Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

কলাম

ওয়ারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও চট্টগ্রামের সংগ্রামী ভূমিকা

২৬ মার্চ সকাল আটটার মধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলায় ওয়্যারলেসযোগে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের লোকজনের কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা পৌঁছে গিয়েছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতি জেনে এসেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার আগেই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর সেই ঘোষণা ওয়্যারলেস এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে প্রচারিত হওয়ার পর সর্বস্তরের মানুষ প্রবল উৎসাহ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে স্বপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানারকম রাখঢাক শুরু হয়। বিশেষ করে সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে বই-পুস্তকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে অস্বীকার এবং বিকৃত তথ্য সংযোজন করার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করি। প্রসঙ্গত, ১৯৭৭ সাল থেকে আমি একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করছিলাম। এক পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিকৃত ইতিহাস সম্পর্কে নতুন প্রজন্মসহ নানান জনের নানা প্রশ্নে আমি নিজেই অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। ফলে স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের জবাব দেওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে উঠি।

এ প্রসঙ্গে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করে জানতে পারি, ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধ এবং চট্টগ্রাম মুক্ত করে কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ আসে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ তথা চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

মুক্তিযুদ্ধের সেই সূচনাকালে জাতীয় সংগ্রামে বীর চট্টলার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। চট্টগ্রামের যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত তাদের মধ্যে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ মান্নান, এম এ হান্নান, ডা. এম এ মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. জাফর আহমদ, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুণ চৌধুরী, মীর্জা আবু মনসুর, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী প্রমুখ। শুরু থেকে তাঁরা সবাই এক সঙ্গে এক জায়গায় বসে কাজ করছিলেন এমন নয়। একদল এম আর সিদ্দিকীর বাসভবনে, একদল আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবনে, আবার কেউ কেউ জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় এবং কেউ কেউ হাজারি গলিস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে বসে কৌশল নির্ধারণ করছিলেন। কারণ তখনকার সময়ে এখনকার মতো মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটের মতো সহজ কোনো যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। টিঅ্যান্ডটি টেলিফোনও ছিল হাতে গোণা। এক এলাকা থেকে আর এলাকায় সংযোগ পেতে কখনো কখনো অপেক্ষা করতে হতো ঘন্টারও বেশি সময়। এরই মধ্যে প্রত্যেক গ্রুপ অপর গ্রুপকে খোঁজ করে ঘটনাবলী পর্যালোচনা ও সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় কে, কখন, কার আগে, কার সঙ্গে, ঠিক কয়টায়, কার বাসায় বা কোন স্থানে দেখা পেয়েছিলেন, কার সঙ্গে কোন কথাটি হয়েছিল-ঠিক কোন মুহূর্তে, তা সুনির্দিষ্ট বা স্পষ্টভাবে বলা সম্ভব হওয়ার কথা নয়।

তবে ইতিমধ্যে প্রকাশিত নানা তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এম আর সিদ্দিকীর বাসায় ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি ও এখানকার করণীয় বিষয় নির্ধারণের এক পর্যায়ে নেতাদের একদল তৎকালীন সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় যান। সেখানে আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে রাত আনুমানিক ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পেয়ে নেতাদের কেউ কেউ যান পাথরঘাটাস্থ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বাসা জুপিটার হাউসে। এম এ মান্নান ও এম এ হান্নান যান হাজারি গলির বিনোদা ভবনস্থ সিটি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। এ দুজায়গায় উপস্থিত ছাত্র ও যুব নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ঘোষণার বাংলা অনুবাদসহ প্রচুর পরিমাণ সাইক্লোস্টাইল কপি করিয়ে শহরময় শুরু করা হয় মাইকিং ও ঘোষণার কপি বিলি। ওয়্যারলেস কর্মী, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ ও সংগ্রাম পরিষদের সাথে যুক্ত মুক্তিকামী জনতার মুখে মুখে রাতের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। আর যে বা যারা ঘোষণার কপি পেয়েছেন তিনিই হয়তো মনে করেছেন এটি বোধ হয় তিনি বা তারাই আগে পেয়েছেন। এ অবস্থায় নেতা-কর্মীদের রাত কাটে নির্ঘুম। মধ্যরাতে অধিকাংশ নেতা-কর্মী জড়ো হন জুপিটার হাউসে। খোঁজ নিয়ে যতদূর জানা গেছে, আখতারুজ্জামান বাবুর বাসায় আলোচনার সময় অন্যদের মধ্যে এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, ডা. এম এ মান্নান এমপি, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, মীর্জা আবু মনসুর, রাখাল চন্দ্র বণিক, আতাউর রহমান খান কায়সার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তখনো সবাই জানতেন না যে, বঙ্গবন্ধু কোথায় কি অবস্থায় আছেন।

সেখানে সিদ্ধান্ত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাটি বেতারের মাধ্যমে জনগণকে জানানো প্রয়োজন যাতে জনগণ হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে পারে। স্থির হয়, জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী ও এম আর সিদ্দিকীসহ চট্টগ্রামের তৎকালীন এমপিদের মধ্যে যাঁরা শহরে আছেন তাঁরা একযোগে বেতার কেন্দ্রে যাবেন এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পক্ষে জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণাটি বেতারে প্রচার করবেন। তবে পরবর্তীতে শারীরিক কারণে জহুর আহমদ চৌধুরী বেতার কেন্দ্রে যাননি। সকাল ৯টা ১০টার দিকে নেতা-কর্মীরা আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন (পরবর্তীতে মন্ত্রী) এবং আগ্রাবাদ থেকে আসা কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল হালিম। তাঁর হাতেও আগ্রাবাদ এলাকায় সকালে বিলি হওয়া স্বাধীনতার ঘোষণার একটি কপি ছিল যা তিনি এমএ হান্নানের হাতে দেন। তাঁরাসহ ডা. এমএ মান্নান, এম এ হান্নান, মীর্জা আবু মনসুর, ছাত্রলীগ নেতা শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, রাখালচন্দ্র বণিক প্রমুখ আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে পৌঁছেন বেলা প্রায় ১২টায়। আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা ততক্ষণে কাজ বন্ধ করে যার যার জায়গায় চলে গিয়েছিলেন রেডিওতে বাঙালিদের খবর না শোনার কারণে। এম এ হান্নান ও তাঁর সঙ্গীরা বেতার কেন্দ্রে কাউকে না পেয়ে খবর নিয়ে বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসির উদ্দিনকে তাঁর আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি থেকে ডেকে নিয়ে যান কালুরঘাট বেতার সম্প্রচারকেন্দ্রে। এর পরের ইতিহাস এখন মোটামুটি সবারই জানা। ফলে স্বাধীন বাংলা বেতারে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার শুধু নয় আমার আগ্রহ তৈরি হয় ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি কিভাবে আসলো সেটা নিয়েও।

জালাল আহমদ ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানাধীন সলিমপুরস্থ আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অয়্যারলেস স্টেশনে টেলিফোন রেডিও টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে তিনি অন্য সহকর্মীদের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সুমদ্রে অবস্থিত বিদেশী জাহাজ এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে কলকাতা বেতারে প্রেরণ করেছিলেন।

১৯৮৬ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে (তখন আমি দৈনিক স্বাধীনতার সহসম্পাদক ও সম্পাদকের সচিব হিসেবে কর্মরত) একদিন দৈনিক পূর্বকোণের পক্ষে শিশির দত্ত (বর্তমানে এিকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান) জামাল খান রোডস্থ স্বাধীনতা কার্যালয়ে গিয়ে পত্রিকার সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুণ চৌধুরীর কাছ থেকে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। সে সময় আমি পাশে উপস্থিত ছিলাম। আমার কৌতুহল ছিল স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত ব্যাপারটি নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু জানার। কিন্তু হতাশ হলাম। ইতিমধ্যে যে সব সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে তাতে সুস্পষ্ট সন্তোষজনক বক্তব্যের চাইতে আত্মপ্রচারণামূলক বক্তব্যই বেশি আসছে বলে মনে হলো।

অনেকেই জানেন ৭১ এর ২৬ মার্চ ভোর রাত থেকে ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ঘোষণা সম্বলিত একটি সাইক্লোস্টাইল কপি সর্বত্র বিলি হয়েছিল। অনেকেই তা দেখেছেন, পেয়েছেন। কিন্তু সংরক্ষণ করেননি বৈরী সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর রোষাণলে পড়ার ভয়ে। ২৬ মার্চ সকালে পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায় বিলি হওয়া এরকম একটি কপি আমার বড় ভাইও পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৬ এপ্রিল এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আসার পর পরই বাড়িতে থাকা পোস্টার-লিফলেটসহ অনেক মূল্যবান কাগজপত্রের সঙ্গে সেই অমূল্য কপিটিও আমার মা পুড়ে ফেলেছিলেন। এ ছাড়া, ২৬ মার্চ অন্যান্য এলাকার মতো পটিয়ায়ও মাইকের মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা যা আমি নিজে শুনেছি আমার বাড়ি আরাকান সড়কের কাছে হওয়ার সুবাদে। 

এদিকে স্বাধীনতা পারবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর বাণীটি ওয়্যারলেসযোগে এসেছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হলেও তা কিভাবে, কোন কোন উৎস থেকে চট্টগ্রাম বা অন্যান্য জায়গায় পৌঁছেছে এ বিষয়টি তেমন আলোচনা হয়নি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার কয়েক বছর পর কোনো কোনো মহল থেকে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের জাল বিছিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে আড়াল করে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে অপপ্রচার শুরু করে। এ পর্যায়ে শুধু বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের বিষয়টি সামনে আসায় এবং তার আগে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রেরণের  বিষয়টি অস্পষ্ট থাকায় নতুন প্রজন্মেও অনেকেই বিভ্রান্তিতে ভুগতে থাকে। আমি খুঁজছিলাম তেমন একটি সূত্র যা এ নিয়ে সৃষ্ট জট খুলতে সাহায্য করবে।

ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের বিষয়টি আমি সুনির্দিষ্টভাবে প্রথম জানতে পারি ১৯৮৬ সালের প্রথমদিকে পটিয়া থানাধীন গোবিন্দারখীল গ্রামের জালাল আহমদ নামে এক ওয়্যারলেস কর্মীর কাছ থেকে । জালাল আহমদ ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানাধীন সলিমপুরস্থ আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অয়্যারলেস স্টেশনে টেলিফোন রেডিও টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে তিনি অন্য সহকর্মীদের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সুমদ্রে অবস্থিত বিদেশী জাহাজ এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে কলকাতা বেতারে প্রেরণ করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে থাকাকালে অসুস্থতার কারণে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

গোবিন্দারখীল গ্রামে আমার কয়েকজন আত্মীয় রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে জালাল আহমদের সাথে আমার পরিচয় ১৯৮১ সালে, আমি পটিয়া মহকুমা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে। পটিয়া রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বপাশে তার একটা ওষুধের দোকান ছিল। আমারও একটা ওষুধের দোকান ছিল কাছাকাছি। সে সুবাদে আমাদের পরষ্পরের যাতায়াত ও কথা হতো প্রায় সময়।

একদিন স্বাধীনতা দিবস ও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কথা উঠলো জালালের সঙ্গে তাঁর ওষুধের দোকানে। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে জানান যে, তিনি এবং তাঁর অফিসের কয়েকজন সহকর্মী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে প্রথম বহির্বিশ্বে প্রেরণ করেন। জালাল নিজে বাণীটি ফোনে লিখে নিয়ে পরে তাঁর উর্ধতন অফিসারের পরামর্শক্রমে সমুদ্রগামী বিদেশী জাহাজের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে পাঠান বলে দাবি করেন। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল এটি গল্প। কিন্তু না, এক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জের সুরে কথা বলেন তিনি এবং আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে কতগুলো পুরোনো কাগজপত্রের ফাইল বের করে ১৯৭২ সালের মাঝামঝি সময়ে ওয়্যারলেস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তোলা ছবি, জহুর আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী ডা. নুরুন্নাহার  স্বাক্ষরিত সত্যায়িত সনদ এবং অন্যান্য মুল্যবান কাগজপত্র দেখিয়ে আমাকে হতবাক করে দেন। জালাল আহমদ এতো মুল্যবান কাগজপত্র হাতে রেখে চুপ করে বসে আছেন কেন— জানতে চাইলে তিনি আক্ষেপের সুরে বললেন ’৭৫ পরবর্তী সময়ের সরকারের আমলে এগুলো প্রচারের কোনো সুযোগ নেই। বরং এগুলো বেহাত ও ধ্বংসতো হবেই উপরন্তু সত্য কথা বলতে গিয়ে জীবনের নিরাপত্তাও হয়তো থাকবে না।

তাঁর পক্ষে আমি প্রচারের ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালে তিনি সময় হলে প্রচারের জন্য নিজেই আমাকে ডেকে বলবেন এবং কাগজপত্রগুলো দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর মতে, সময় তখন স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের জন্য বৈরী ছিল। তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও তাঁকে উদ্বিগ্ন মনে হলো। আমি লোভ সামলাতে না পেরে বিশেষ অনুরোধ করে কিছু কাগজপত্রের কপি তাঁর কাছ থেকে নিয়ে ফটোকপি করি এবং প্রতিশ্রুতি দেই যে তাঁর আশঙ্কা দূর না হওয়া পর্যন্ত এসব প্রকাশ করব না।

এরই মধ্যে আমি সাংবাদিকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি পটিয়ায় একটি ছাপাখানা স্থাপন করি। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে জালাল সাহেব এসে আমাকে জানান যে একদিন সময় করে তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি আমাকে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দিয়ে দেবেন বলে মনস্থির করেছেন। তাঁকে তখন বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছিল।

নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জালাল আহমদের এক ছোট ভাই আবদুল জলিল (তিনিও তখন সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে চাকরিরত ছিলেন) একটা কাজে আমার কাছে আসেন আমার ছাপাখানার কার্যালয়ে। আমি জালাল সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করি এবং বলি যে, ১৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার অথবা ১৬ তারিখ শুক্রবার সকালে তাদের বাড়িতে যাব জালাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি যেন অনুগ্রহ করে বাড়িতে থাকেন। আমি তাঁর আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করব।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ১৪ নভেম্বর, বুধবার সকালে জালালের আর এক ভাই নুরুল আজিম (চট্টগ্রাম বন্দরে আমার বড় ভাইয়ের সহকর্মী ছিলেন) এসে আমাকে জানান, আগের দিন অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর (১৯৯০) জালাল ইন্তেকাল করেছেন। এর আগের দিন মঙ্গলবার নাকি তিনি আজিম এবং জলিল সাহেবকে আমার সাথে সাক্ষাতের কথা বলেছিলেন এবং তাঁদেরকে কতগুলো কাগজপত্র দিয়েছিলেন আমাকে দেয়ার জন্য। বলেছিলেন আমার সাথে তাঁর দেখা নাও হতে পারে।  সত্যিই আর জালাল আহমদের সাথে দেখা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। যা হোক সঙ্গে সঙ্গে আমি তাদের বাড়িতে যাই এবং অত্যন্ত মর্মাহত চিত্তে তার কাগজপত্রগুলো বেছে বেছে সংগ্রহ করে নিই একটি ময়লাযুক্ত ফিতাবন্দী ফাইল থেকে। এই ঘটনার ৩-৪ দিন পরেই আমি যোগাযোগ করি সীতাকুণ্ড থানাধীন সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে কর্মরত তৎকালীন সহকারী প্রকৌশলী সফিকুল ইসলামের সঙ্গে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওয়্যারলেস স্টেশনের যে সব কর্মচারী ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণীটি গ্রহণ ও প্রচারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে মারা গেছেন। কেউ কেউ অবসর নিয়েছেন, আবার কেউ বদলি হয়ে কাজ করছিলেন অন্যত্র। সফিকুল ইসলামের সূত্রে যোগাযোগ হয় বিভিন্ন স্থানে কর্মরত মাহফুজুল হক, ফজল আহমদ, আবুল কাসেম খান, জুলহাস উদ্দিন প্রমুখের সঙ্গে।

কেউ কেউ মনে করেন স্বাধীনতার ঘোষণা শুধু চট্টগ্রামে তথা চট্টগ্রামস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের অন্তত ১০ ঘন্টা আগে থেকে অর্থাৎ ২৫ মার্চ দিনগত রাত একটা থেকে পরদিন সকাল বেলা পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর মাইকযোগে প্রচার হয়েছে। এ ছাড়া, ২৬ মার্চ সকাল আটটার মধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলায় ওয়্যারলেসযোগে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের লোকজনের কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা পৌঁছে গিয়েছিল।

স্বাধীনতার দীর্ঘ দু’যুগের বেশি সময় পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য সংগ্রহে বেশ সময় অতিবাহিত হয়। কেউ কেউ তথ্য দিতে বা কথা বলতে সম্মত হলেও বৈরী পরিস্থিতির কারণে সবকিছু প্রকাশ করতে এমনকি নিজেদের পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারেও শঙ্কিত ছিলেন তাঁরা। এ পর্যায়ে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে আমার দেড় পৃষ্ঠাব্যাপী একটি অনুসন্ধানী লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে দৈনিক পূর্বকোণে। ১৯৯৪-১৯৯৬ সালের মধ্যে দৈনিক ভোরের কাগজ, বাংলার বাণী, রূপালীসহ বিভিন্ন পত্রিকায় আমার আবিস্কৃত তথ্য-উপাত্ত ও ছবির ব্যাপারে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৯৯৬ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে বের হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু-প্রামাণ্য দলিল’ গ্রন্থ। বইটি ইতিহাস প্রেমী সূধী মহলে সমাদৃত হয়। অনেক লেখক তাঁদের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত লেখা গ্রন্থে প্রমাণ হিসেবে আমার বই থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করেছেন।

ইতিমধ্যে আরও একটা বিষয় লক্ষ করা গেছে যে, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারেও নানান জনের শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে সত্য-মিথ্যার মিশেলে পত্রপত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখালেখি হয়। সেসব লেখায় উল্লেখিত ভুল তথ্য উদ্ধৃত করে প্রকাশিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের কথিত ‘ইতিহাস’ গ্রন্থও। কিছু বই ও পত্র-পত্রিকা পড়ে আমার উপলব্ধি হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল কিছু লেখক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক কম পরিশ্রমে বেতার কেন্দ্র চালু করা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার পর্যন্ত যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা না বলে বা যাচাই না করে কেবল শোনা কথার ওপর ভরসা করে ‘ইতিহাস’ চর্চা করছেন এবং বই লিখেছেন। এসব বইয়ে কিছু মৌলিক বিষয়ে ভুল এবং খণ্ডিত তথ্যই পরিবেশন করা হয়েছে-যা নতুন প্রজন্ম, এমনকি গবেষকদেরও বিভ্রান্তিতে ফেলছে। যেমন কোনো কোনো লেখক সাংবাদিক লিখেছেন, একাত্তরের ২৬ মার্চ বিকেলে বা সন্ধ্যায় তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছেন। সত্য যে জিয়াউর রহমান বেতার কেন্দ্রে গিয়ে ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তা কোনোক্রমেই ২৬ মার্চ নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বেতার সংগঠকদের অনুরোধে— ২৭ মার্চ সন্ধ্যায়। ২৬ মার্চ দুপুরে প্রচার করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান।

কেউ কেউ  মনে করেন স্বাধীনতার ঘোষণা শুধু চট্টগ্রামে তথা চট্টগ্রামস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের অন্তত ১০ ঘন্টা আগে থেকে অর্থাৎ ২৫ মার্চ দিনগত রাত একটা থেকে পরদিন সকাল বেলা পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর মাইকযোগে প্রচার হয়েছে। এ ছাড়া, ২৬ মার্চ সকাল আটটার মধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলায় ওয়্যারলেসযোগে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের লোকজনের কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা পৌঁছে গিয়েছিল। সরল বিশ্বাসে ভুল ও খণ্ডিত তথ্য সংবলিত লেখা কথিত ‘ইতিহাস’ উদ্ধৃত করে আরও লেখালেখি এবং নতুন প্রজন্মের কাছে যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে তাও ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর।

এসব উপলব্ধি থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য ও বিশিষ্ট জনদের বিশ্লেষণ পর্যালোচনাসহ স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা গ্রহণ ও প্রচারের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আরও একাধিক ওয়্যারলেস কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি। এ ছাড়া, বেতার কেন্দ্রের সূচনাকালীন ও পরবর্তী সংগঠক, ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত একাধিক অনুষ্ঠান ঘোষক, বেতার প্রকৌশলী এবং প্রচারিত ঘোষণার কপি অনুবাদে যুক্ত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। সব কিছুর সমন্বয়ে নতুন প্রজন্মসহ সর্বস্তরের জনমনে বিভ্রান্তি দূরীকরণ এবং স্বাধীনতা ঘোষণার প্রকৃত ইতিহাস রচনায় এ নিবন্ধ সহায়ক হবে বলে আমার একান্ত বিশ্বাস। 

লেখক : বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, ফেলো বাংলা একাডেমি, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক— ইতিহাসের খসড়া,  জীবন সদস্য— বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী কেন্দ্রীয় পর্ষদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত