেন বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী নাইম রহমান। তার বাড়ি কলাবাগান হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই বাড়িটি তার চেনা।
নাইম বলেন, “যে বাড়ি দেখতে দেখতে বড় হয়েছি, সেই বাড়ির এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছি না আমি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের ওপর রাগ করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির ওপর হামলা চালানো খুবই অন্যায় হয়েছে।
“বর্তমানে আওয়ামী লীগ যাই করুক, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দিতেই হবে।”
মোহাম্মপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী শেখ রেদোয়ান ইসলাম বলেন, “আমরা বাড়িটির নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি পরিষ্কারও করছি। বাড়ির সামনে থাকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিটি রঙ-তুলি দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করছি, যেন কেউ চাইলে সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।”
শিক্ষার্থীরা জানান, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে প্রথম ছুটে এসেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। এরপর থেকে প্রতিদিনই একাধিকবার আসেন।
জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে তানজীম আহমেদ সোহেল তাজও মঙ্গলবার গিয়েছিলেন বাড়িটিতে।
তিনি বলেন, “আমি এটা কোনও অবস্থাতেই মেনে নিতে পারি না যে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য…কারণ বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। তিনি বাংলাদেশের সম্বল, বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের আলোকে এবং মোড়কে প্রিজার্ভ (সংরক্ষণ) করে রাখতে হবে।”
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ধানমণ্ডির এই ১ বিঘা জমি তখনকার ৬ হাজার টাকায় তাকে বরাদ্দ দেয় সরকার। সেই জমিতে দুই কক্ষের একটি একতলা ভবন করে ১৯৬১ সালে পরিবার নিয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তখন একতলা বাড়ির দুটি কক্ষ মিলিয়ে তার পুরো পরিবার থাকত। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় তলা নির্মাণ হয়। নিচতলার কক্ষটি তিনি গ্রন্থাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন। ছোট একটি কক্ষ ব্যবহার হতো ড্রইং রুম হিসাবে। নিচ তলায় আর ছিল একটি রান্নাঘর।
বিশাল এই রাজনীতিকের এই ছোট বাড়িতে যাননি, তখনকার রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন মানুষ খুব কমই আছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু এই বাড়ি থেকেই গিয়েছিলেন। ৭ মার্চের পর সম্ভাব্য স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বাড়িটিই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তার আগে আগে এই বাড়ি থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
মুক্তিযদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িটি দখল করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু পরিবারকে ধানমণ্ডিরই অন্য একটি বাড়িতে বন্দি রেখেছিল। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর পরিবার নিয়ে আবার এই বাড়িতে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি সরকারি বাড়িতে ওঠেননি।
ধানমণ্ডির পুরনো ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির কাগজে কলমে নম্বর এখন ১০, সড়ক নম্বরও বদলে হয়েছে ১১। তবে এখনও সবাই ৩২ নম্বর বললেই বুঝে নেয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে এই বাড়িতেই সেনাবাহিনীর একদল সদস্য ও কর্মকর্তা ঢুকে সপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেও জিয়াউর রহমানের শাসনকালে প্রথমে বাড়িটিতে ঢুকতে পারেননি। কারণ ঋণ নিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; সেই কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছিল সামরিক সরকার। সেই ঋণ পরিশোধের পর ওই বছরই বাড়ির মালিকানা ফিরে পান শেখ হাসিনা।
তবে তখন ওই বাড়িটি রাজনৈতিক কার্যালয় হিসাবেই ব্যবহার করতেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি থাকতেন স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার পাওয়া সরকারি বাড়িতে।
৩২ নম্বরের বাড়িটি ফিরে পাওয়ার পর শেখ হাসিনা একে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে বাড়িটি জাদুঘর হিসাবে যাত্রা শুরু করে। তখনই এটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০১১ সালে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে জাদুঘরটি সম্প্রসারিত করা হয়।
এবার ধ্বংসের পর বাড়ির সামনে পাওয়া গেল বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সহকারী কিউরেটর কাজী আফরিনকে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত কোনও জিনিসই আর অবশিষ্ট নেই এখন। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত যত জিনিসপত্র ছিল, সবই লুট কিংবা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
“এখন তো আমাদের এখানে কিছু করার নেই। তারপরও প্রতিদিনই আসছি মায়ার টানে।”
“কী দোষ ছিল এই বাড়ির”- এই প্রশ্ন রেখে আফরিন বলেন, “আমরা চাই বর্তমানে বাড়িটি যেভাবে আছে, সেভাবেই সংরক্ষণ করা হোক। যাতে যিনি বাংলাদেশে স্বাধীন করতে এত অবদান রেখেছেন, তার স্মৃতির সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, সেটা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে।”