মাত্রই সাঁতার শেষ করে সুইমিং পুলের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। নভেম্বরের হালকা শীতের বিকেলে ভেজা সুইমিং কস্টিউমে ঠকঠকিয়ে কাঁপছিলেন রোমানা আক্তার। শীতে কষ্ট হলেও রোমানার মুখে লেগে ছিল স্নিগ্ধ হাসি।
মিরপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সুইমিং কমপ্লেক্সে শনিবার শুরু হয়েছে ম্যাক্সগ্রুপ ৩৩তম জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতা। প্রথম দিনে সব মিলিয়ে হয়েছে ৪টি নতুন জাতীয় রেকর্ড। তবে দিনের শেষে সব আলো কেড়ে নিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সাঁতারু। প্রথম দিনেই মেয়েদের ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে রেকর্ড গড়ে জিতেছেন সোনা।
রোমানার এই কীর্তি আরও বড় হয়ে ওঠে যখন জানবেন বিয়ে, সন্তান জন্মদান ও জাতিসংঘ মিশন মিলিয়ে প্রায় ৪ বছর পানির সঙ্গে এক রকম বিচ্ছিন্নই ছিলেন কিশোরগঞ্জের নিকলীর সাঁতারু। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর চাকরির সুবাদে জাতিসংঘ মিশনে সুদানে গিয়েছিলেন দেড় বছরের জন্য।
সেখানে জাতিসংঘের নির্দিষ্ট কার্যক্রমে অংশ নিতেন একজন সৈনিক হিসেবে। পানিতে নামার সুযোগ ছিল না। অনুশীলনও করতে পারতেন না।
কিন্তু সেখান থেকে দেড় বছর মিশন শেষ করে দেশে ফেরেন গত বছর সেপ্টেম্বরে। এরপর প্রথম জাতীয় সাঁতারে অংশ নিয়েই করেছেন বাজিমাত।
দীর্ঘদিন পর পানিতে নেমে প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে অংশ নিলেন রোমানা। এবং সোনার পদক জিতলেন রেকর্ড গড়ে। এমন কীর্তি গড়ে স্বাভাবিকভাবেই খুশি রোমানা, “সুদানে জাতিসংঘ মিশন থেকে ফিরে এটাই আমার প্রথম প্রতিযোগিতা। এতটা বিরতির পরও যে আমার পারফরম্যান্স ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, এজন্য খুব ভালো লেগেছে।”
সুদানে অনুশীলনের কোনও সুযোগ ছিল না রোমানার, “ ওই সময় ট্রেনিংয়ে থাকতে পারতাম না। সাঁতার থেকে পুরোপুরি দূরে ছিলাম বলা যায়। কারণ শুধু ইউএন (জাতিসংঘ) এর যে সব কার্যক্রম ছিল সেগুলো করতাম। তবে আমাদের সেনাবাহিনীর যে ফিজিকাল ট্রেনিং, সকালের পিটি, দৌড় , জগিং, হালকা স্ট্রেচিং- এগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি ফিটনেস ধরে রাখার জন্য।”
ওই সময় সাঁতার ভীষণ মিস করতেন বলে জানালেন, “সুইমিং আমার ভালোবাসার জায়গা। তখন আসলে সাঁতার মিস করতাম খুব”
২০০৮ সাল থেকে নিয়মিত বয়সভিত্তিক ও জাতীয় সাঁতারে অংশ নেন রোমানা। কিন্তু এবার সোনা জিততে সময় নেন ১ মিনিট ১৮.২৭ সেকেন্ড। ২০২১ সালে এই ইভেন্টে মরিয়ম খাতুন রেকর্ড গড়েছিলেন। তার রেকর্ড ভাঙতে পেরে খুব খুশি রোমানা, “আমি যে টাইমিং করেছি এটা ক্যারিয়ারে কখনও করিনি। ৪ বছর বিরতির পরও এটা করতে পেরে খুশি। আমি নিজের টাইমিং নিয়ে সন্তুষ্ট।”
যদিও এই টাইমিংয়ে আন্তর্জাতিক পদক সম্ভব নয় বলে জানালেন, “এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মেডেল জেতা সম্ভব না। কারণ আমাদের দেশের চেয়ে অন্যরা অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পায়। ওরা অনেক ট্রেনিং করে। এগিয়ে গেছে অনেক। তবে এটাকে ধরে যদি আমি আরও ভালো করার চেষ্টা করি তাহলে সেক্ষেত্রে খুব ভালো হবে।”
রোমানাকে ২০০৮ সালে নিকলি থেকে তুলে আনেন কোচ আব্দুল হাশেম। এরপর বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পান। সাঁতারের সুবাদে ২০১৪ সালে প্রথম সেনাবাহিনীর স্থায়ী চাকরি হয় তার।
রোমানার সেরা সাফল্য ২০১৬ সালে। সেবার ৫টা সোনা জেতেন সব ইভেন্টে রেকর্ড গড়ে। তবে এখন সব নজর শুধু ব্রেস্ট স্ট্রোকে দিতে চান, “এখন ১০০ মিটার, ২০০ ও ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে নজর দিতে চাই। “
২০১৬ সালে সর্বশেষ সাঁতারে এসএ গেমসে সোনা জেতেন মাহফুজা খাতুন। আবারও এসএ গেমসে সোনা জয়ের স্বপ্ন দেখেন রোমানা, “ সঠিক অনুশীলন ও বিদেশি কোচ পেলে আমিও এসএ গেমসে সোনা জিততে পারব।”
রোমানার বাবা নেই। মা বেঁচে আছেন। ৪ বোন ও ৬ ভাইয়েই একান্নবর্তী পরিবারে একমাত্র সরকারি চাকুরীজীবি তিনিই। ভাইয়েরা নিজেদের ব্যবসা করেন। কিন্তু মায়ের হাতে নিজের উপার্জনের টাকা তুলে দিতে পেরে খুশি রোমানা, “ আমি চাকরি পাওয়ার পর থেকে মায়ের কাছে টাকা পাঠাই। এভাবেই পরিবারকে সহযোগিতা করতে চাই। এতেই আমার আনন্দ, ভালোলাগা।”
এর আগে বিকেল ৩টায় জাতীয় সাঁতারের উদ্বোধন করেন পৃষ্ঠপোষক ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর।