যুদ্ধের কালে প্রায় সবাই প্রচণ্ড আবেগী ছিল, দেশকে বাঁচাতে হবে, অথবা নিকটজনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে—এরকম কিছু না কিছু; তবে সবাই না। ওই যুদ্ধের কালেও কিছু মানুষ ছিল যারা ঠান্ডা মাথায় সব ভাবত, করত। মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পগুলোতেও মাঝে মধ্যে ঝামেলা হতো, দলীয়, উপদলীয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোন্দল। যে সব মানুষ ওখানে ট্রেনিং নিতে গেছে তাদের বেশিরভাগের জন্য এটা ভাবার বিষয় ছিল না। তাদের বাস্তবতা একটাই, যুদ্ধে যাব। এর বেশি কিছু নয়। শিখিয়ে দাও, অস্ত্র দাও, ফেরার পথ ধরি।
২.
শহীদ নাম ছেলেটার, আসল নাম সবাই খুব দ্রুতই ভুলে গিয়েছিল বোধ হয়। তার নাম ছিল আমজাদ। কিন্তু সে সবার কাছে শহীদ নামেই পরিচিত। ও বলতো, ‘‘দেশ তো স্বাধীন হবেই কিন্তু তারপর যে কী হবে কে জানে। আমি ঐসব দেখতে চাই না। আমি যুদ্ধের মাঠে শহীদ হতে চাই।’’ লোকে নাম জিজ্ঞাসা করলে বলত— শহীদ। ক্যাম্পের প্রশাসন তাকে নিয়ে বোধ হয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ওর মানসিক প্রব্লেম আছে। যাই হোক ছেলে খুব ভালো, সবাই পছন্দ করত। একটা বড় গ্রুপের সাথে যুক্ত করে তাকে ক্যাম্প ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হবে ঠিক করা হয়। কিন্তু এর মধ্যেই এক ঘটনা ঘটে।
৩.
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে একটু দূরেই ছিল নদী, যার অন্য দিকে ছিল একটা পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প। এই নদী দিয়ে রিফিউজি যারা আসত তাদের প্রথমে রাখা হতো রিসেপশন ক্যাম্পে। এদের অনেকে গুলিতে আহত-নিহত হয় ওই পাকিস্তানি মেশিন গান নেস্টের গুলির আঘাতে। সিদ্ধান্ত হয় ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশি সৈন্যদের একটি দল নদী পার হয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করবে। এদিকে গানবোট যদি দেখা যায় বা আসে তাই তাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য একদল মানুষ একটা টিলার ওপর উঠে আওয়াজ করবে একটু দূরে, যেখানে বর্ডার অনেক কাছে, যাতে ওদের খেয়াল ওই আওয়াজের দিকে থাকে। হাজারখানেক মানুষের এক হৈ হৈ পার্টি তৈরি করা হয় আওয়াজ করার জন্য, এদের সাথে জুটে যায় শহীদ— নেতা হিসেবে।
৪.
এতগুলা মানুষ যখন হঠাৎ আওয়াজ শুরু করে তখন চারদিক থেকে লোকজন হয় দৌড়ে আসে দেখতে কী হচ্ছে অথবা ভয়ের চোটে পালায়। হাজারখানেক মানুষের চিল্লামিল্লি কম কথা নয়। এখন গানবোট থেকে না কই থেকে পাকিস্তানিরা একসময় গুলি ছোঁড়ে জানি না। কিন্তু একসময় সব নিরাপত্তার চিন্তা বাদ দিয়ে, কারো কথা না শুনে, টিলার মাথায় উঠে যায় শহীদ। তার হাতে দুটি বাঁশের লাঠি ছিল, সে বাজাতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে। পাকিস্তানিরা লক্ষ্য ভেদ করতে পারত দূর থেকে, শহীদের বেলায়ও মিস হয়নি। এদিকে, ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ যৌথ অভিযান সফল। নদীর ওপাড়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প ফিনিশ। আমাদের সব মিলিয়ে মারা গেছে মাত্র একজন—তার নাম শহীদ। এটা তো জেনেবুঝে মৃত্যুবরণ। এটাকে কী বলে? সে রাতেই ওর বন্ধুরা নদী পার হয়ে দেশের মাটিতে কবর দেয় শহীদকে। কী যে অদম্য ইচ্ছা মানুষের, দেশের মাটিতে ফেরার এমনকি লাশ হবার। (আমার ‘বেঁচে থাকার শব্দ’ উপন্যাসে কিছুটা আলাপ আছে এই শহীদকে নিয়ে)
৫.
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘ইচ্ছামৃত্যু’ শব্দটাই বোধহয় মানায় বেশি। যে বয়স্ক গ্রামীণ মহিলা—যার ছেলেটা মারা গেছে রাজাকারের হাতে, ভিটা গেছে অন্য কারও হাতে, কিন্তু যে তবুও মাটি ছাড়েনি, যে জলার টানায় থাকে, হাঁস-মুরগি পেলে পেট চালায়— তার মৃত্যুটা কী ছিল? যে যোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়, যে তার পেলে পুষে রাখা সব প্রাণি জবাই দিয়ে ওদের খাওয়ায় যেন তারা নিজের সন্তান, সে কি জানত না কী হচ্ছে, সে কী করছে? সে কি জানত না তার পেটচলার পথগুলা বন্ধ হচ্ছে? ওই যোদ্ধা দলের দুই জন যুদ্ধের পর ফিরে গিয়েছিল তার খোঁজ নিতে। কিন্তু একটা শুকিয়ে যাওয়া লাশ ছাড়া কিচ্ছু পায়নি। এটা কি ছিল আপনারাই ভেবে নিয়েন, তবে এটাই আমাদের একাত্তর।
৬.
একাত্তরে শহীদ হওয়ার বাসনা কিংবা এমন ইচ্ছামৃত্যু তো ছিলই। একাত্তরের পর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমরা জানলাম ‘সুইসাইড খাওয়ার’ কথা। যুদ্ধের কয়েক বছর পরের ঘটনা। আমরা তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ছেলে মেয়েরা বিশেষ করে ছেলেরা ডানে বাঁয়ে প্রেমে পড়ে আর ছ্যাঁকা খায়। আমার ধারণা বেশিরভাগই ছিল কাল্পনিক প্রেম, ওয়ান সাইডেড প্রেম। কিন্তু তাতে কি, আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম না! তাই এই সব পোলাপান অনেকে ‘সুইসাইড খায়’। অর্থাৎ ট্যাবলেট খায় মরতে। তেমনি এক কাণ্ড করে বসে আমাদের এক শান্তশিষ্ট নিরীহ বন্ধু। অথচ সে যে প্রেম করে এটাই কেউ জানত না। যাই হোক, আমরা খবর পেলাম এবং আমাদের কয়েকজন তাকে দেখতে গেলাম।
৭.
মেডিক্যাল কলেজে তাকে পাওয়া গেল, কিন্তু তার আগে এলেন এক নার্স আপা। বললেন, ‘‘এই যে ভাইয়ারা, আসেন আমার সাথে। আপনাদের বন্ধুর হালটা একটু দেখে যান।’’ সবাই ভয়ে ভয়ে ভেতরে গেলাম। দেখি এক বেডে শুয়ে আমাদের বন্ধু কাতরাচ্ছে। আমাদের দেখে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো। বলে, ‘‘দোস্ত, পেট ওয়াশ করসে, আল্লাহ রে মইরা যামু, এতো কষ্ট। আমি আর কোনওদিন সুইসাইড খামু না, খামু না।’’ এইটা বলে আবার কাঁদতে লাগলো। আমরা চলে এলাম। নার্স আপাটা জিজ্ঞাসা করল, ‘‘দেখলেন? সুইসাইড করতে গেলে কী হয়?’’ আমরা কাঁচু মাঁচু চেহারা নিয়ে মাথা নেড়ে বের হয়ে এলাম। পরে প্রেমে করেছে অনেকে, ছ্যাকাও খেয়েছে অনেকে। কিন্তু কেউ সুইসাইড খায় নাই।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক।
ইমেইল: [email protected]