Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

শতবর্ষী দুই মানপত্রে বাঙালি বিয়ের হারানো সংস্কৃতি

ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে উত্তরের রংপুর দিনাজপুরসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের মানপত্র পাঠ ও বিতরণের প্রচলন ছিল।

বহু বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি। বাংলার জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোষ্ঠী (নৃগোষ্ঠী), শ্রেণি, স্থান (গ্রাম ও নগর) ও অঞ্চল বিশেষে মানুষের যাপিত জীবনে বহুরূপের চর্চা এই সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যমাধুর্যে পরিপূর্ণ করেছে। তবে চলমান কালের ধারায় যেমন সংস্কৃতির রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে; তেমনি যোগ বিয়োগের খেলায় অনেক নতুন উপাদান যুক্ত হওয়ার সাথে সাথে পুরাতন অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গন থেকে। অনিবার্য এই পরিণতিকে ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কারও নেই; তবে সেই হারিয়ে যাওয়া বা লুপ্ত প্রায় সংস্কৃতির উপাদানগুলিকে তুলে ধরে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস আমাদের নাগরিক দায়িত্ব।

          আমাদের লোক সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়ের সময় বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের যে লৌকিকতা তা পালনের সময় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের মেয়েলি গীত ও নাচ আমাদের লোকসংস্কৃতিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। এইসব লৌকিক আচার প্রধানত দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা স্থানীয় সংস্কার ও রীতিনীতি কেন্দ্রিক হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা বিভিন্ন ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় সংস্কার এবং অনুশাসন দ্বারা প্রভাবিত। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নগরজীবনে বিয়ের অনুষ্ঠানের বিধি-ব্যবস্থা ও অনুষ্ঠানিকতা পুরনো আচার অনুষ্ঠান থেকে কিছুটা ভিন্ন হলেও গ্রামীণ সমাজ জীবনের আনুষ্ঠানিকতায় আবহমান প্রচলিত রীতি-নীতির প্রাধান্যই বেশি।

          লোকজীবনে বা গ্রাম্য পরিবেশে এখনও বিয়ের অনুষ্ঠান প্রচলিত নিয়ম আচারের প্রতি অধিক যত্নবান, যা পূর্বেও ছিল। তবে অনুমান করা যায় যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশের সাথে সাথে সমাজ জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়ে।

এ সময় বাঙালি বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রচলিত আচার অনুষ্ঠানের বাইরেও তখন আনুষ্ঠানিকতার কিছু উপাদান প্রচলিত হয়— যার অন্যতম বিয়ের আসরে বর বা বধূকে উদ্দেশ্য করে লেখা রঙ্গরস বা কৌতুককর, কখনোবা শুভকামনা বা আর্শীবাদমূলক এক ধরনের মানপত্র পাঠ।

বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের জন্য প্রতীক্ষারত বরযাত্রী, কর্তব্যহীন অতিথি ও অভ্যাগত সুধীজনকে আপ্যায়নের সাথে হালকা বিনোদনের মাধ্যমে ব্যস্ত, নির্ঘুম ও চাঙ্গা রাখার পরিবেশ তৈরি করাই ছিল এমন মানপত্রের মূল উদ্দেশ্য।

সংগ্রহ: পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের সুজিত রায় চৌধুরীর পারিবার

একটি কাগজে মানপত্র বা অভিনন্দন পত্রের ন্যায় গদ্য বা পদ্যে লিখিত কিছু বক্তব্য পাঠ করা হতো এবং পরে তার ছাপানো কপি লিফলেটের ন্যায় বরযাত্রী এবং অতিথি অভ্যাগতদের মাঝে বিতরণ করা হতো। ফলে বিয়ের আসরে কখনও সাহিত্যরস, কখনও করুণ রস, আর কখনোবা হাস্যরসের উদ্দামতায় তুফান ছুটত।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় এই ধরনের ‘প্রীতি উপহার’ বা মানপত্র পাঠ—সাধারণত বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যেই প্রচলিত ছিল। পত্রের ভাষা ছিল সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। তবে কখনও কখনও বাংলা-ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে মিশিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করা হতো শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ ও বিষয়টিকে আরও মজাদার করে উপস্থাপনের জন্য।

          সম্প্রতি বিয়ের মানপত্রজাতীয় শতবর্ষী দুটি পুরাতন নমুনা প্রমাণপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পত্র দুটি উদ্ধার করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের সুজিত রায় চৌধুরীর পারিবারিক সংগ্রহ থেকে।

প্রথম পত্রটির রচনাকাল ১১ই ফাল্গুন ১৩২৩ বঙ্গাব্দ। পত্রটির পাঠ উদ্ধারে প্রতীয়মান হয় যে, এটি রংপুর জেলার শ্যামপুরের কনে শ্রীমতী ননীবালা দাসীর শুভ পরিণয়ে ‘বড় দিদি’র আশীর্বাদ ও শুভকামনার কথামালা। কাব্যিক রসে, পয়ার ছন্দে প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত। বিবাহ বাসর ছিল রংপুরের শ্যামপুর।

সংগ্রহ: পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের সুজিত রায় চৌধুরীর পারিবার

          দ্বিতীয় পত্রটি ৭ই বৈশাখ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দে রচিত। পত্রটি জনৈক ধীরেণ বাবু কর্তৃক তার বন্ধু মোহিনীবাবুর বিয়েতে ‘প্রীতি উপহার’ স্বরূপ রচিত হয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি মিশ্র ভাষায় কাব্যরসে ও ছন্দে একটি বিনোদনমূলক কবিতা রচনার চেষ্টা করা হয়েছে নিছক আনন্দ পরিবেশনের উদ্দেশ্যে। বিবাহ বাসর শ্যামপুর (রংপুর), কিন্তু পত্রটি মুদ্রিত হয়েছে ‘সুকৃতি প্রেস, গাইবান্ধা থেকে গত ১৯/০৪/২২ খ্রিস্টাব্দে।

নমুনা হিসেবে প্রাপ্ত প্রথম মানপত্রটির কবিতা—

শ্রীমতি ননীবালা দাসীর শুভ পরিণয়ে
আমার কথা।

‘‘বসন্তের উহু, কোকিলের কুহু, ঐ বুঝি আজ বাজেরে
সরমের হাসি, মিলনের বাঁশী, তোদের হিয়ায় সাজেরে;
গৌরব—সাঝে মৌন-মাধুরী মাঝে, তোদের বক্ষ নাচায়েরে
অরুণ-আশে, নীরব-ভাসে তোদের পরাণী মিলিলরে।

প্রেমের জ্যোতি-অমরার ভাতি খেলিছে তোদের বয়ানে,
সুপ্তি-স্বপন-শান্তি-বারতা তোদের যুগল নয়ানে,
শুভ-মিলন কর্ম্ম-বাঁধন তোদের কর্ম্ম-জীবনে;
ধর্মের ডোর, ভক্তি গোপনে তোদের জীবন-মরণে।

আর্য্য-মিলন-জীবন-পণ—, তোদের চেতনা জাগাতেরে
দেব-দম্পতি শঙ্কর-সতী তোদের ললাটে রাজেরে।
ত্যাগ স্ত্রোত্র বিশ্ব মন্ত্র আর্য্যসতীর শকতিরে,
নীল-কণ্ঠ ভরিয়া কণ্ঠ আজি হেথা গাহিছেরে।

চির-নির্ম্মল আর্য্য-যুগল একই আত্মা বিরাজেরে
প্রেম-সিঞ্চিত, বাসনা-জিত, সভয়ে বিরহ চমকিরে
সপনের খেলা, শুন্যে চপলা নহে মদিরা আবেশেরে
পুরুষ-প্রকৃতি মানব-আকৃতি সৃষ্টি-মিলন-শেষরে।

বীজ ধর্ম্ম, সাধনা কর্ম্ম কর্ম্ম-বাণী যাহার শেষ
বহু পুরাতন, চির সনাতন সেইত তোদের দেশ
পতির জীবনে সতীর মিলনে সাধনা করিও শেষ
জগৎ নমিয়া লইবে বরিয়া তোদের কর্ম্ম-বেশ।’’

তোর
‘বড়দিদি’

বিবাহ বাসর, শ্যামপুর।
১১ ফাল্গুন, ১৩২৩।

আবার দ্বিতীয় মানপত্রটির কবিতার ভাষা—

মোহিনী বাবুর বিয়ের একটু

আজি আমার যা কিছু আছে
এনেছি তোমার কাছে
তোমায় করি সব দান।
(দ্বিজেন্দ্র)

বসে বসে ভাবছিলেম
কবে তোমার বিয়ে,
সেই শুভদিন আজ এল
জেনেছি letter পেয়ে।

‘Good Fortune এতদিনে
ফুটলো বিয়ের ফুল,
মাঝ দরিয়ায় ভাসতেছিলে
মিললো এখন কুল।

বরাত তোমার খুললো হঠাৎ
জুটল কনে ভাল,
আহলাদেতে দেখ্ছ ভায়া
দিনে চাঁদের আলো।

বিয়েটা প্রথম সুখের বটে
যেন ১০০০০০০০ Bill,
শেষভাগটায় চাপে যেন
ময়দা পেষা Mill.

শুনেছি ভাই—
বউটী তোমার পরেশ পাথর
অশেষ গুণপনা
Iron Like প্রাণটা তোমার
হয়ে যাবে সোনা।

এমন দিনে কাব্যরসে
স্ফুর্ত্তি কর্ত্তে চাই,
কিন্তু—
Weak Brainটা নেহাত নারাজ
বাণীর কৃপা নাই।

যাহোক দোহে সুখে থাক
দেখি নয়ন ভরি,
বন্ধুগণে ভুলে যেওনা
এই request করি।

ভেবে চিন্তে দু-ছত্তরে
লিখলাম কিছু বসি,
Please এইটী তুলে নিও
তাইতে হব খুসী।।’’

তোমার
বীরেণ

বিবাহ বাসর শ্যামপুর
১৩২৯। ৭ই বৈশাখ।

গাইবান্ধা সুকৃতি প্রেস;-
১৯/৪/২২।

ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে উত্তরের রংপুর দিনাজপুরসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের মানপত্র পাঠ ও বিতরণের প্রচলন থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এর ব্যবহার তেমন চোখে পড়ে না।

হয়ত যুগের চাহিদায় এর প্রয়োজন ফুরিয়েছে; কিন্তু আমাদের লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে তার অবস্থান অনভিপ্রেত নয়। তবে আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি চর্চা বিষয়ক প্রকাশিত বইপত্রে এ প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা তেমন চোখে পড়েনা।

লেখক: গবেষক ও লেখক।
ইমেইল: krbarman3535@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত