বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় কাঠামোগত বিন্যাসে ধারাবাহিক পরিবর্তন যে ঘটে চলেছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শোষণের ধরা-বাঁধা তত্ত্ব দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা যায় না। রাষ্ট্রক্ষমতায় নির্দেশনার গুণগত হেরফের দিয়েও নয়। পঁচাত্তরে উৎপাদন কাঠামোয় কিছু মৌলিক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই বছরে ১৫ই আগস্টে হৃদয়বিদারক বিধ্বংসী কাণ্ডে তার অপমৃত্যু ঘটে। পরে রাষ্ট্রক্ষমতা যখন-যেমন-যার হাতেই থাক, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রায়োগিক নীতিমালায় বাঁক বদলের সুনির্দিষ্ট লক্ষণ কিছু চোখে পড়েনি। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অন্য একটি বিষয়ও খেয়াল করার। পঁচাত্তরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কার্যকর রূপ উন্নয়নকামী গরিব দেশগুলোর সামনে যথেষ্ট প্রেরণাসঞ্চারী ছিল। উৎপাদন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাবার দিকনির্দেশনা তা থেকে আসত। এখানে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পর বাংলাদেশের মরিয়া হয়ে বিকল্প পথ খোঁজা ছিল তাই খুবই স্বাভাবিক। শোষণহীন সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও বিধিবদ্ধ আমাদের অনুমোদিত সংবিধানে। তাই আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সর্ববাদিসম্মত একক নেতৃত্বে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ও ব্যবহারের উদ্যোগ ছিল তখন জরুরি ভিত্তিতে এক প্রাথমিক উপায়। সংসদে অবশ্য এ প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল, উৎপাদন ও বণ্টনে শৃঙ্খলা-সামঞ্জস্য ফিরে এলে এবং অর্থনীতি গতিশীল ও উন্নয়নমুখী হলে দেশ আবার বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবে। উৎপাদন ব্যবস্থাও তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবে।
এই উদ্যোগ আর কার্যকর হয়নি। বিশ্ব অর্থব্যবস্থাও পুরোপুরি ব্যক্তিগত উদ্যোগনির্ভর বাজারের দিকে ঝোঁকে। আসলে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার শুদ্ধ কোনো অস্তিত্বই আর কোথাও থাকে না। অবলুপ্তি সব জায়গায় এক সঙ্গে ঘটে না। কার্যকারণের ইতিহাস প্রত্যেককে নিজের নিজের মতো টানে। টানে বাংলাদেশকেও। পাকিস্তানি অভিজ্ঞতায় সমর-নায়কের স্বৈরাচারও যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তা আমরা হাড়ে-হাড়ে টের পাই। এই বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে অথবা তাকে ছায়াসঙ্গী করে আমাদের চলা। সমাজ বদলের অভিযানের কথা আর আমরা বলি না। বলি আপন-আপন জায়গায় থেকে শুরু করে দক্ষতা বাড়াবার কথা। বলি, বিশ্ব-অর্থনীতির কারবারে যে যেখানে আছি— সেখানে থেকেই মোক্ষলাভের পথ খোঁজা। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও খাপ খায় সেইটিই। আমাদের চালাক-চতুর এনজিও গোষ্ঠীও এইভাবে খোঁজে বিশ্বাঙ্গন। সেখানে কেউ কদর পেলে দেশও তাতে ধন্য হয়।
আদর্শগত শূন্যতার জায়গাটা কিন্তু দানা বাঁধতে শুরু করে ওই সত্তরের দশকেই। তবে তার শিকড় ছিল আরো গভীরে। ১৯১৭-এর রুশ বিপ্লবের বিপুল অর্জনের পর বিশ্ব প্রেক্ষাপটেই শোষিত-নিপীড়িত জনগণ সবখানে তাকে মানব মুক্তির ও ইহজাগতিক কল্যাণসাধনের অনুসরণীয় আদর্শ বলে মনে করতে শুরু করে। স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়ায় যে তার প্রতিফলন তেমন চোখে পড়ে না, তার একটি কারণ, মানুষের নশ্বর জীবনে অদৃষ্টবাদ। সেই সঙ্গে যোগ হয় সামষ্টিক জীবনযাপনের অভ্যাসে উত্তমর্ণের অধিকার নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া। এদের অস্বীকার করতে বলা মানে আপন-আপন জায়গায় প্রতিটি বাস্তবে মানুষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূলশুদ্ধ ধরে টান দেওয়া। ইচ্ছা করলেই তাতে ইতিবাচক সাড়া জাগে না। বিশ্বাস ও অভ্যাস বাধা হয়ে দাড়ায়। জীবন প্রত্যেকের আলাদা-আলাদা। চিন্তা ও অনুভবের বৃত্ত যার-যার, তার-তার। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক-সম্বন্ধকে প্রাথমিকতা দিয়ে ইটের পর ইট গেঁথে প্রাসাদ নির্মাণের মতো গড়ে তোলা। তার সম্প্রসারণে ও সমন্বয়ে আকার পায় সামষ্টিক মূল্যমান। মানব সমুদয়কে তা বেঁধে রাখে। বিশ্বাসের অনড়ত্ব তাকে নিশ্চয়তা দেয়। এদের অতিক্রম করে ও দৈনন্দিন জীবনের ছককে অস্বীকার করে সামষ্টিক দ্বান্দ্বিকতার পরিচয়কে অভ্রান্ত মেনে (একার নয়, সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সবার) বেরিয়ে আসার তাত্ত্বিক অনিবার্যতা মেনে নেবার পরেও তাকে কার্যকর রূপ দেওয়া দুরূহ। প্রত্যক্ষের মায়া পথ আগলে দাঁড়ায়। তাতেও থাকে দ্বন্দ্ব-বিরোধ। তবে তারা খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতার কার্যকারণে বাঁধা। তাতে ইতিহাসের ঘটনাক্রমের অভিঘাত বহুবর্ণিল চিত্রপট সাজায়। মানুষ, এক এবং অনেক, সেখানে আত্মস্বরূপের প্রবহমানতায় ইতি-নেতি খোঁজে। হতে পারে তা অন্ধের যষ্টি। যৌক্তিক বিবেচনায় চূড়ান্ত ফলাফলে, অসার। কিন্তু প্রত্যক্ষের অপূর্ণতায় প্রাসঙ্গিক। অতএব দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের যুক্তিশাসিত সমাধান তত্ত্ব প্রত্যক্ষের চলমান বিস্তারে খাপে-খাপে মেলে না। এমন কি যেখানে যৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রায়োগিক সফলতা নিয়ে বড়াই, সেখানেও না। তারপরেও এ যে সম্ভব ও বাস্তব, এই আস্থা অকৃতার্থ মানব সমুদয়ের মনে আশা জাগিয়ে রাখে: যদিও অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়িয়ে কর্মকলায় তার সৃষ্টিশীল পথের রেখা নিজের নিজের মতো বুঝে নেবার চেষ্টা করে। পঁচাত্তরে আমাদের এখানে এক ক্রান্তিলগ্নে এই রকমই এক সাহসী উদ্যোগ মাথা তুলেছিল। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা— দৈশিক ও আন্তর্জাতিক বহুমুখী স্বার্থচক্রের অশুভ আঁতাতে— তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে। গতানুগতিকতা প্রভুত্ব ছড়ায়। বিশ্ববাস্তবতার সঙ্গেও তার সংগতি ক্রমাগত বাড়ে।
সব মিলিয়ে আমাদের পথ চলায় যা দেখি, তা হলো শুরুতে লণ্ডভণ্ড বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডকে গুছিয়ে তোলা, পঁচাত্তরে গোটা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার এক সাহসী উদ্যোগ নেওয়া, ভিন্ন-ভিন্ন স্বার্থের একীভূত চক্রান্তে তা ব্যর্থ হওয়া, পরে সেপাই রাজত্ব ও আমলাতান্ত্রিকতার চেনা ছকে ঢুকে পড়া, সেখান থেকে স্বৈরাচার-বিরোধী সব পক্ষের জোটবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা, যার পরিণতিতে ১৯৯১-তে স্বৈরাচারের পতন ও নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসা। তবে প্রতিটি পর্যায়ের অভিজ্ঞতার নির্যাস তাতে মেশে। অস্বচ্ছতা পুরো কাটে না। হয়ত কোনোখানেই তেমন হয় না, ক্ষমতা স্বয়ং এক নির্ণায়ক উপাদান। নিজস্ব তাগিদে তা শত্রু-মিত্র বাছাই করে। তারপরেও একটা স্থিতিশীলতার আবরণ গণমানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ওপর বসাতে হয়। গণযোগাযোগের ফন্দি-ফিকিরেরও তাতে ভূমিকা থাকে। এসবের সঙ্গে জড়াজড়ি করে রাষ্ট্রের শাসনে মানব-মানবী সবার আমৃত্যু চলা। যে যেমন পারে। বিপরীতে থেকে কিছু পাবার হিসেবও তাল মেলায়। সবটাই বিশ্ববাস্তবতায় চলমান পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে, অথবা পরোক্ষে তাৎক্ষণিক ও পৌণঃপুনিক লাভের আশায় ছিপ ফেলে। ব্যক্তি ও দল, উভয়ের বেলাতেই এটা খাটে। হয়ত, সেখানে আমাদের মতো রাষ্ট্রের নিজস্ব কর্তৃত্ব অকিঞ্চিৎকর। তাই স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়াবার উদাহরণ প্রায় কিছুই মেলে না। তারপরেও সামষ্টিক জীবনে উন্নয়ন-সম্ভাবনার গতিপ্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামানো সম্ভব। প্রত্যাশার হিসাব-নিকাশে কী আছি, আর কী হতে পারি, তার অনুশীলন অগ্রাধিকার পায়। যদিও কোনো নিদান হাঁকা অবিধেয়।
এই রকম এক চলমান রূপান্তরসাধ্য পটভূমিতে পা রেখে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ যে অর্ধশতক পার করেছে, এবং কোনো অস্তিত্বের সংকট তার ভেতরে-বাইরে চোখে পড়েনা, যদিও প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বে মাটি কাঁপানো হাতবদল ঘটেছে একাধিক কাণ্ডে, এতে আমাদের আত্মবিশ্বাস অক্ষুণ্নই থাকে। অবশ্য কীভাবে থাকি, কেমন করে সামনে তাকাই, মিত্রভেদে ও মিত্রপ্রাপ্তিতে কখন কি মূল্যমান প্রাসঙ্গিক বা কাম্য, এ সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় নিরন্তর। ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তির সরাসরি যোগ থাক, বা না-থাক। তবে কোনো নির্ধারণী কাণ্ড অনিবার্য ছাপ ফেলে সবার ওপরেই। অর্ধশতকের পথ চলায় আশায়-হতাশায়, কল্যাণে অকল্যাণে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি আমরা বার বার। সামনে অনিশ্চয়তার চাদরে মোড়া ভবিষ্যৎ। তা অবশ্য সর্বজনীন। তারপরেও অস্তিত্বের সংকটে যে আমরা আপাতদৃষ্টে ভুগি না, এটা আমাদের সমস্তকে দেখতে চাওয়ায় এক ধরনের নিরাসক্তি জোগায়। তার পরেও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ঢুকে পড়ে। তার হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই।
গত শতকের সত্তরের দশকেও সমাজতন্ত্র একটা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সবখানেই বহু মানুষের চেতনায় তার শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা অক্ষুণ্ন রেখেছে। নতুন যারা লড়াই করে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছে— যেমন কিউবা কি ভিয়েতনাম— তাদের অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুকেও প্রেরণা জাগায়। এও সত্য, তাঁর আপোষহীন ব্যক্তিত্বের মায়া ওই সব দেশেও আদর্শের সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়। পারস্পরিক শ্রদ্ধার এমন বাতাবরণেই বঙ্গবন্ধু আপন সদিচ্ছার ওপর আস্থা রেখে উন্নয়নের লক্ষ্যে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা সমায়িকভাবে হলেও চালু করার ঝুঁকি নেন। অশুভশক্তির পারস্পরিক যোগাযোগ ও নির্মমতার হিংস্র অমানবিক হবার মাত্রা কোন অকল্পনীয় পর্যায়ে যেতে পারে, তা হয়ত কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। ন্যূনতম নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে ভাবাটাও হয়ত জাতির পিতার কাছে আত্মমর্যাদার পরিপন্থী মনে হয়ে থাকতে পারে। হয়ত ঐতিহ্যলালিত ‘লোকপ্রধান’-এর আদর্শ ভূমিকায় বহু বৈপরীত্যের ভেতরে সামঞ্জস্য আনার যে অলিখিত দায়িত্ব অবশ্য পালনীয় বলে স্মৃতির সঞ্চয়ে প্রেরণা ভূমিতে প্রাণের তাগাদা জাগায়, তা তাঁর ভেতরে বিরতিহীন কাজ করে চলেছিল। অসংখ্য ইতি-নেতির মাঝে মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ, হতে পারে তাঁর আরাধ্য ছিল। কিন্তু বাস্তবের স্বার্থান্ধ জিঘাংসা তাঁকে অপমানিত করে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্ট এক ‘আকাশ পানে হাত বাড়ানো’ স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটায়। আমরা আপন আপন খাঁচায় বড়জোর ডানা-ঝাপটানোর অধিকারে তৃপ্তির সীমারেখা খুঁজি।
অনেকেই যে তখন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুক্তিসিদ্ধি মেনে ভবিষ্যতে শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছি এ কথা স্বীকার করায় কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বাস্তব প্রক্রিয়াও যে প্রচুর গোঁজামিলে ভরা; শোষণহীন সমাজে তত্ত্বগতভাবে শ্রমিক শ্রেণীর একক কর্তৃত্বও যে প্রকৃত বাস্তবে ঘাটে-ঘাটে বিপুল সংখ্যায় বামনাকৃতি-দেবতার ক্ষমতা-বলয় রচনা করে; এবং সবটাই গণমানুষের একীভূত বাস্তবতার আর তারই অনপেক্ষ প্রায়োগিক ক্ষমতার দোহাই দিয়ে, এসব নিয়ে নানা কথা কানে এলেও সব মিলিয়ে তাতে যে সমষ্টি কল্যাণ ঊর্ধ্বমুখী হয়, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদের অভ্যাসলালিত দেওয়াল ভেঙে পড়ে, শ্রমজীবী মানুষের ক্ষুধা ও বঞ্চনার অবসান ঘটে, অথবা তা ঘটাবার লক্ষ্যই সার্বিক ক্ষমতাপ্রয়োগ নীতিমালার বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার পায়, এই ধারণাগুলো লালন করাতেই আমরা অভ্যস্ত থাকি। এটাও খেয়াল করি, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে যে পরিসংখ্যান মেলে, তাতে তাদের প্রবৃদ্ধি হার সব মিলিয়ে তুলনায় বেশি; এবং মানব জীবনে বেঁচে থাকার মূল চাহিদাগুলো মেটাতে তারা বেশি সফল।
এখন অবশ্য জানি, এসবে অনেক কিছু ছিল বাড়িয়ে বলা। কোনো কোনো ব্যর্থতার নজির যে আগে পাইনি, তাও নয়। আর আন্তর্জাতিকতাবাদের আড়ালে লালিত হয়েছে মূলে কেন্দ্রভূমির স্বার্থ— তার প্রভাব প্রতিপত্তির বিস্তার। তারপরেও সমাজবাদের কল্পকাঠামো আমাদের টেনেছে। মূলে কাজ করেছে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজ গড়ার অথবা যৌক্তিক নির্মাণে তার হয়ে ওঠার তাত্ত্বিক অনিবার্যতা। এর নৈতিক আবেদনও ছিল প্রশ্নাতীত। বঙ্গবন্ধু যদি এদেশের বঞ্চিত-বিপন্ন মানব-মানবীর ক্ষুধা ও দারিদ্র থেকে মুক্তির লক্ষ্যে উপায়ের পথ খুঁজতে এদিকেও নজর দেন, তবে তা সংগতই মনে হয়। অবশ্য তিনি বাজারের উদ্যোগ কাণ্ডকে অকেজো করতে চাননি। শুধু একচেটিয়া কারবারের রাশ টেনে ধরতে চেয়েছেন। বিশ্ব বাস্তবের গতি-প্রকৃতি কিন্তু তখন ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করেছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় আর এখন চোখে পড়ে না।
এটা ঠিক, গত শতকের তিরিশ দশকের গোড়ায় সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় বৈষম্যহীন উন্নয়নের এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে তৃণমূল পর্যন্ত সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার চাক্ষুষ পরিচয় পেয়ে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়েছিলেন। তারপরেও ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দকে পুরোপুরি বিবেচনার বাইরে রাখা নিয়ে তাঁর মনে দ্বিধা ছিল। জবরদস্তি করে নয়, চিন্তায় ও কর্মে ব্যাক্তির স্বাধীন বিকাশের সঙ্গে সমষ্টির অনর্গল কল্যাণ সাধনার সমন্বয় ঘটিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে তবেই তা মানুষের মুক্তিকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে পারে, এমনটিই ছিল এখানে তাঁর শেষ কথা; যদিও গণমানুষের উত্থান যে তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছিল এটা তিনি উচ্চ কণ্ঠে স্বীকার করেন।
তবে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রে খোদ দলীয় প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চভ প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, লেনিন-পরবর্তী জামানায় জোসেফ স্ট্যালিন সর্বময় কর্তৃত্ব নিজের হাতে ধরে রাখতে শুদ্ধি অভিযানের নামে একের পর এক প্রতিভাবান সব সম্ভাব্য বিকল্প নেতাকে নিশ্চিহ্ন করেন; গোপন বিচারে বহু কমরেডকে নির্বাসনে পাঠান, দলের একনায়কত্বও ব্যক্তির একনায়কত্ব সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। তবে তা প্রধানত কম্যান্ড ইকোনমিতে (Command Economy) নির্দেশ মাফিক শ্রমের বাধ্যতামূলক প্রয়োগে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মরণীয় অবদানও এই পথে। অনুমান, দলীয় শৃঙ্খলায় আনুগত্য এর একমাত্র নিয়ামক নয়। আগে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে জার শাসনের ঐতিহ্যও এতে মেশে। আরো যোগ হয় যুগ যুগ ধরে তীব্র শীতের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার অভ্যাসলালিত সহিষ্ণুতা। পাশাপাশি ক্ষতির পরিসংখ্যান মেলে না। খোলামেলা তথ্য সংগ্রহের কোনো উপায় সেখানে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল। তবে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে লৌহযবনিকার অন্তরালে অনেক অনুভূতিশীল প্রতিভাকে যে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, অথবা তাঁরা নিজেরাই আত্মহননের পথ বেছে নেন, এ তথ্য বেশি দিন গোপন থাকে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থিতিশীলতা কিন্তু বজায় থাকে। বিশ্বজুড়ে মেহনতি মানুষ তার প্রবল প্রতিষ্ঠা থেকে নিজেদের বৈপ্লবিক রূপান্তরের স্বপ্ন দেখে। নির্দেশনা খোঁজে। মানবমুক্তির ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’— ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’-এ কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের এই আহ্বান বিশ্বজুড়ে হাজার হয়ে বাজে। আমাদের এখানেও।
রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনুসরণে চীনেও প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৫০ সালে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র। বস্তুগত অবস্থায় ভিন্নতা পদ্ধতিগত দিক থেকে সেখানে অন্য মাত্রা যোগ করে ঠিকই। লেনিনের ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বও ঠিক খাপে খাপে মেলে না। বরং শোষণ ও দারিদ্রের বাস্তব অভিঘাতই এখানে ছিল সমাজতান্ত্রিক সংঘচেতনায় মূল কারিকাশক্তি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের আগ্রাসনে বার বার পর্যুদস্ত হবার ফলে কায়েমি স্বার্থচক্রের সংহতি ও ক্ষমতা যে টুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে, এও ওই সময়ে সুরক্ষিত সমাজতান্ত্রিক সাংগঠনিক শক্তির বিজয় অভিযান সফল করায় সহায় হয়। মাও দলীয় কর্মকাণ্ডে অনুসরণ করেন স্ট্যালিনকে। তাঁর মতোই সর্বময় কর্তৃত্ব ধরে রাখেন নিজের হাতে। নীতি প্রণয়নে ও প্রয়োগে বিপর্যয় ঘটলেও সর্বহারা শ্রেণীর সংহতি কাজে লাগিয়ে তিনি তাঁর ভাবমূর্তিকে নিষ্কণ্টক অবিনশ্বরতায় প্রতিষ্ঠিত করায় সংগঠনের সর্বশক্তি কাজে লাগান। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১-র ভেতরে বৃহৎ উল্লম্ফন কাণ্ড (Great Leap Forward) ঘোষণা করে কৃষিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে বাধ্যতামূলক যৌথ খামারে নারীপুরুষের নির্বিশেষ শ্রম নিয়োগের হুকুম জারি করেন। ফলে আসে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ। তিন কোটির ওপর মানব-মানবী নিশ্চিহ্ন হয়। উচ্ছন্নে যায় আরো কত! ১৯৬২ তে দলীয় নেতৃত্বে বৃহদংশের চাপে তিনি এই ‘বৈপ্লবিক’ কর্মকাণ্ড স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হন; কিন্তু জনগণের পক্ষে তথাকথিত বুদ্ধিবাদীদের ওপর এবার আক্রমণ শানান। এবং তা প্রধানত শহর কেন্দ্রিক। নাম দেন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এতে কৃষক-মজদুরদের জীবন যাপনের ধরনকে আদর্শ ধরে তা থেকে যাদের বিচ্যুত মনে করেন, তাদের বিরুদ্ধে তাঁর অনুসারীদের লেলিয়ে দেন। দলীয় নেতৃত্বে যাঁদের মনে হয় বুদ্ধিমার্গীয়, তাঁরাও বেইজ্জত হবার হাত থেকে রেহাই পান না। নিজের নির্দেশনামার সংকলন রেড বুক সবার জন্য পাঠ তিনি বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেন। এই হুল্লোড় ও ক্ষমতার দাপট চলে পাঁচ বছরের ওপর।
আমাদের এখানেও ‘মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট’ নামে অথবা ‘বিশুদ্ধ মাওবাদী’ নামে বিভিন্ন অনুসারী দল-উপদল গজায়। তবে ১৯৭৬ সালে মাওয়ের মৃত্যুর পর খোদ চীনেই দলীয় নেতৃত্বে তিনি যাঁদের লাঞ্ছিত করেছিলেন তাঁরা ক্ষমতায় আসেন। আর্থসামাজিক নীতির খোল-নলচে শুদ্ধ তারা বদলে দেন, যদিও বজায় থাকে কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় শাসন। এখন সেখানে সব ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত উদ্যোগ সম্পূর্ণ অবাধ। দেশে, এবং বিদেশেও। কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামো একদলীয় ও সেই দল আগের ধারাতেই কমিউনিস্ট পার্টি— যদিও তার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটিতে শতকরা সত্তরজনের বেশি সদস্য বিলিওনিয়ার (এবং তা আমেরিকান ডলারের হিসেবেই)। বিশ্ববাজারে চীনা উদ্যোক্তাদের— রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন— উভয়েরই তৎপরতা এখন সবচেয়ে আক্রমণাত্মক। সমাজতন্ত্রের আদর্শিক ন্যায়বোধের ছিটেফোঁটাও সেখানে নেই। শুরু অবশ্য ওই সত্তরের দশকেই। মাওয়ের মৃত্যুর পর দেংশিয়াও পিংয়ের নেতৃত্ব দেশটিকে সর্বতোভাবে বাজারমুখো করে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকে, আগেই বলেছি, একদলীয় কর্তৃত্ব। এটা যৌক্তিক নয়। তেমন যে নয় তার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৮৯ সালে ছাত্রদের বাক স্বাধীনতা ও অবাধ গণতন্ত্রের লক্ষ্যে মাটি কাঁপানো আন্দোলনে। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি বিপুল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তাকে নির্মূল করে। বিবিধ কণ্ঠস্বর আর সেখানে উচ্চারিত হয় না। যদিও অর্থনৈতিক ক্ষমতা তার ক্রমবর্ধমান। এই বৈপরীত্য মানব বাস্তবতায় স্বপ্নসম্ভাবনার সামনে বিরাট প্রশ্ন খাড়া করে। সদুত্তর মেলে না। তবে চীনের বৈষয়িক সমৃদ্ধি অলীক নয়। তা প্রশ্নকে আরো জটিল করে।
রাজশাহী, ২০২২।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
লেখক: শিক্ষাবিদ ও লেখক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য।